দি ডারউইন ইকোনমি

ইকোনমিস্ট রবার্ট এইচ ফ্রাংক মনে করেন, একদিন দুনিয়ার লোকজন চার্লস রবার্ট ডারউইনকে অর্থনীতির ফাদার বলে মানবে। ন্যাচারালিস্ট বিজ্ঞানী ডারউইনের ইনসাইট আছে হিসেবে প্রাণী হিসেবে মানুষের প্রকৃতি কেমন, এবং কীভাবে ন্যাচারাল সিলেকশন কাজ করে, যা রবার্ট ফ্রাংক মনে করেন অবশ্যই প্রযোজ্য মানুষের অর্থনৈতিক আচার ব্যবহার বুঝার জন্য। ফ্রাংক আরো এগিয়ে বলেন যে মার্কেট কীভাবে কাজ করে ও কীভাবে কাজ করে না, এটা সম্পর্কে ক্লিয়ার ধারণা না থাকলে কোন ইকোনমিক পলিসিই কাজ করবে না।

আমরা একটা সরকার বানিয়েছি। এটা আমাদের একটা সম্মিলিত চুক্তি যে এই সরকার আমাদের সবার জন্য যা ভালো হয়, সেরকম পলিসি নিবেন। সরকার পলিসি নেন, কিন্তু দেখা যায় আমাদের সমাজ দিনে দিনে আরো আনজাস্ট হয়ে উঠে। অসাম্য প্রকট হয়।

এর কারণ হিসেবে ফ্রাংক তার বইতে আলোচনা করেছেন, এবং অল্টারনেটিভ সমাধান তিনি প্রস্তাব করেছেন।

প্রথমত তিনি সমস্যা হিসেবে দেখেছেন লিবারেটারিয়ান বা ফ্রি মার্কেট ফান্ডামেন্টালিস্টদের। যারা মনে করেন ব্যক্তির অর্থনৈতিক লাভে সরকার যতটা কম ততোটা হস্তক্ষেপ করবে। তারা ধনীদের উপর বেশি কর আরোপের বিপক্ষে। তাদের মতে এটা ব্যক্তির স্বাধীনতার উপর অন্যায় হস্তক্ষেপ। যা আলটিমেটলি সমাজের স্বাধীনতার উপর হস্তক্ষেপ।

ফ্রাংক বলেন, এই লিবারেটারিয়ানরা এডাম স্মিথের “অদৃশ্য হাত” কীভাবে কাজ করে তা বুঝেন না বা ভুল বুঝেন। তারা মনে করেন ১৮ শতকের দার্শনিক এডাম স্মিথ অদৃশ্য হাত বলতে বুঝিয়েছেন যখন সমাজে ব্যবসায়ী ব্যক্তি লাভ করবে তখন তা স্বয়ংক্রিয় ভাবে সমাজের জন্য সুফল বয়ে আনবে, একটি অদৃশ্য হাতের মাধ্যমে। যদিও স্মিথ বাস্তব প্রেক্ষাপটে এই হাত কীভাবে কাজ করবে, কতটুকু কাজ করবে এ নিয়ে সন্দেহ করেছেন। তিনি মনে করতেন না সকল সময় ব্যক্তির স্বার্থ সমাজের স্বার্থের জন্য ভালো হবে।

এর প্রায় এক শতক পরে মানববুদ্ধির উৎকর্ষতার এক অসামান্য দৃষ্ঠান্ত, চার্লস ডারউইন প্রাণীকূলের উপর তার পর্যবেক্ষণের এক পর্যায়ে এই সিদ্ধান্তে আসলেন যে, মিউটেশনের ফলে প্রাণী সে সুফল পায়, তা তার সমাজের জন্য প্রায়ই ক্ষতিকর হয়।

যেমন হস্তিকায় পুরুষ সিল মাছ প্রতিযোগীতার মাধ্যমে প্রচুর নারী সিল মাছকে করায়ত্ত্ব করতে পারে। তারা একটা হারেম তৈরি করে। ফলে, তার বাচ্চাগুলার মধ্যে এই হস্তিকায় জিনের বিস্তার হয়, বাচ্চাগুলাও বড় হয়। এতে পরবর্তী প্রজন্মের সিলগুলা বড় হতে হতে এদের চলাফেরা মন্থর হয়ে উঠে। ফলে তারা শিকারীর সহজ শিকারে পরিণত হয়।

