এক্ট-১
দৃশ্য-১
সময় রাত। বেডরুম। বিছানায় দুইটি মানুষ। তারা স্বামী ও স্ত্রী। স্বামীটির নাম হাসান। স্ত্রী’টির নাম অবন্তী। তাদের বয়স ত্রিশের নিচে। তারা বেশ রোমান্টিক আবহে কথাবার্তা বলছে।
অবন্তীঃ আজ আপা ফোন দিয়েছিল। কাল তার বাসায় দাওয়াত দিয়েছে।
হাসানঃ হুম…
অবন্তীঃ হুম কী? যাবে নাকী না?
হাসানঃ যাওয়া ঠিক হবে কি না ভাবছি।
অবন্তীঃ কেন ঠিক হবে না? সময় সব কিছু ঠিক করে দেয়। আমাদের বিয়ের তো প্রায় এক বছর হলো।
হাসানঃ তা ঠিক। কিন্তু পরিবারের অন্যরাও তো আসবে…
অবন্তীঃ সব পরিবারই একসময় এগুলো মেনে নেয়, ক্ষমা করে দেয়।
হাসানঃ মেনে নেয়া আর ক্ষমা এক জিনিস নয়।
অবন্তীঃ দুই জিনিস কীভাবে?
হাসানঃ একটা হচ্ছে প্রকৃত ক্ষমা, পিওর ফরগিভনেস। আরেকটা মেনে নেয়া, ধরো রেকনসিলিয়েশন। দুইটা দুই জিনিস। প্রকৃত ক্ষমা অসম্ভব ব্যাপার।
অবন্তীঃ এরকম কথা কার কাছ থেকে শিখেছ? আহসান সাহেব?
হাসানঃ আরে না! তবে তিনি একবার বলেছিলেন। এটা জ্যাক দেরিদার কথা। জ্যাক দেরিদা একজন ফ্রেঞ্চ-আলজেরিয়ান দার্শনিক। আহসান সাহেব তাকে নিয়ে কাজ করেন।
অবন্তীঃ আরেকটাও আছে। কী যেন নাম।
হাসানঃ ফুকো। মিশেল ফুকো। উনার রুমে ডেস্কের সামনে লাগানো ছবিটাই ফুকো’র।
অবন্তীঃ উদ্ভট লোক। তবে আমার বেশ লাগে। তার বই পড়েছি। অসম্ভব ভালো লেখেন।
হাসানঃ তবে আমার বিশেষ সুবিধার মনে হয় না। তোমার দিকে অন্য দৃষ্টিতে তাকান। তাছাড়া কথাবার্তায় তোমার প্রতি বুড়ার দূর্বলতা বুঝা যায়। তাই আমি ভাবছি এই বাসাটা ছেড়ে দেব।
অবন্তীঃ আরে না! যা ভাবছো তা নয়। উনি একটু কথাবার্তা বলতে পছন্দ করেন।
হাসানঃ এই কথাও সত্যি না। পত্রিকায় আমি পড়েছি তিনি এখন আর সাংবাদিকদের ইন্টারভিউ দেন না।
অবন্তীঃ আচ্ছা, ঠিক আছে, উনার কথা বাদ দাও।
হাসানঃ ওকে। এসব কথা বাদ।
হাসান এবং অবন্তী মুখোমুখি। খুবই রোমান্টিক দৃশ্যের পূর্বমুহুর্ত। প্রথমে তারা পরস্পরের আখিদ্বয়ের দিকে তাকাবে।
হাসানঃ তোমার চোখের মত এত সুন্দর চোখ আমি আর দেখিনি। এ ধরনের চোখকে বলে গভীর কুয়ার মত।
অবন্তীঃ কুয়া?
হাসানঃ গভীর কুয়া। গভীর কুয়ার এক দুর্বোধ্য সৌন্দর্য আছে। শক্তি যে ধরনের কুয়া নিয়ে লিখেছিলেন, অনন্ত কুয়ার জলে চাঁদ পড়ে আছে।
অবন্তী হাসলো। যেন এটা তার পাওনা। অর্থাৎ, এই হাসিটা এমন যাতে লজ্জ্বা এবং সৌন্দর্যের অহংকার সমানুপাতে মিশ্রিত।
হাসানঃ নেরুদার থেকে নিয়ে বলি, ‘আই ওয়ান্ট টু ডু উইথ ইউ হোয়াট স্প্রিং ডাজ উইথ দ্য চেরী ট্রিজ।’
অবন্তীঃ (হেসে।) ওকে …
একটি পরিস্থিতি যে, অচিরেই চুমুদৃশ্যের অবতাড়না হবে। তারা পরস্পর যখন কাছাকাছি এবং চুমুর পূর্বমুহুর্ত, ঠিক তখনই দরজায় একটা শব্দ হলো। হাসান দ্রুত ঘুরে তাকাল, স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া।
হাসানঃ কে, কে ওখানে?
