নোলানের ডুডলবাগ এবং মানুষের অতীত খুনের নেশা



ক্রিস্টোফার নোলানের ১৯৯৭ সালে নির্মিত ডুডলবাগ একটি তিন মিনিটের শর্ট ফিল্ম। এতে দেখা যায় একটি কক্ষে একজন প্রায় উন্মাদ লোক। সে ভীত সন্ত্রস্ত। হাতে জুতা নিয়ে কিছু একটাকে মারতে চেষ্টা করছে। প্রথমে মনে হয় সে কিছু একটা হয়ত কোন পোকা বা ইঁদুরজাতীয় কোন প্রাণী। কিন্তু শেষের দিকে এসে দেখা যায় সেটি কোন পোকা নয়, ইঁদুরও নয়, একজন ক্ষুদে মানুষ। যে লোকটি তাকে মারতে চাচ্ছে তারই ক্ষুদে সংস্করণ।

এবং আরো দেখা যায় তাদের নড়াচড়াও একইরকম।

লোকটি তার ক্ষুদে সংস্করণকে শেষ পর্যন্ত জুতা দিয়ে আঘাত করতে সক্ষম হয়। কিন্তু তখন দেখা তার বড় সংস্করণ জুতা হাতে তাকে আঘাতের প্রস্তুতি নিচ্ছে।

এই ফিল্মের বিভিন্ন ধরনের ব্যাখ্যা হতে পারে। এই তিন লোকই একই লোক। সাধারণভাবে কেউ বলতে পারেন এর মাধ্যমে বুঝানো হয়েছে বুদ্ধধর্মের কর্মের ধারণা। একটা ধারণা আছে মানুষ যা করে, তাই তার কাছে ফিরে আসে। এটাকে জাস্ট ওয়ার্ল্ড ফ্যালাসিও বলা যায়।

এছাড়া আমার মনে হয় ডুডলবাগে লোকটির নিজের ছোট সংস্করণকে হত্যার চেষ্টা আসলে তার অতীতকে খুনের চেষ্টা। মানুষ প্রতিনিয়ত বদলে যায়। সুজাউদ্দৌলার কল্যাণে এই কথাটি বাংলাদেশের শিক্ষিত সমাজের জানার কথা। কিন্তু এই বদলে যাওয়া মানুষ তার পূর্ববর্তী অস্তিত্বকে অস্বীকার করে অনেক সময়।

ক্রিস্টোফার নোলান

যেমন ফ্রাণৎস কাফকা তার সমস্ত লেখা পুঁড়িয়ে ফেলতে বলেছিলেন তার বন্ধু ম্যাক্স ব্রডকে। লিও তলস্তয় আনা কারেন্নিনা, ওয়ার এন্ড পিসের জন্য লজ্জ্বিত পড়েছিলেন এবং তার পূর্ববর্তী সব কাজ অস্বীকার করেন বৃদ্ধ বয়েসে এসে। নিকোলাই গগল ডেড সউল, দি গভর্নমেন্ট ইন্সপেক্টর অস্বীকার করেন।

জিনিসটা ব্যাখ্যার জন্য ফেইসবুককে আনা যেতে পারে। একজন মানুষের ২০১০ সালে পোস্ট করা অনেক ফেইসবুক স্ট্যাটাসের সাথে ২০১৬ সালে তার নিজেরই মত পার্থক্য হতে পারে। তার এমন মনে হতে পারে এটা তো আমি লিখি নি। সে অবাক হয়ে যেতে পারে তার বর্তমানের সাপেক্ষে বুঝার ক্ষমতার তুলনা করে।

আমরা জানি যে, এই ২০১০ সালের লোক এবং ২০১৬ সালের লোক একই ব্যক্তি। কিন্তু ২০১০ সালের ব্যক্তিটি ক্ষমতায় নেই, ক্ষমতায় আছে বর্তমানের তথা ২০১৬ সালের লোকটি। তাই ২০১৬ সালের লোকটি ২০১০ সালের সংস্করণের দেয়া স্ট্যাটাস নিজেই ডিলিট করে দিতে পারে।