এইরকম আরো অনেক প্রাণী ও অনেক উদ্ভিদে এরকম মিউটেশনের ফলে উৎপন্ন বৈশিষ্ট্য ঐ প্রাণীকে সুফল দিলেও তার সামগ্রিক সমাজের জন্য প্রায়ই ক্ষতিকর হয়।

এডাম স্মিথের অদৃশ্য হাত ধরে নেয় যে, যে ব্যক্তি সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন তিনি খুব র‍্যাশনাল, দীর্ঘমেয়াদি ভেবে চিনতে, সমাজের ভালোর জন্য সিদ্ধান্ত নিবেন। কিন্তু, বাস্তবে তা হয় না। কারণ ন্যাচারাল সিলেকশনে ডারউন প্রাপ্ত যে ইনসাইট আমরা দেখি, তা প্রতিযোগিতার একটা ক্লিয়ার চরিত্র আমাদের সামনে আনে। ব্যক্তি তার বিবর্তনীয় ড্রাইভ থেকে তার ব্যক্তিগত লাভের মোটিভেই সিদ্ধান্ত নিবে, সমাজের দীর্ঘমেয়াদি ভালো’র হিসাবের কথা ভেবে নয়।

এই প্রতিপক্ষ থেকে সাময়িক বেশি এডভান্টেজ পাওয়া যে বিপদজনক হয়ে উঠে সমাজের জন্য, তা এক উদাহরণের মাধ্যমে বুঝিয়েছিলেন অর্থনীতিবিদ থমাস শিলিং।

তিনি বলেছিলেন, ধরা যাক হকি খেলায় একজন খেলোয়াড় হেলমেট ছাড়া খেলায় নামবে, যাতে সে একটু বেশি সুবিধা পায় অন্যদের চাইতে।  এর বিপরীতে সে ঝুঁকি নিল, তার কাছে মনে হলো এই ঝুঁকির বিনিময়ে ঐ আলাদা সুবিধাটা পেলে মন্দ নয়। এখন অন্য সব খেলোয়াড়রা যদি হেলমেট ছাড়া খেলতে শুরু করে এই সুবিধার জন্য তখন এই আলাদা বেশি সুবিধাটি আর থাকলো না। কিন্তু খেলাটি সকলের জন্যই হয়ে উঠল বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। এইজন্য হকি খেলার জন্য বাধ্যতামূলক নিয়ম, কোন খেলোয়াড় বাড়তি সুবিধার জন্য হেলমেট ছাড়া খেলতে পারবে না, এটা সব দলই মানে। সবাই নিয়মটি মানলে সবার জন্যই ভালো।

রবার্ট এইচ ফ্র্যাংক
রবার্ট এইচ ফ্র্যাংক, অর্থনীতির অধ্যাপক, কর্ণেল বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসন গ্র্যাজুয়েট স্কুল অব ম্যানেজমেন্ট

মানুষ ইকোনমি রান করে, বা অর্থনৈতিক ব্যবস্থা চালিত হয় মানুষের সিদ্ধান্তের উপর ভিত্তি করে। ফলে মানুষের প্রতিযোগিতা ও মোটিভেশন না বুঝলে, অর্থনীতি বুঝা সম্ভব নয়। এইখানে এডাম স্মিথ ব্যর্থ, ও ডারউইনের ইনসাইট কার্যকর।

মানুষের মোটিভেশন হলো তার প্রতিপক্ষ থেকে এগিয়ে থাকার। তারা চায় তাদের বন্ধু বান্ধব, পরিচিত জন বা সমাজের অন্যান্যদের চাইতে তাদের বাড়ি ভালো হোক, গাড়ি ভালো হোক ইত্যাদি। এই সোশ্যাল স্ট্যাটাসকে উঁচুতে রাখার প্রবণতাই মানুষের ইকোনমিক কর্মকান্ডকে চালিত করে। নিউরোসাইন্সের পরীক্ষা নির্ভর ফলাফলও এটি সমর্থন করে যে, যখন মানুষ বুঝতে পারলে তার সোশ্যাল স্ট্যাটাস বা অন্যদের চাইতে র‍্যাংক বেড়ে গেছে বা তার এই অনুভূতি হয় (এটা হতে পারে দামী বাড়ি কিনে বা আইফোন কিনে বা অন্যান্য) তখন তার মস্তিষ্কে আনন্দ উত্তোলনকারী হরমোন সেরোটোনিনের নিঃসরণ বেড়ে যায়।