সে দ্রুত উঠে গিয়ে দরজা সামনে দাঁড়াল এবং দরজা খুললো। অবন্তীও গেল তার পিছু। তারা বের হলো, এবং অল্প এগিয়ে গেলেই ড্রয়িং রুম। দেখা গেল সেখানে একটা বই নিয়ে বসে আছেন একজন বুড়ো লোক। তার বয়স পঞ্চাশের উপরে। চোখে চশমা। মাথায় অগোছালো বড় চুল। তিনি লেখক ও দার্শনিক আহসান কবির।
আহসান কবিরঃ আরে!তোমরা?
হাসানঃ আপনি আমাদের দরজায় ছিলেন একটু আগে?
আহসান কবিরঃ না তো! আমি এখানেই বসে ছিলাম। কেন কী হয়েছে?
হাসানঃ দরজায় একটা শব্দ হলো। মনে হলো কেউ একজন দাঁড়িয়ে ছিল, সে সরে গেল।
আহসান কবিরঃ হতে পারে কোন ইঁদুর বা বিড়াল। তা তোমরা যখন এসে পড়েছ একটু বসো। কথা বলি।
হাসানের মুখে বিরক্তি ফুটে উঠল। অবন্তীর মুখে নয়। তারা দুজন আহসান কবিরের সামনে গিয়ে বসল সোফায়।
আহসান কবিরঃ শব্দটি মনে হয় তোমাদের খুবই সমস্যায় ফেলে দিল?
হাসানঃ তা তো দিলোই।
আহসান কবিরঃ তুমি কী বলো অবন্তী?
অবন্তীঃ (অল্প হেসে।) আমি আর কী বলবো। হয়ত আসলে কোন শব্দ হয় নি।
আহসান কবিরঃ তার মানে তুমি শুনো নি?
অবন্তীঃ আমার খেয়াল ছিল না।
আহসান কবিরঃ আমার ধারণা শব্দটি তোমাদের মধ্যে একরকম বিচ্ছেদ তৈরী করেছে। তাই শব্দটি হচ্ছে মহান।
হাসানঃ (কিছুটা বিরক্তির সাথে।) কী বলতে চান?
আহসান কবিরঃ আমি কল্পনা করে বলব। তাই তোমাদের অনুমতি চাচ্ছি, সিরিয়াসলি নেয়ার কিছু নেই, তবে নিলে নিতেও পারো।
হাসান অবন্তীর দিকে তাকাল।
অবন্তীঃ বলুন তো। সমস্যা নেই।
আহসান কবিরঃ আমার ধারণা তোমরা আবেগঘন কোন রোমান্টিক মুহুর্তের পূর্বাবস্থায় ছিলে। এই শব্দটি তোমাদের সেই মুহুর্ত থেকে আবার বাস্তবে নিয়ে এসেছে। এটি একটি বিচ্ছেদ তৈরী করেছে। আর প্রেমের মাহাত্ম্য তো বিচ্ছেদেই।
অবন্তীঃ প্রেমের মাহাত্ম্য বিচ্ছেদে হয় কীভাবে?
আহসান কবিরঃ আসল প্রেম তো প্রেম নয়, আসল প্রেম হচ্ছে প্রেমের স্মৃতি। আর প্রেমের স্মৃতি শক্তিশালী হয় বিচ্ছেদে। তোমরা দার্শনিক সোরেন কীয়ের্কেগার্ডের ব্যাপারটা জানো?
