আমাদের পরিচিত শিল্প সাহিত্য পড়া ছেলে আশফাক একদিন গিয়েছিল এক বইয়ের দোকানে। সে গিয়ে কিছু বই পছন্দ করলো। বইগুলি সে নিয়ে গেল ক্যাশে বসে থাকা বৃদ্ধ লোকটির কাছে। গিয়ে বলল, আমি এই বইসমস্ত নিব। এর দাম কত হবে বলেন তো চাচা?
বৃদ্ধ লোকের তরুণ ছেলে ঘরের আরেক পাশে বই গুছিয়ে রাখছে। লোকটি বলল, ভাতিজা আমি দোকানে বসি না, বসে আমার পোলা। ঐ যে পাশে বই গুছাচ্ছে। ওরে গিয়ে একটু দেখিয়ে আনতে পারবা, সে বলতে পারবে কমিশন কত দিতে হবে।
আশফাক বলল, ঠিক আছে চাচা।
সে দুই কদম গিয়ে ছেলেটিকে বইগুলি দেখাল। বলল এগুলি সে নিতে চায়। ছেলে দেখে ওপাশ থেকে বাপকে বলল, ২২ পার্সেন্ট কমিশন দিয়েন।
আশফাক বই নিয়ে আবার এলো বৃদ্ধ লোকটির কাছে। লোকটি বিড়বিড় করে বলছিলেন, আটাইশ পার্সেন্ট কমিশন দিলে আর থাকলো কী।
তিনি আটাশ পার্সেন্ট কমিশনে বই রাখলেন। আশফাক বুঝতে পারল, তিনি ভুল শুনেছেন। ছেলেটি বলেছিল বাইশ। একবার তার মনে হলো লোকটার ভুল ধরিয়ে দেবে। কিন্তু তার ভেতরের আরেক অংশ বলল, ব্যাটা চুপ থাক। কম দামে পাওয়া গেল, এটাই লাভ।
ছয় পার্সেন্ট বেশী কমিশন পেয়েছে, মনে লাভ করার খুশি। আশফাক বেরিয়ে এলো বইয়ের দোকান থেকে।
এখন, আশফাক কি লাভ করল বুড়ো লোকটির কানে কম শোনার জন্য?
যদি আসল চিত্রটা এমন হয় যে ঐ বইয়ের দোকানের তরুন ছেলেটি এবং বুড়ো লোকটি এটা ইচ্ছে করেই করেছে। অর্থাৎ বুড়ো লোকটি ভুল শুনেনি, সে বাইশ পার্সেন্টই শুনেছিল। কিন্তু রেখেছে আটাইশ।
কারণ আসলে বইগুলি ৫০ পার্সেন্ট কমিশনে সেল করলেও লাভ।
কিন্তু তারা এই গেইম খেলেছে আশফাকের সাথে, যাতে আশফাকের মনে হয় সে লাভ করেছে। হিরোনিমাস বসখের আঁকা যাদুকর ছবিটি দেখুন এবার ভালো করে। যাদুকরের খেলা মনযোগ দিয়ে দেখতে ঝুঁকে এসেছেন একজন সম্ভ্রান্ত লোক। আর এই সুযোগে যাদুকরের সহকারী সম্ভ্রান্ত লোকটির পকেট থেকে টাকা চুরি করছে। আমাদের অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় বিভিন্ন দিক থেকে এমন বিভ্রান্তি তৈরী করে আমাদের কাছ থেকে লাভ তুলে নেয় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, ব্যক্তি বা গোষ্ঠী।
কোন কিছুর মূল্য মানুষ বুঝে অন্য কিছুর সাপেক্ষে। আলাদাভাবে মূল্য বুঝার ক্ষমতা মস্তিষ্কের জন্য সহজাত নয়। যেমন এখানে আশফাক তার ছয় পার্সেন্ট লাভ বুঝেছে ২২ পার্সেন্ট এবং ২৮ পার্সেন্টের তুলনায়। সুতরাং এই জায়গায় মস্তিষ্কের এক দূর্বলতা আছে, যা ব্যবহার করে মানুষরে ঠকানো যায় চাইলে।
যা আমাদের গল্পে করেছে বুড়ো লোকটি ও তার তরুণ ছেলে।
