কার্ট ভনেগাট ও সক্রেটিস থেকে জীবন দর্শন

মানুষ পুরাতন জিনিশ মাটি খুঁড়ে বের করে, লেখা হয় নতুন ইতিহাস।

একটি পনের বছরের বালক এমন এক আর্কিওলজিক্যাল সাইটে কাজ করছিল। সেই সাইটে কাজ করতেন একজন আর্কিওলজিস্ট। 

একদিন দুপুরের খাবারের পরে, কাজের বিরতিতে তিনি ছেলেটির সাথে কথা বলছিলেন। তোমার নাম কী, কী করো ইত্যাদি প্রশ্ন, যেগুলি করে মানুষ কম বয়েসী ছেলেমেয়েদের সাথে পরিচিত হয়। আর্কিওলজিস্ট জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কোন খেলা খেলতে পছন্দ করো? তোমার প্রিয় বিষয় কী? 

ছেলেটি জবাব দেয়, আমি কোন খেলা খেলি না। থিয়েটার করি, গান গাই, ভায়োলিন বাজাই, পিয়ানো বাজাই। এবং আর্ট ক্লাসে যাই।

আর্কিওলজিস্ট বললেন, ওয়াও! অসাধারণ! 

ছেলেটা শরমিন্দা হয়ে বলে, তা না, আসলে আমি এর কোনটাই ভালো পারি না। 

আর্কিওলজিস্ট এরপরে কিছু কথা বলেন। যা ছেলেটির লাইফ বদলে দেয়। এই ছেলে বড় হয়ে হন একজন বড় লেখক, কার্ট ভনেগাট।

আর্কিওলজিস্ট বলেছিলেন, আমার মনে হয়, কোন কিছু করার উদ্দেশ্য এই না যে এতে সেরা হতে হবে। এই যে বিভিন্ন জিনিশ করছো তুমি, বিভিন্ন রকমের অভিজ্ঞতা হচ্ছে বিভিন্ন দক্ষতায়, এগুলা তোমারে অনেক কিছু শিখায়, এবং তোমারে একজন ইন্টারেস্টিং মানুষ বানায়। তুমি কত ভালো এইগুলা করো, তা বিষয় না। 

ভনেগাট অনেক পরে যখন এই বিষয়টা নিয়ে লেখলেন, তিনি বললেন, এটা আমার জীবনই বদলে দিল। এর আগে আমি ছিলাম এমন একজন যে অনেক কিছু করে কিন্তু কোন কিছুতেই সফল হতে পারে না, কোনকিছু পারে না। কিন্তু এরপরে হয়ে গেলাম এমন একজন যে এসব করে কারণ এগুলি সে এনজয় করে। আমি এমন এক সমাজে বড় হয়েছিলাম যা চারিদিকে ঘেরা ছিল অর্জনের সফলতা ও প্রতিভার গল্পগাথায়। তাই আমার ধারণা ছিল কোন কিছু করার উদ্দেশ্য হলো এতে “জিততে” পারা।

ভনেগাট যে সমাজের কথা বলেছিলেন, সে সমাজ গ্লবালাইজেশনের কারণে এখন সর্বত্র বিস্তারিত। প্রতিভার মিথ, এবং অর্জন নির্ভর সফলতার গল্প মানুষের উপর চেপে বসে আছে। তাই তারা তাই করতে চায়, যাতে তারা সেরা হতে পারে। খেলাধুলা করলেও হতে চায়, জাতীয় দলের কেরিয়ারিস্ট খেলোয়াড়।

আমি সম্প্রতি একটা গল্প শুনলাম, একজন শিক্ষকের কাছ থেকে। ঢাকার এক স্কুলে এক ছাত্র সব সময় এক হতো। তার পরে থাকা কিছু ছেলে তারে এক নাম্বার থেকে সরানোর চেষ্টা করত, কিন্তু পারত না। একবার ছেলেটি অসুস্থতার কারণে এক পরীক্ষা দিতে পারে নাই, ফলে তার রোল নাম্বার পিছিয়ে যায়।

এরপর যেসব ছেলেরা তারে এক নাম্বার থেকে সরাইতে চাইত, এবং এইবার পেরেছে, তাদের মা’রা ঢাকার একটা রেস্টুরেন্টে বুফে পার্টির আয়োজন করে। সেখানে বিজয়ী ছাত্রদের সবাইকে নিয়ে বলা হয়, তোমরা ওরে হারাইতে পারছো তাই এই ট্রিট, ইচ্ছামত খাও।