হাসানঃ (বিরক্তির সাথে।) না।
আহসান কবিরঃ কীয়ের্কেগার্ড যখন তরুণ ছিলেন তখন একটা মেয়ের প্রেমে পড়েন। মেয়ের নাম রেজিনা ওলসেন। তাদের পূর্বপরিচয় ছিল। কোপেনহেগেন তখন ছোট শহর। তা, একদিন কীয়ের্কেগার্ড রেজিনার সাথে গেলেন তার বাসায়। বাসায় তখন আর কেউ নেই। রেজিনা কীয়ের্কেগার্ডকে পিয়ানো বাজিয়ে শুনাচ্ছিলেন। এমন সময় হঠাৎ করেই কীয়ের্কেগার্ড তার হাতের বই ছুঁড়ে ফেলে দেন, এবং বলেন, “আমি কি এখানে পিয়ানো শুনতে এসেছি নাকী।” তারপর রেজিনা ওলসেনকে সরাসরি বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে বসেন।
যাই হোক, অল্পদিনের মধ্যে তাদের যখন বিয়ে ঠিক হয়, তখন কীয়ের্কেগার্ড হঠাৎ করে সবাইকে অবাক করে দিয়ে এংগেজমেন্ট ভেঙ্গে দেন, প্রায় কোন কারণ ছাড়াই। রেজিনা আত্মহত্যার হুমকি দিলেও তিনি আর ফিরে আসেন নি। সারা জীবনে আর কোন প্রেমও করেন নি, বিয়েও করেন নি। তার সারা জীবনের চিন্তায় রেজিনা ওলসেনের সাথে বিচ্ছেদের শক্তিশালী প্রভাব ছিল। ওয়েস্টার্ন ফিলোসফিতে আর কোন দার্শনিকের উপর কোন নারীর এমন প্রভাব দেখা যায় না। আমার ধারণা কীয়ের্কেগার্ডই ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছিলেন যে, প্রকৃত প্রেম হলো বিচ্ছেদ।
হাসানঃ (বিরক্তির সাথে।) ঠিক আছে। আমরা এখন ঘুমোতে যাই। আপনার সাথে পরে কথা হবে।
হাসান উঠে দাঁড়াল। অবন্তীও তার সাথে। হাসানের মুখে বিরক্তি থাকলেও অবন্তীর মুখে বিরক্তি নেই। আহসান কবির অবন্তীর দিকে তাকিয়ে হাসলেন। বিষয়টি হাসানের চোখে পড়ল।
আহসান কবিরঃ গুড নাইট।
হাসান ও অবন্তী তাদের বেডরুমে চলে গেল। আহসান কবির বসে রইলেন। তিনি কিছু ভাবছেন।
দৃশ্য-২
হাসান ও অবন্তীর বেডরুম। হাসান খাটে বসে আছে। তার মধ্যে বিরক্তি স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে। অবন্তী বিছানার উপরে।
হাসানঃ আমি নিশ্চিত এই বুড়াই ছিল দরজার ওপাশে। কী বিরক্তিকর একটা লোক! এই বাসা আমাদের ছেড়ে দিতেই হবে। এই লোকের জ্বালায় শান্তিতে থাকার উপায় নেই।
অবন্তীঃ ঠিক আছে। এখন ঘুমাও। বাসা বদলাতে বললেই তো হয় না, খুঁজতে হবে।
হাসানঃ এবং লোকটাকে আমার সন্দেহজনক মনে হচ্ছে আরো।
অবন্তীঃ সন্দেহের কী আছে? তিনি বিখ্যাত লোক। তার সম্পর্কে অনেকেই জানে।
হাসানঃ কিন্তু লোকটার আত্মীয় স্বজন ইত্যাদি সম্পর্কে তেমন কিছুই কেউ জানে না। তার সম্পর্কে যা জানে লোকে তা কেবল তার লেখালেখি সম্পর্কে।
অবন্তীঃ ঠিক আছে। এখন ঘুমাও।
হাসানঃ আমার মনে হচ্ছে ও তোমার সাথে কিছু একটা করতে পারে।
অবন্তীঃ কিছু একটা মানে কী? কী করবে? ফালতু চিন্তা বাদ দাও। আমি বলছি উনি মানুষ হিসেবে খারাপ তা আমার মনে হয় নি এই ক’দিনে।
হাসানঃ কিন্তু আমার মনে হচ্ছে। তোমার দিকে কীভাবে তাকায় দেখেছ?