নিচের ছবিটির সাহায্যে আমাদের এই বুঝার সীমাবদ্বতা দেখতে পারেন আপনি। এই দুই ছবিতে মাঝখানে যে ধূষর চতুষ্কোন আছে, তা দুইদিকের ছবিতেই একই। কিন্তু বাইরের ব্যাকগ্রাউন্ড কালারের জন্য ডানদিকেরটা হালকা ধূষর মনে হয়।
একই ভাবে, আশফাক যখন শুনল বাইশ পার্সেন্টের জিনিস আটাইশ পার্সেন্টে পাচ্ছে, তৎক্ষণাৎ তার মনে হলো সে লাভ করছে।
উপরের ছবিতে একই ধূষর চতুষ্কোণ কেবলমাত্র আশপাশের রঙ বদলানোর জন্য যে আমাদের কাছে ভিন্ন রকম হয়ে যায় এটা আমাদের দেখার সীমাবদ্বতা। এরকম আরো অনেক ভিজ্যুয়াল ইল্যুশন আছে, যা প্রমাণ করে আমরা যা দেখি তা সব সময় ঠিক নয়।
কিন্তু এই দেখা জিনিসটাই আমাদের সবচেয়ে বড় একটি ক্ষমতা এবং প্রায় সব সময়ই আমরা তা করে থাকি। এই দেখা আমাদের চিন্তাকে প্রভাবিত করে, বলা যায় দেখা দ্বারাই আমাদের চিন্তা নিয়ন্ত্রিত হয়, কারণ প্রকৃতিগত ভাবেই চিন্তাবিমুখ প্রাণী।
কিন্তু যখন আমাদের দেখাটার মধ্যেই অনেক সমস্যা আছে, তাই এর দ্বারা প্রভাবিত চিন্তাতেও সমস্যা থাকবে স্বাভাবিক। এটা ব্যবহার করে আমাদেরকে কেউ চাইলে ঠকাতে পারবে।
পিটার বেভেলিন তার সিকিং উইজডম বইতে লিখেছেন, আমেরিকার ঘর-সম্পত্তি বিক্রেতারা (রিয়েল এস্টেট ব্রোকাররা) মানুষের চিন্তার এই সীমাবদ্বতা ব্যবহার করে বাজে ঘর তাদের গছিয়ে দিত। ধরা যাক, কোন ব্রোকার তার বাজে চেহারার ও জায়গার ঘরটি বিক্রি করতে চায়। ক্লায়েন্টকে সে নিয়ে যাবে ততোধিক বাজে ও খারাপ জায়গায় থাকা ঘরগুলিতে এবং চাইবে উচ্চ দাম। এরপর শেষে নিয়ে যাবে যে ঘরটি সে বিক্রি করতে চায় সেখানে, সেখানে দাম চাইবে আগেরগুলার চাইতে কম।
ক্রেতা অন্যগুলির সাথে এর তুলনা করবে, তখন তার মনে হবে ঘরটি ভালো, দামও ঠিক তার মনে হবে। সে একরকম লাভ করেছে ভেবেই কিনবে, বিক্রেতার প্রতি কৃতজ্ঞতা অনুভব করে। যদিও বিক্রেতা তাকে রীতিমত পরিকল্পনা করে ঠকিয়েছে।
ড্যান আরিয়ালি এমন একটি বিষয় সামনে এনেছিলেন, যা করেছিল বিখ্যাত দ্য ইকোনমিস্ট পত্রিকা। এটা সরাসরি পাঠকদের ঠকানো না হলেও ভোক্তাদের এই বুঝার সীমাবদ্বতাকে ব্যবহার করা।
ইকোনমিস্টে একবার সাবস্কিপশন ছিল এমনঃ
ওয়েব ভার্শন – ৫৯ ডলার।
শুধুমাত্র প্রিন্ট ভার্শন – ১২৫ ডলার।
ওয়েব এবং প্রিন্ট ভার্শন – ১২৫ ডলার।
এখন বাইরে থেকে একজন দেখলে বুঝতে পারবেন এখানে মাঝের খালি ওয়েব ভার্শন দেয়াটা ফালতু। কারণ ১২৫ ডলারে যখন ওয়েব এবং প্রিন্ট দুটোই পাওয়া যাচ্ছে তখন কে ১২৫ ডলারে খালি প্রিন্ট কিনতে যাবে!
