ইউরোপিয়ানরা পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে যে উপনিবেশ স্থাপন করেছিল তার সব জায়গার তাদের চরিত্র একরকম ছিল না। একেক জায়গায় তাদের উদ্দেশ্য একেকরম হয়েছে। কোন কোন জায়গায় তারা চেয়েছে “নতুন-ইউরোপ” তৈরী করতে। কোন কোন জায়গায় তারা চেয়েছে সেখান থেকে যত বেশী পারা যায় সম্পদ নিয়ে যেতে।
ইউরোপ উপনিবেশীত বিভিন্ন অঞ্চলে তাই সরকারী প্রতিষ্ঠানগুলির ধরণ ভিন্ন ছিল। যেখানে তারা নতুন ইউরোপ স্থাপনের পরিকল্পণা করেছিল সেখানে নিজেদের দেশের মত শক্ত প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছে। পর্যাপ্ত চেক এন্ড ব্যালেন্স (তদারকি) ব্যবস্থা রেখেছে যাতে প্রতিষ্ঠান ঠিকমত কাজ করে, অঞ্চলের অর্থনৈতিক এবং জীবন মানের উন্নয়ন হয়। এমন হয়েছে নিউজিল্যান্ড, কানাডা, অষ্ট্রেলিয়া, ইউনাইটেড স্টেইটসে।
কিন্তু যেখানে সম্পদ আহরনই তাদের উদ্দেশ্য ছিল সেখানে প্রতিষ্ঠানগুলি এত শক্তভাবে তৈরী করার প্রয়োজন বোধ করে নি তারা। তারা এমনভাবে প্রতিষ্ঠান তৈরী করেছে যাতে নিজেদের দেশে যত পারা যায় সম্পদ নিতে পারে, এবং উপনিবেশীত অঞ্চলটির অর্থনৈতিক ও জীবনমানের উন্নয়নের দিকে তাদের লক্ষ ছিল না। ফলে এসব প্রতিষ্ঠানে দুর্নীতির প্রচুর সুযোগ ছিল, পর্যাপ্ত চেক এন্ড ব্যালেন্সের ব্যবস্থা ছিল না। এমন হয়েছে আফ্রিকায়, ভারতীয় উপমহাদেশে।
কিন্তু কেন এমনভাবে কোন জায়গাকে নিজেদের নতুন আবাস (নয়া ইউরোপ) আর কোন জায়গাকে কেবল সম্পদ আহরণের জায়গা হিসেবে নির্বাচন করেছিল ব্রিটেন?
এসিমগলো, জনসন এবং রবিনসন তাদের ২০০১ সালে আমেরিকান ইকোনমিক রিভিউতে প্রকাশিত গবেষণা প্রবন্ধে বলেছেন, ইউরোপিয়ানরা এমন করেছিল মৃত্যুহার বিবেচনা করে।
যেসব এলাকায় ইউরোপিয়ান বিশপ, কর্মকর্তা, পর্যটক এসব লোকদের বেশী মৃত্যু হতো এসব দেশকে তারা নয়া ইউরোপ বানাতে চায় নি।
বিশেষত ম্যালেরিয়া, ইয়েলো ফিভার ধরণের রোগের প্রাদুর্ভাবে বেশী ব্রিটিশ লোকেরা মারা যেত এসব দেশে। প্রায় আশিভাগ ইউরোপিয়ান সেটলারদের মৃত্যুর কারণ ছিল ম্যালেরিয়া।
মাদ্রাজ এবং বাংলায় ব্রিটিশ আর্মিতে যারা কাজ করতে হাজারে এদের মৃত্যুহার ছিল প্রায় ১১ থেকে ১৩। এই হার ব্রিটেনে কর্মরত ব্রিটিশ সৈনিকদের প্রায় সমান, তাদের সংখ্যা ছিল প্রায় ১৫, হাজারে।
কিন্তু মাদ্রাজ ও বাংলায় ব্রিটিশ আর্মিতে ব্রিটিশ যেসব সৈনিক বা কর্মকর্তা কর্মরত ছিল তাদের মৃত্যুহার ছিল হাজারে, ৭০ থেকে ১৭০।
অর্থাৎ, সেটলার ইউরোপিয়ানদের মৃত্যুহার ছিল কিছু এলাকায় বেশী।
ফলে ব্রিটেন নিজেদের এসব উপনিবেশীত অঞ্চলকে আবাস হিসেবে কখনো দেখেনি।