এটা আমাদের দেশের সমাজের এক অংশের চিত্র।

আমি উইনিং এর বিরোধী নই। যে জায়গায় তার কাজ, সেখানে একজন মানুষ পরিশ্রম করে, নৈতিক ভাবে জিতবে। পারলে সবাইরে ছাড়াইয়া যাবে। এখানে প্রতিযোগিতাও ভালো, কিন্তু এটা এই বুফে মা’দের বানিয়ে দেয়া প্রতিযোগিতার মত না। এরা উইনার ছেলেমেয়ে তৈরি করছে না, লুজার তৈরি করছে, যেটা তারা নিজেরাও। না হলে ক্লাস সিক্স সেভেনের বাচ্চাদের দিয়ে নিজেদের ইগোর ষাঁড়ের লড়াইয়ে নামত না।

শিক্ষা যখন সম্পূর্ণরূপে পণ্য হয় তখন মূল যে কারণে শিক্ষা জিনিসটা শুরু হয়েছিল, সেই কোর উদ্দেশ্য আর বজায় থাকে না।

আমরা আস্তে আস্তে যদি এই অবস্থায় চলে যাই, যেখানে মানুষ আনন্দের জন্য খেলে না, বাদ্যযন্ত্র বাজায় না, গান গায় না, লেখে না; সবগুলাই করতে চায় ওই বিষয়ে সেরা হয়ে কেরিয়ার নির্মানের জন্য, তাহলে সে জিনিশ সমাজের অভারল মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য ভালো না।

দার্শনিক মিশেল ডি মন্টেইন, লিখেছিলেন, ‘সক্রেটিস তার বুড়া বয়েসে নাচ ও গান শিখতেন, এই যে তিনি সময় বের করতে পারলেন এগুলির জন্য, এবং মনে করলেন এভাবে সময় অতিবাহিত করা ভালো, এই জিনিসটাই সক্রেটিসের জীবনের সবচাইতে উল্লেখযোগ্য ঘটনা।’

সক্রেটিস মনের আনন্দের জন্যই এগুলা করতে শুরু করেছিলেন, কারণ ঐ বয়েসে পৃথিবীর সেরা মিউজিশিয়ান হবার ইচ্ছা তার ছিল না, যেহেতু তিনি ছিলেন একজন যুক্তিচিন্তার মানুষ, তিনি তখন অবশ্যই বুঝেছিলেন সেরা গাতক হবার প্রতিভা তার নাই।

কিন্তু এই প্রতিভা নামক কনসেপ্টে বন্দী থেকে, এর বাঁধায় আটকে থেকে অনেক অনেক মানুষ ঐসব জিনিস করার যে আনন্দ তা থেকে নিজেকে বঞ্চিত রাখছে।

আবার, অনেকে করলেও অনেক দুঃখ নিয়ে করছে যে তার এখানে কোন প্রতিভা নেই।

গান গাওয়া, বাদ্য বাজানো, ক্রিয়েটিভ লেখালেখি ইত্যাদি যেসব শিল্প সংশ্লিষ্ট ক্রিয়েটিভ কাজ আছে, এদের এক উদ্দেশ্য মানুষরে তার ভেতর থেকে বের করে এনে আরও বড় করে তোলা।

প্রতিটা মানুষের ভেতরেই দুনিয়াবি কিছু ঝামেলা থাকে, হিংসা দ্বেষ ঘৃণা, প্রতিশোধস্পৃহা স্বার্থপরতা ইত্যাদি। কিন্তু যখন একজন ব্যক্তি মনের আনন্দে কোন জিনিশ ক্রিয়েট করছে, সেটা মাটির কোন পাত্র বানানো, বা গান, কবিতা যাই হউক, সেই মুহুর্তে সে তার ঐ সকল ঝামেলা তথা সীমাবদ্বতার উর্ধ্বে উঠে যায়। এই যে তারে সাময়িক ভাবে মুক্ত করে দেয়া, তারে ব্যক্তি মানুষের চাইতে বড় করে তোলা, এটাই তার ক্রিয়েটিভ কাজের সৌন্দর্য, এবং উদ্দেশ্য। এটাই তার মেডিটেশন।