অবন্তীঃ উফ! বিরক্তিকর কথাবার্তা বলবে না। আমাকে ঘুমাতে দাও।
অবন্তী পাশ ফিরে শুয়ে পড়ল। হাসানকে মনে হলো চিন্তিত। সে ভাবছে।
দৃশ্য- ৩
আহসান কবির উঠবেন বসা অবস্থা থেকে। একবার তাকাবেন হাসান ও অবন্তীর বেডরুমের দিকে। মনে হবে তিনি দ্বিধাদ্বন্ধে আছেন ওদের বেডরুমের দিকে যাবেন কি না।
আহসান কবির হাসান ও অবন্তীর বেডরুমের দিকে গেলেন না। তার নিজের কক্ষেই গেলেন।
তার কক্ষের ডেস্কের উপরে, দেয়ালে দার্শনিক মিশেল ফুকো’র একটি ছবি। আহসান কবির কিছুক্ষণ ছবিটির দিকে তাকিয়ে রইলেন। এরপর গুণ গুণ করে গাইতে লাগলেন গানঃ
কিছুদিন মনে মনে
কিছুদিন মনে মনে ঘরের কোনে
শ্যামের পীরিত রাখ গোপনে
আহসান কবির তার কম্পিউটারে রাধা কৃষ্ণের ছবি সার্চ দিলেন। একটি ছবি প্রিন্ট আউট করে বের করলেন। ছবিটি বের করে তিনি মিশেল ফুকো’র ছবির উপরে রাধা কৃষ্ণের ছবিটি লাগিয়ে দিলেন।
লাগানোর সময় তিনি গাইলেন আস্তে আস্তে
ইশারায় কইবি কথা গোঠে মাঠে
দেখিস যেন কেউ না জানে
কেউ না বুঝে কেউ না শোনে
ছবিটি মিশেল ফুকো’র ছবির মুখে লাগিয়ে দেবার পর আহসান কবির ছবিটি দেখবেন তৃপ্তির সাথে। তিনি খুশি। খুশিমনেই তিনি বলে উঠবেন
কিছুদিন মনে মনে…
আহসান কবির তার বিছানায় গেলেন। একদৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন তিনি উপরের দিকে। এরপর হঠাৎ ঘুরে তাকালেন টেবিলের দিকে। ওখানে পাবলো নেরুদার একটি বই তার চোখে পড়ল।
আহসান কবিরঃ (চোখ বন্ধ করে।) কে আসে নিশিরাতে তোমারো শপনে।
Who was she who made love to you
in your dream, while you slept?
তিনি ঘুমিয়ে পড়লেন। তার মুখ হাসি হাসি। মনে হচ্ছে তিনি কোন সুখস্বপ্ন দেখছেন।
*ফুকোর ছবি- http://www.michel-foucault.com/gallery/pictures/foucault08.jpg
* রাধা কৃষ্ণ – https://s-media-cache-ak0.pinimg.com/originals/29/2d/36/292d36bbfc54e4afcf4a3de24a74c61f.jpg
এক্ট-২
দৃশ্য -১
সময়ঃ সকাল।
আহসান কবির বসে আছেন হাতে একটি খবরের কাগজ নিয়ে। খবরের কাগজের বিনোদন পাতা খোলা। এবং সেথায় একটি সেক্সি বলিউডি নায়িকার ছবি ও তৎস্লংশিষ্ট খবর।
আহসান কবিরের কানে আসছে পাশের রুম থেকে কথাবার্তা।
অবন্তীঃ দেখো, তোমাকে আজ তাড়াতাড়ি আসতেই হবে। আজ যদি আপার বাসায় না যাই তিনি খুবই মন খারাপ করবেন। আমাকে কয়েকবার ফোন করেছেন।
হাসানঃ চেষ্টা করব।
অবন্তীঃ চেষ্টা করব কী? স্পষ্ট করে বলো? তোমার এই ধরনের অস্পষ্ট কথাবার্তা আমার পছন্দ নয়।
হাসানঃ স্পষ্ট করে বলার কিছু নাই। আমি সর্বোচ্চ চেষ্টাটাই করতে পারি। কারণ কাজ শেষ না হলে আমার তাড়াতাড়ি আসা কোনমতেই সম্ভব না।
আহসান কবির পত্রিকা থেকে চোখ তুলে কান খাড়া করে শুনতে লাগলেন। তার মুখে হালকা হাসিও দেখা গেল।
দৃশ্য-২
পাশের ঘর। খাবার টেবিলে হাসান এবং অবন্তী। নাস্তা করতে করতে তারা কথা বলছে।
অবন্তীঃ এসব ব্যাপারে তোমার উদাসীনতা দেখে আমি আশ্চর্য হই।
হাসানঃ উদাসীনতা নয়। বিষয় হচ্ছে, আমার কাজ শেষ না হলে আমি তো তাড়াতাড়ি আসতে পারি না। সব কিছুর একটা নিয়ম আছে।
অবন্তীঃ কিন্তু… আমার বাসায় একা একা থাকতে…
হাসানঃ কেন? লোকটা তোমার সাথে কিছু করেছে?