মানুষের বেশিরভাগ অর্থ ব্যয়ই হয় তার সোশ্যাল স্ট্যাটাস বাড়ানোর জন্য, সমাজের সামগ্রিক ভালোর জন্য নয়। দুটি দেশ, ধরা যাক চীন ও ভারত। তারা প্রতিদ্বন্ধী, দুই দেশই অস্ত্র বাড়াচ্ছে। এক দেশ দুইশ মিসাইল কিনলে আরেক দেশ কিনে তিনশো। এভাবে প্রতিযোগীতা চলতে থাকে। এবং কোনদেশই এগিয়ে যেতে পারে না, শুধু অস্ত্র ক্রয় হয়। মানুষের প্রতিদ্বন্ধীতামূলক ব্যয়গুলির পরিণতিও একইরকম।

এখন মানুষ যদি যৌক্তিক বুদ্ধিসম্পন্ন হতো, তাহলে সে ভাবতো এই অন্তঃসারশূন্য প্রতিযোগিতা না করে আমার ব্যয় করা উচিত দেশের রাস্তাঘাট, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, এবং স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উপরে। স্বাস্থ্য ব্যবস্থা কতো গুরুত্বপূর্ণ আপনি এই করোনা ভাইরাস ক্রাইসিসের কারণে হয়ত বুঝতে পারছেন। এতো টাকা বাংলাদেশে, কতো বিনোদন ব্যবসা, কিন্তু কৃত্রিম শ্বাস প্রশ্বাসের যন্ত্রই নাই ৬৩ জেলায়। বা আমেরিকার মত দেশ, যার অস্ত্রের পিছনে খরচ সীমাহীন, যার টাকার কোন অভাব নেই, তারো চিকিৎসা ব্যবস্থা ভালো না। করোনা ভাইরাসের ক্রাইসিসে হিমশিম খাচ্ছে।

রবার্ট ফ্র্যাংক তার বইতে বলেন, মানুষ যেহেতু প্রতিদ্বন্ধীতা করতে গিয়ে কনজাম্প করে, ফলে এই কনজাম্পশনের উপরেই বেশি কর বসাতে হবে। আর টাকা সেইভের উপরে করের হার কমাতে হবে।

ফ্র্যাংক আরেকটা আর্গুমেন্ট দেন, যেটি আমি মেরিটোক্রেসি নিয়ে লেখায় ব্যাখ্যা করেছি, যে একজন ব্যক্তির সফলতা কেবল তার পরিশ্রমের ফল নয়। বেশিরভার ক্ষেত্রেই এটি তার বায়োলজিক্যাল লাক, এবং অন্যান্য লাকের ফল (মিখায়েল মাওবাসিনের লাক নিয়ে লেখা বই নিয়ে)। এবং একটা ভালো সিস্টেমে সে প্রচুর সাকসেস পেতে পারে। যেমন ওয়ারেন বাফেট এটা পয়েন্ট আউট করেন সব সময়। তার সফলতার জন্য তিনি দায়ী করেন প্রথমত তার জন্মকে, যার নাম তার কথায় অভারিয়ান লটারী। দ্বিতীয়ত, তিনি আমেরিকার মত একটা ব্যবস্থার মধ্যে কাজ করতে পেরেছেন। বাংলাদেশের নাম নিয়ে একবার তিনি বলেছিলেন, বাংলাদেশের মত জায়গায় হলে আমি হয়ত কিছুই করতে পারতাম না। এটি আমি পেয়েছিলাম ইকোনমিস্ট হা-জুন চ্যাং এর বই টুয়েনি থ্রি থিংস দে ডোন্ট টেল ইউ এবাউট ক্যাপিটালিজমে। নিচে বাফেটের উক্তিটি পেশা করছি।

I personally think that society is responsible for a very significant percentage of what I’ve earned. If you stick me down in the middle of Bangladesh or Peru or someplace, you find out how much this talent is going to produce in the wrong kind of soil… I work in a market system that happens to reward what I do very well – disproportionately well.