এসিমগলো এবং তার কলিগদের প্রবন্ধটি এ পর্যন্ত আট হাজারের বেশী সাইট হয়েছে গুগল স্কলারে, ফলে তা অবশ্যই অতি গুরুত্বপূর্ন একটি গবেষণা প্রবন্ধ। গবেষকেরা আরেকটু এগিয়ে বর্তমানের সাথে মিলিয়েছেন, যা আরো গুরুত্বপূর্ন। তারা বলেছেন, যেসব অঞ্চলে ইউরোপিয়ানরা অধিক মৃত্যুহার এর মুখোমুখি হয়েছে ঐসব অঞ্চলে তারা খুবই বাজে প্রতিষ্ঠান তৈরী করেছিল। কারণ এইসব অঞ্চলের অর্থনৈতিক এবং লোকজনের জীবনমানের উন্নয়ন তাদের মাথাব্যথা ছিল না, নয়া ইউরোপ তারা বানাতে চায় নি এসব অঞ্চলে। পরবর্তীতে ইউরোপিয়ান ব্রিটিশেরা যখন চলে যায় এবং এসব দেশ স্বাধীন হয় তখন তারা ব্রিটিশ নির্মিত প্রতিষ্ঠানগুলিকেই ভিত্তি ধরে তাদের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো সাজায়। ফলে তাদের দেশের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো হয় বাজে, পর্যাপ্ত চেক এন্ড ব্যালেন্সের অভাবযুক্ত, ফলত দুর্নীতিতে ভারাক্রান্ত।
এই বাজে প্রতিষ্ঠানব্যবস্থার কারণেই এসব দেশ অর্থনৈতিক ভাবে উন্নত হতে পারছে না। নিচের গ্রাফে তৎকালীন ইউরোপিয়ান সেটলারদের মৃত্যুহারের সাথে বর্তমান জিডিপির সম্পর্ক দেখানো হয়েছে।
পক্ষান্তরে ইউএসএ, নিউজিল্যান্ড, অষ্ট্রেলিয়া ইত্যাদি দেশে ইউরোপিয়ান সেটলাররা বসবাস করতে পারত, মৃত্যুহার কম ছিল। বিশেষত নিউজিল্যান্ড তখনকার ব্রিটেন থেকেও স্বাস্থ্যকর জায়গা ছিল। ফলে এসব এলাকায় ইউরোপিয়ানরা ইনভেস্টমেন্ট উৎসাহীত করার মত আইন কানুন এবং প্রতিষ্ঠান তৈরী করে।
গবেষকেরা পরামর্শ দিয়েছেন পূর্ব উপনিবেশীত দেশগুলি যদি তাদের প্রতিষ্ঠানসমূহ বদলায় তাহলে ভালো ফল পাবে। যেমন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া বদলে অর্থনৈতিক উন্নতি ঘটাতে পেরেছে।
আমাদের দেশের প্রতিষ্ঠান ব্যবস্থা উপনিবেশ প্রভাবান্বিত অবস্থায় এখনো রয়েছে। এ থেকে আমরা খুব একটা ভালো ফল দেখতে পাই নি। ফলে সমস্ত প্রতিষ্ঠান ব্যবস্থা নিয়ে সরকারের পুনরায় ভাবা দরকার।
কোন মানবগোষ্ঠী অন্যদের চাইতে বেশী টিকে থাকার ক্ষমতা অর্জন করেছিল তাদের উদ্ভাবনী শক্তির কারণে। ক্রিস হারমানের পিপলস হিস্টরী অব দ্য ওয়ার্ল্ড বইটিকে প্রামাণ্য ধরে বলা যায়, যেসব মানব দল আদি কৃষিভিত্তিক সমাজে নতুন ভাবে পাথুরে যন্ত্র দিয়ে মাটি খোঁড়া, পোষা প্রাণী দিয়ে হালচাষ, সেচ এবং খাল খননের সহজ পদ্বতি ইত্যাদি উদ্ভাবন করতে পেরেছিল তারা টিকেছে, উত্তর উত্তর উন্নতি লাভ করেছে। যারা এইসব উদ্ভাবন করতে পারে নি তারা পিছিয়ে পড়েছে বা হারিয়ে গেছে।
এই অবস্থা পরবর্তীতেও দেখা গেছে, যেমন বাংলার ঐতিহাসিক তৈরী পোষাক-মসলিন শিল্প ধ্বংস হয় ব্রিটেনে শিল্প বিপ্লবের ফলে।
এই অবস্থা এখনো বর্তমান। ইউরোপ আমেরিকা উদ্ভাবনের পিছনে প্রচুর অর্থ এবং সময় ব্যয় করে। তাই তারা সব সময়ই এগিয়ে থাকবে অর্থনৈতিক দিক থেকে। যখনই কোন থার্ড ওয়ার্ল্ড তাদের ধরে ফেলার মত অবস্থায় চলে যাবে তখনই দেখা যাবে তারা নতুন কোন প্রযুক্তি উদ্ভাবন করে সমীকরন বদলে দিয়েছে।