অবন্তীঃ না, যা ভাবছো তা নয়। আস্তে বলো, পাশের রুমে আছে। শুনতে পাবে।
হাসানঃ আমাকে বলো আর কী করে আমি বাসায় না থাকলে?
অবন্তীঃ কিছু না…তবে…
হাসানঃ তবে কী?
অবন্তীঃ জানোই তো। উনার আগ্রহ একটু বেশীই।
আহসান কবির এসে প্রবেশ করলেন রুমে। তার হাতে একটি বই।
আহসান কবিরঃ কী ব্যাপার হাসান? এখনো অফিসে যাও নি?
হাসানঃ এই তো।
আহসান কবির অবন্তীর দিকে তাকিয়ে বললেনঃ সুপ্রভাত। কেমন আছো অবন্তী?
অবন্তীঃ ভালো। বসুন আমাদের সাথে। চা খান।
আহসান কবির টেবিলে বসতে বসতেঃ চা খাওয়া যায়। বিশেষত এই সুন্দর প্রভাতে, সুন্দরী কোন মেয়ের সাথে বসে চা খেতে আমার বরাবরই ভালো লাগে। একসময় প্রচুর খেয়েছি এমন। কিন্তু এখন আর কেউ নেই।
হাসানঃ আপনার লেখালেখি কেমন চলছে?
আহসান কবিরঃ চলছে ভালোই। আজ রাতে কি তোমাদের সময় হবে?
হাসানঃ কেন বলুন তো?
আহসান কবিরঃ দেরিদার ডিকন্সট্রাকশন নিয়ে একটা লেখা লিখছি। তা নিয়ে তোমাদের সাথে আলোচনা করা যায়। যদি তোমাদের সময় থাকে।
(অবন্তীর দিকে তাকিয়ে, হালকা হাসির সাথে) আছে কি?
হাসানঃ আসলে আমরা আজ বিকেলের দিকে একটা জায়গায় যাচ্ছি। ফিরতে রাত হতে পারে। তাই সম্ভবত আজ আপনার আলোচনা শোনা হচ্ছে না।
আহসান কবিরঃ সমস্যা নেই, সমস্যা নেই। আজ দিনের বেলায় তোমার কি সময় হবে অবন্তী?
অবন্তী কিছু বলার আগেই হাসান বললঃ না, ওর সময় হবে না। গুরুত্বপূর্ন কিছু কাজ আছে।
অবন্তীঃ হ্যাঁ, হ্যাঁ। আসলে সময় নেই ওরকম।
আহসান কবিরঃ সমস্যা নেই। কখন তোমার সময় হয় আমাকে বলো। আর আমরা তো একই ছাদের নিচে আছি। অবসর পেলেই কথা বলা যায়। কী বলো?
অবন্তীঃ (অস্বস্থির সাথে), হ্যাঁ। তা যায়।
হাসান খাওয়া শেষ করে উঠে দাঁড়াল।
হাসানঃ অবন্তী, আসো একটা কাজ আছে। আহসান সাহেব আপনি চা খান, আমরা আসছি।
হাসান চলে গেল তার বেডরুমে। অবন্তীও তার পিছু পিছু।
আহসান কবির চা খেতে খেতে, টেবিলে আঙ্গুল দিয়ে হালকা তাল দিতে দিতে গুন গুন করতে লাগলেন,
“কেন যামিনি না যেতে জাগালে না, বেলা হলো মোর লাজে।
শরমে জড়িত চরণে কেমনে চলিব পথেরি মাঝে।”
(ব্যাকগ্রাউন্ডে বাজতে পারে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া এই গান। )
দৃশ্য-৩
হাসান ও অবন্তী’র বেডরুম। হাসান বিরক্ত এবং ক্রুদ্ধ।
হাসানঃ এই লোক তো মহা বিরক্তিকর! আসার সময় কী গাইছিল শুনলে?