  • Warren Buffet, In 1995 TV Interview.

এই যে একজন ব্যক্তি সফল হচ্ছেন ম্যাসিভলি, এটা সিস্টেমের ভেতর কাজ করে, এই সিস্টেমের জন্য যারা কাজ করছেন, পে করছেন তাদের অবদান আছে তার সাকসেসে।

ফলত তার টাকা কেবল তার পরিশ্রমের ফল নয়। ফ্রাংক, এইভাবে আর্গুমেন্ট দেন ধনীদের উপর বেশি করারোপের, যেটাকে তিনি ন্যায্য মনে করেন। এটি সমাজের বেটার গুডের জন্য আরো ন্যায্য হবে, কারণ প্রতিভাবানরা তখন কেবল বেশি টাকার পেছনে ছুটবে না। তারা সমাজের জন্য যেসব জিনিস দরকারী এগুলির জন্যও কাজ করতে আগ্রহী হবে। যেটি বর্তমানে হয় না। ৪৫% প্রিন্সটন গ্যাজুয়েটরা ফাইনানশিয়াল সেক্টরে চলে যায় বলে উদাহরণ দেন ফ্র্যাংক, বেশি টাকার জন্য। বেশি পে চেকের উপর বেশি করারোপের ব্যবস্থা থাকলে এই প্রতিভারা অন্য জায়গায় যেত যেখানে তাদের প্রতিভা ম্যাক্সিমাম কাজে লাগতো।

ফ্রাংক ব্যক্তির স্বাধীনতার চাইতে সবার স্বাধীনতার উপর গুরুত্ব আরোপ করতে চান। কারণ ব্যক্তি, বিবর্তনীয় দিক থেকে বিচার করলে অযৌক্তিক এবং তার নিজের লাভই দেখবে যা সামগ্রিক ক্ষতির কারণ হবে। সালফার ডাই অক্সাইডের ব্যবহারের উপর একটি ফেডারেল প্রোগ্রামের কিছু নীতিমালা ১৯৯০ থেকে এর ব্যবহার কমিয়েছে, যা প্রচুর পরিমানে এসিড রেইন কমাতে সাহায্য করেছে। একইভাবে যদি কার্বন ডাই অক্সাইড নিঃসরণের উপর শক্ত কর আরোপ করা যেত তাহলে এর উৎপাদন কমে যেত, এবং এটি পরিবেশ বিপর্যয়ের হাত থেকে আমাদের রক্ষা করতো।

ফ্রাংক যে মোরাল অবস্থান থেকে কথা বলতে চান, তা হলো ইউটিলিটারিয়ান। অর্থাৎ, সমাজের ভালো’র ধনীদের উপর বেশি কর আরোপ দরকার, এবং এটি করা উচিত, কারণ এতে তাদের ঐ করকৃত অর্থের ম্যাক্সিমাম আউটপুট আসবে।  এছাড়া তিনি বলতে চান, ব্যক্তির সফলতায় সমাজের অবদান থাকে, ফলত ঐ করারোপ অনায্য হয় না। এবং তিনি এটাও বলতে চান, সমাজে অনেক মানুষ ভাগ্যের কারণে কম ভালো অবস্থানে থাকেন, তাদের জন্য সেরা পাবলিক সার্ভিস নিশ্চিত করতে সরকারকে কাজ করতে হবে, এবং এটাই সরকারের কাজ। আর এই কাজ করতে গিয়ে সরকারকে পলিসি নির্ধারণের সময় মাথায় রাখতে হবে, ব্যবসায়ী ব্যক্তিরা বা ধনী ব্যক্তিরা মানুষের প্রকৃতিগত বিবর্তনীয় ড্রাইভের বাইরে না, তারা ব্যক্তিস্বার্থ দেখেই কাজ করবেন, যেটি সামগ্রিক ভাবে সব মানুষের জন্য ক্ষতির কারণ হবে। ফলে, তাদের চেকে রাখতে হবে সমাজের ভালোর জন্য ও সকলের ব্যক্তিগত স্বাধীনতার জন্য।