মধ্যযুগের অন্যতম বিস্ময়কর একটা বই হচ্ছে শয়তানের বাইবেল বা কোডেক্স গিগাস। এর গল্পটা এরকম, ১৩শ শতকে একজন পাদ্রী ছিলেন, যার ল্যাটিন নাম হারমেনাস হেরেমিটাস, বর্তমান চেক প্রজাতন্ত্রের বেনেডিকটাইন মনাস্টারিতে। তিনি খুব গর্হিত কোন এক অপরাধ করে বসেন। এইজন্য এবট তাকে মৃত্যুদণ্ড দেন। তিনি এবটকে অনেক অনুরোধ করে রাজী করান যে, তিনি যদি পৃথিবীর সমস্ত জ্ঞান এক বইয়ে জড়ো করতে পারেন এক রাতের মধ্যে, যে বই মনাস্টারির মর্যাদা বহুগুণে বাড়িয়ে দিবে, তাহলে তার মৃত্যুদণ্ড রহিত করা হবে।
এবট এটা অসম্ভব জেনে রাজী হন।
মধ্যরাত পর্যন্ত হারমেনাস চেষ্টা করেন। কিন্তু তিনি কিছুই লিখতে পারেন নি।
এইসময় তার ঘরে, শুনশান নীরবতার মধ্যে হাজির হয় স্বয়ং শয়তান। শয়তান তাকে বলে, তিনি যদি তার আত্মা তাকে দিয়ে দেন, তাহলে সে বইটি লিখতে সাহায্য করবে।
দ্বিধাদ্বন্দ্বে সময় যায় হারমেনাসের। একসময় তিনি রাজী হন।
শয়তান তৈরি করে ধুম্রজাল, সারা ঘরে নেমে আসে ধোঁয়াটে অন্ধকার। তৈরি হয় কোডেক্স গিগাস। যেখানে এক পাতায় শয়তান নিজের ছবিটা রেখে দেয়।
এমন অত্যাশ্চর্য বই আগে কখনো হয়। এবট অবাক হয়ে যান। তিনি মনে করেন, এটা হয়ত ঈশ্বরের কাছ থেকে আসা এক ইশারা। হারমেনাসের মৃত্যুদণ্ড রহিত হয়।
এই কোডেস গিগাস মধ্যযুগের সবচাইতে বড় হাতে লেখা বই। হস্তরেখা বিশেষজ্ঞরা নিশ্চিত করেছেন, এই বিশাল পুস্তক একজন মানুষেরই লেখা। বইয়ে তার স্বাক্ষরও রয়েছে, সেটা হারমেনাসেরই নাম।
কোডেস গিগাস অর্থ বড় বই। কিন্তু এটি পরিচিত শয়তানের বাইবেল নামে। এই নাম হবার পেছনে কারণ দুইটি হতে পারে। এক, এর পেছনের গল্প যে এটি লিখেছিল স্বয়ং শয়তান। দুই, এই বইটিতে শয়তানের এক ছবি আছে।
এই বই নিয়ে কন্সপিরেসি আছে। এর মোট শিট সংখ্যা ছিল ৩২০, কিন্তু কে যেন এর ১০ শিট ছিঁড়ে নিয়েছে। এগুলির মধ্যে কী লেখা ছিল জানা যায় না। সুইডেনের ন্যাশনাল মিউজিয়ামের সৌজন্যে এখানে বইটির ডিজিটাল ভার্শন দেখতে পারবেন।
হয়ত হারিয়ে যাওয়া পাতাগুলিতে ছিল এমন সব গুপ্ত জ্ঞান, যা সাধারণের হাতে পড়লে ছিল বিপদের আশঙ্কা, কোন এক গুপ্ত সংঘটন রক্ষা করে চলেছে সেই গুপ্ত জ্ঞান, ইত্যাদি কন্সপিরেসি কৌতূহল উদ্দীপক হলেও, ফোকাস দিতে চাই হারমেনাসের গল্পে। তার মৃত্যুদণ্ড হয়েছিল, অর্থাৎ ধরতে পারি তার জীবন শেষ ছিল। তিনি শয়তানের সাহায্যে নতুন জীবন পান। এই কাজের জন্য তাকে শয়তানের নলেজ, আইডিয়া নিতে হয়। এটা একটা ইন্টারেস্টিং লাইন অব থট।
যখন আপনি অন্য আরেকজনের চিন্তা নেন, তখন একইসাথে আপনি তার আনকনশাস মোটিভেশনও নেন। কোডেক্স গিগাসে শয়তানের ছবি সেই আনকনশাস মটিভেশনেরই রিমাইন্ডার।
ধরা যাক, আমি কোন চিন্তা শেয়ার করলাম। এর পেছনে আমার কনশাস মোটিভেশন থাকতে পারে। আবার আনকনশাস মোটিভেশনও থাকতে পারে। যেখানে আমি নিজেই আসলে জানি না আমি কীজন্য এই চিন্তাটা করছি। বা আমি মনে করছি এইজন্য চিন্তাটা করছি, কিন্তু আসল কারণ অন্য যেটা আমি নিজেই জানি না। হিউম্যান সাইকোলজি, এবং মানুষের কাজের আনকনশাস মোটিভেশন বিষয়ে এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত জ্ঞান আমাদের জানায় যে, মানুষ প্রায়শই নিজের উদ্দেশ্য কী তা বুঝে না, নিজেরেই ভুল বুঝায়।
যখন আমরা অন্যের চিন্তাটা নেই, তখন না জেনে তার আনকনশাস মোটিভেশনটারেও নেই। হারমেনাসের গল্পে, তিনি শয়তানের চিন্তাটা নিয়েছিলেন, কিন্তু বইয়ে শয়তান হাজির থাকলো, অর্থাৎ তিনি তারেও নিয়ে নিলেন। সম্ভবত এটাই শয়তানের কাছে আত্মা বিক্রি।
শয়তান বা হারমেনাস কি মানুষরে এই সতর্ক বানীই দিয়ে গেছেন কোডেক্স গিগাসের এই শয়তানের ছবির মাধ্যমে, যখন তোমরা অন্যের চিন্তা নিবে, তখন সাবধান?