এটার মাধ্যমে সে ডুডলবাগের মত নিজেকে খুন করতে পারে। সরাসরি নিজেকে না বলে বলা যাক নিজের অন্য সংস্করণকে।

এই যে নিজেকে হত্যার প্রবণতা এর কারণ হয়ত ফ্রয়েডিয়ান ডেথ ড্রাইভ। বা অন্য কোন কারণ হতে পারে। মানুষের ফেইসবুক একাউন্ট ডিএক্টিভেট করাও এক ধরনের আত্মহত্যা। ফ্রয়েড বলেছেন,

একটা টেনে ধরা রাবার ভেতর থেকে আবার তার আগের অবস্থায় ফিরে আসতে চায়। মানুষও তেমনি সচেতন বা অবচেতনে তার অজৈব অস্তীত্বহীনতায় ফিরে যেতে চায়। মৃত্যু-আকাঙ্খা আর জীবন-আকাঙ্খা আমাদের ভেতর পাশাপাশি খেলা করে। মৃত্যু ভালোবাসার বন্ধু। তারা দুজনে মিলেই বিশ্ব শাসন করে। বেয়ন্ড দি প্লেজার প্রিন্সিপাল বইটিতে আমি সে কথাই বলতে চেয়েছি। সাইকোএনালিসিসের শুরুতে আমরা ভাবতাম ভালোবাসাই আসল কথা কিন্তু এখন জানি যে মৃত্যুও গুরুত্বপূর্ন। প্রতিটি জীবন্ত শরীরে জৈবিকভাবেই মৃত্যুর আকাঙ্খা সুপ্ত থাকে। বিলুপ্তিই জীবনের শেষ উদ্দেশ্য।*

মানুষের নিজের অতীতকে খুন করার চেষ্টা, যেটা হয়ত নন-ভার্চুয়াল জীবনেও আছে কিন্তু সহজে বুঝা যায় না। ভার্চুয়াল সোশ্যাল মিডিয়ার কারণে বুঝা সহজ হচ্ছে। নিজের অতীতের অস্তিত্বকে খুন করার চেষ্টাকে আমি আত্মবিধ্বংশী বলছি না। হয়ত ফ্রয়েডিয় ডেথ ড্রাইভ এর কারণ কিন্তু এর একটা আলাদা দিক আছে যা মনযোগ দাবি করতে পারে।

২০১০ সালের একজন লোক, তার চিন্তা চেতনা বা বিশ্বাসের নিরিখে সে এক মানুষ। ২০১৬ সালে ধরা যাক চিন্তা চেতনায় সে হয়ে গেল ভিন্ন এক মানুষ। তাহলে এই ২০১৬ সালের লোক, ২০১৫ সালের লোককে খুন করার নৈতিক অধিকার রাখে কী?

যদিও আমরা জানি রক্ত মাংসের দিক থেকে তারা দুজনই একই লোক কিন্তু তাদের চিন্তা ও বিবেচনাবোধ তাদের আলাদা করেছে। সুতরাং, তাদের এখানে এক মানুষ বলা যায় না, চিন্তায় তারা দুই মানুষ। বা ভিন্ন ভিন্ন সময়ে দুয়ের অধিক।

নিজের ভিন্ন ভিন্ন অস্তিত্বকে বর্তমানের অস্তিত্বের সাপেক্ষে বিচার করে বর্তমানের ক্ষমতা ব্যবহার করে ধ্বংস করে ফেলার চেষ্টার নৈতিকতা প্রশ্নবিদ্ধ।

ভবিষ্যতে এখন যে বর্তমানের অস্তিত্ব আছে সেও অতীতের ডুডলবাগই হয়ে যাবে।

 

*ফ্রয়েডের স্বাক্ষাতকার নিয়েছেন জর্জ সিলভিস্টার ভিয়েরেক। “কথা পরম্পরাঃ শাহাদুজ্জামান”।