অবন্তীঃ হ্যাঁ, মনে হয় রবীন্দ্রসঙ্গীত, কেন কী হয়েছে?
হাসানঃ রবীন্দ্রসঙ্গীতই, এই গানকে দ্বিজেন্দ্রলাল রায় বলেছিলেন লাম্পট্য গীতি।
অবন্তীঃ তাই নাকী! তবে আমার খুব খারাপ মনে হয় না। লেখক মানুষ, বুড়ো হয়েছেন। একা একা থাকেন, তাই হয়ত কথা বলতে চান।
হাসানঃ কিন্তু লোকটার কথাবার্তার ধরন ভালো না। আমি আগেও লক্ষ্য করে দেখেছি। এই ধরনের বুড়াদের এক ধরনের পারভার্শন থাকে। আগেই বুঝা উচিত ছিল কেন পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে নতুন বিবাহীত ভাড়াটে খুঁজছে। এই বাসাটা ছেড়ে দিতে হবে।
অবন্তীঃ এত কম টাকায় এমন বাসা পাবে কোথাও?
হাসানঃ তা না পাই, কিন্তু এই লোককে সহ্য করা যায় না। তোমার সাথে ফ্লার্ট করতে চায়।
অবন্তীঃ (হেসে।) তাহলে প্রতিদিন তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরে এসো। তবেই লোকটা ফ্লার্ট করার সুযোগ পাবে না।
হাসানঃ হালকা ভাবে নিয়ো না। ওকে কাছে ঘেঁষতে দেবে না। কোন দরকার হলে সোজা আমাকে ফোন দেবে।
অবন্তীঃ ঠিক আছে। চিন্তা করো না। তুমি যেরকম ভাবছো ওইরকম খারাপ নন উনি। আমি ঠিকই ম্যানেজ করে নিতে পারব।
হাসানঃ ওকে। আর আমার আরো একটা প্ল্যান আছে। লোকটাকে বেশী বাড়তে দেয়া যাবে না। টাইট দেবার এখনই সময় মনে হচ্ছে।
অবন্তীঃ কী প্ল্যান? কীসের টাইট?
হাসানঃ সময় হোক দেখতে পাবে। আমি লোকটার ব্যাপারটা বুঝতে পারছি কিছুটা। সে কম টাকায় নিজের বাড়ি সাবলেট দিতে চেয়েছে নতুন বিবাহীতদের। এর একটি উদ্দেশ্য আছে। সাধারণত এইসব নতুন বিবাহীত ভাড়াটেদের বেশীরভাগই হয় বাড়ি থেকে পালিয়ে বিয়ে করা। ফলে তাদের আত্মীয় পরিজনদের সাথে সংযোগ থাকে না প্রথমদিকে। সুতরাং, টার্গেট হিসেবে এরা সহজ।
অবন্তীঃ ধুর! কী যে ভাবো না। কীসের টার্গেট?
হাসানঃ অত বড় কিছু না। যেমন, মার্ডার। খুন করার মত সাহস লোকটার হবে না। কিন্তু খুচরা লাম্পট্য চালিয়ে যেতে পারে।
অবন্তীঃ এছাড়া এমন কি হতে পারে না এটা তার লেখার কোন প্লটের জন্য?
হাসানঃ হতে পারে। তাই দুয়েক মাসের মধ্যে এই বাসাটা ছেড়ে দিতে হবে। অন্যের পরীক্ষার গিনিপিগ হওয়া বা লেখার সাবজেক্ট হওয়ার কোন মানে নেই। এই দুয়েক মাস নিরাপদে থাকার জন্য লোকটাকে একটু ভড়কে দিতে হবে।
অবন্তীঃ কীভাবে?