ড্যান আরিয়ালি এটা নিয়ে পরীক্ষা করলেন। তিনি এই তিনটি অপশন দিয়ে তার ছাত্রদের বললেন পছন্দ করতে। ৮৪ ভাগ ছাত্র ছাত্রী প্রিন্ট এবং ওয়েব অপশনটি পছন্দ করল। ১৬% কেবল ওয়েব।
আরিয়ালি এবার অপ্রয়োজনীয় ‘শুধুমাত্র প্রিন্ট’ অপশনটি সরিয়ে নিলেন। তখন দুইটা অপশন ছিল। ওয়েব অপশন ৫৯ ডলার। আর ওয়েব এবং প্রিন্ট অপশন ১২৫ ডলার। ছাত্রছাত্রীদের তিনি বললেন পছন্দ করতে।
এবার দেখা গেল ৬৮% ছাত্রছাত্রী ওয়েব অপশন নিয়েছে, এবং মাত্র ৩২% নিয়েছে প্রিন্ট ও ওয়েবের যুগ্ন প্যাকেজটি।
এখানেই অপ্রয়োজনীয় শুধুমাত্র প্রিন্ট প্যাকেজটির বিশেষত্ব। যদিও এটা কেউ নেয় না তথাপি এটি থাকলে প্রিন্ট+ওয়েব অপশনটি অধিকতর স্বস্তা মনে হয় লোকের কাছে। তাদের মনে হয় তারা এতে লাভ করছে।
আরিয়ালি এটার ব্যাপারে পত্রিকাটিতে যোগাযোগ করেন, জিজ্ঞেস করেন তারা এটা কেন করেছে। তারা উত্তর দেয় নি কিন্তু সাবস্ক্রিপশন স্টাইলটি সরিয়ে ফেলে।
[ ড্যান আরিয়ালির বই অনেস্ট ট্রুথ এবাউট ডিজঅনেস্টি নিয়ে আগে লিখেছিলাম। না পড়া থাকলে পড়তে পারেন। ]
আপনারা যারা আগেকার বাংলা ফিল্ম দেখেছেন, দেখবেন নায়িকার সাথে যেসব মেয়েরা থাকত এরা দেখতে অত সুন্দর না। এমন মেয়েদের মাঝে নায়িকাকে রাখলে বেশী সুন্দর দেখাবে, এমন ধারণা থেকেই কাজটি করা হতো।
এটাও একই পদ্বতিতে কাজ করে। তাই কনে দেখানোর সময় যদি কনের পাশে তার চাইতে সুন্দরী কোন মেয়ে থাকে তাহলে কনেকে অসুন্দর লাগবে দর্শকদের কাছে। একই কথা বর মহাশয়দের জন্যও খাটে।
এখন পুনরায় আমরা আমাদের আশফাকের কাছে ফিরি। আশফাক একবার তো ধরা খেল, কিন্তু সে তা জানত না। সে ভেবেছে সে লাভ করেছে। সুতরাং নিজে খুব স্মার্ট এই ধারনা তার মনে পোক্ত হলো।
একবার আশফাক দেখছে এক প্রকাশনী এক পুরনো ক্লাসিক লেখকের সমগ্র বের করবে। এই লেখকের সমগ্র অল্প দামে বইয়ের দোকানগুলিতে পাওয়া যায়, অনলাইনেও আলাদা ভাবে তাদের লেখার সমগ্র নিয়ে ওয়েবসাইট আছে সরকারী বেসরকারী উদ্যোগে।
কিন্তু প্রকাশনী বলল, আপনি আমাদের সহযোগী পাঠক হলে পাবেন দুই হাজার টাকায়। আর এমনিতে ১২ হাজার টাকা।
আশফাক হিসেব করে দেখল তার লাভ হবে আট হাজার টাকা। সে তড়িঘড়ি করে সমগ্রের সহযোগী পাঠক হলো দুই হাজার টাকায়।
এখানে আশফাকের সত্যিকার অর্থে আট হাজার লাভ হলো কি? নাকী অন্য কিছু্র সাপেক্ষে মূল্য বিচারের মানুষের সে ভিজ্যুয়াল ও চিন্তার সীমাবদ্বতা তার সুযোগ নিল ব্যবসায়ী, ও দ্বিতীয়বার এক অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত নিতে বোকামির পরিচয় দিল আশফাক?