হাসানঃ (অল্প হেসে) তা সময় হলেই জানবে। আপাতত অফিসে যাই, দেরী হয়ে যাচ্ছে।
হাসান তার ফাইলগুলি ব্যাগে নিয়ে অফিসের উদ্দেশ্যে বের হলো বেডরুম থেকে। ডাইনিং রুমে খাবার টেবিলে এখনো বসে আছেন আহসান কবির। তিনি গুন গুন করছেন।
হাসান বাইরে গেল। অবন্তী দরজা বন্ধ করে আহসান সাহেবের দিকে একবার তাকিয়ে সামান্য হাসলো এবং চলে গেল ওর রুমে। আহসান কবির দেখলেন, কিন্তু কথা বললেন না। মনে হলো তিনি অন্য কোন ভাবনায় ডুবে আছেন।
এক্ট তিন
দৃশ্য-১
বিকাল। অবন্তী রান্নাঘরে কাজ করছে। রান্নাঘরের দরজায় হেলান দিয়ে তা দেখছেন আহসান কবির। তার হাতে একটি বই।
আহসান কবিরঃ (হঠাৎ করে বলে উঠবেন।) বি…উ…টিফুল!
অবন্তীঃ (অবাক হয়ে তাকিয়ে, এবং আহসান কবিরকে দেখে অল্প হেসে।) কী করছেন এখানে?
আহসান কবিরঃ তোমাকে দেখলাম অবন্তী। এই দিক থেকে, কাজের মধ্যে, একেবারে অসাধারন সুন্দর লাগল।
অবন্তীঃ (হেসে।) চা খাবেন?
আহসান কবিরঃ দিতে পারো। (তিনি রান্নাঘরের ভেতরে গেলেন। অবন্তীর কাছাকাছি।)
অবন্তীঃ আপনার লেখাটা কি শেষ হলো?
আহসান কবিরঃ হ্যাঁ, প্রায় শেষ।
অবন্তীঃ তাহলে ওটা নিয়ে আমাকে এখন বলতে পারেন।
আহসান কবিরঃ ব্যাপারটা হচ্ছে ডিকন্সট্রাকশন বুঝলে, আমরা যে লেখা দেখি তার আসলে নিজের কোন অর্থ নাই। তোমাকে এর আগে বেসিক একটা জিনিস বুঝতে হবে। সিগনিফায়েড আর সিগনিফায়ার। বুঝেছ?
অবন্তীঃ (অল্প হেসে। চা করতে করতে। বুঝা যাবে আহসান কবিরের কথা বুঝায় তার আগ্রহ নাই কিন্তু বলার ধরনে সে মজা পাচ্ছে।) জি, আপনি বলে যান।
আহসান কবিরঃ ধরো এই বইটা, একটু কাগজের বস্তু, যার নাম বই। এই বই শব্দটি বা ব এবং ই অক্ষর দ্বারা লেখাটি সিগনিফায়ার, আর এই লেখাটি যে চিন্তা বা আইডিয়া বা বস্তুটি বুঝাচ্ছে সিগনিফায়েড।
অবন্তীঃ (চা করতে করতে।) আচ্ছা।
আহসান কবিরঃ আমরা যে লেখি তা বিভিন্ন বর্ন দিয়ে। এগুলো সাইন। দেরিদার ডিকন্সট্রাকশন বলে যে, এগুলোর নির্দিষ্ট কোন অর্থ নেই। একেক পাঠে, একেক সময়ে একেক রকম অর্থ হতে পারে, একই লেখার। যেমন একটা হালকা উদাহরণ দেই। রবি ঠাকুরের গান আছে, ভেঙে মোর ঘরের চাবি নিয়ে যাবি কে আমারে। যখন তা লেখা হয়েছিল তখন এই প্রশ্ন স্বাভাবিক যে চাবি ভেঙ্গে কেউ কাউকে নিবে কীভাবে? কিন্তু আমরা বর্তমানের কন্টেক্সটে দেখলে এর ভিন্ন একটা অর্থ পাই। এখানে চাবি মানে পাসওয়ার্ড। ফলে একই লেখা সময়ের, অবস্থার বা পাঠের পরিবর্তনে ভিন্ন অর্থ নিতে পারে। বুঝলে?
অবন্তীঃ জি, বুঝেছি। (কাপ এগিয়ে দিয়ে।) এই চা নিন এবং খেয়ে দেখুন কেমন হলো।
আহসান কবিরঃ (চা তে চুমুক দিলেন।) অসাধারণ!
অবন্তীঃ (হেসে।) থ্যাংক ইউ।
আহসান কবিরঃ হাসান কোথায়?
অবন্তীঃ ঘরেই আছে, কী একটা করছিলো কম্পিউটারে।
আহসান কবিরঃ হাসানকে তোমার বিশ্বাস হয়?
অবন্তীঃ (কিছুটা অবাক হয়ে।) কেন হবে না? না হবার কী?
আহসান কবিরঃ অনেক কিছু আছে। হাজার হাজার বছরের পরিক্রমায় আমরা মানুষেরা এই জায়গায় এসেছি। এই দীর্ঘ সময়ে কিছু বৈশিষ্ট্য আমাদের মধ্যে যুক্ত হয়েছে। যেমন, রিপ্রোডাক্টিভ কারণে পুরুষ চরিত্রে বহুগামিতা। একসময় তা রিপ্রোডাক্টিভ এডভান্টেজ ছিল। তাই মানুষেরা, মানে আমরা টিকে আছি। বুঝলে, তাই হাসানকে বেশী বিশ্বাস করবে না, খেয়াল রাখবে।
অবন্তীঃ (অল্প হেসে।) খারাপ বলেন নি। এটা মনে রাখা যেতেই পারে।
আহসান কবিরঃ (দরজার দিকে তাকালেন। অল্পক্ষণ নিরব থেকে বললেন আস্তে করে।) হাসান দরজার পাশে দাঁড়িয়ে। যাই আমি।
অবন্তী কৌতুক এবং অবাক ভঙ্গিতে তাকাল আহসান কবিরের কথা শুনে।
আহসান কবির হেঁটে দরজার কাছে গেলেন।
তার হাতে তখনো চায়ের কাপ।
আহসান কবিরঃ (অবন্তীর দিকে ঘুরে।) তোমাকে যা বলছিলাম, এই চায়ের কাপ বস্তুটা সিগনিফায়েড, আর এর নাম যে চায়ের কাপ, তার লিখিত রূপ হবে সিগনিফায়ার।
(আহসান কবির হাত থেকে চায়ের কাপ ফেলে দিলেন। অর্ধেক চা ছিল তা ছলকে পড়বে। কাপ ভাঙবে।)
আর এটা বোধহয় ডিকন্সট্রাকশনের শুরু।
দৃশ্য- ২
আহসান কবির রুম থেকে বের হয়ে অল্প দূরেই পেলেন হাসানকে। মনে হলো সে আগে দরজার কাছেই ছিল। কাপ ভাঙ্গার শব্দ এবং আহসান কবির বেরিয়ে আসছেন দেখে একটু সরেছে।
আহসান কবিরঃ হাসান, তোমাকে একটা কথা বলি?
হাসানঃ (বিরক্তির সাথে।) বলুন।
আহসান কবিরঃ কোন কিছু হারানোর ভয়ে মানুষ অভার প্রটেক্টিভ হয়ে যায়। আর এই অতিরিক্ত আগলে রাখা প্রবণতার কারণে যাকে আগলে রাখতে চাইছে সে বিরক্ত বোধ করে, পরাধীন বোধ করে। এবং এই কারণে ইচ্ছে করেই দূরে সরে যায়। ফলে আলমেটলী ওভার প্রটেক্টিভ লোকটা যাকে হারানোর ভয় করে তাকে হারায়। নিজ কর্মদোষেই বলা যায়।
হাসানঃ কী বুঝাতে চাচ্ছেন আপনি?
আহসান কবিরঃ বুঝাতে চাচ্ছি যে অতিরিক্ত সন্দেহ এক প্রকার অসুখ। রোগটির নাম স্কিজোফ্রেনিয়া। তুমি সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে যেতে পারো। এন্টি সাইকোটিক ড্রাগ দেবে।
আহসান কবির মৃদু মৃদু হেসে ধীরে চলতে লাগলেন। হাসান কিছুক্ষণ দাঁড়াল এবং এরপর রান্নাঘরে গেল। আহসান কবির দাঁড়িয়ে গেলেন। তিনি যেন কান খাড়া করে শুনছেন ওদের কথাবার্তা।
হাসানঃ আমাকে এক কাপ চা দাও তো। লোকটা কেন এসেছিল?
অবন্তীঃ এমনি…
হাসানঃ (মেঝের দিকে তাকিয়ে।) কাপ ভাঙল কী করে?
অবন্তীঃ আহসান সাহেব হাত থেকে ফেলে দিয়েছেন। আচ্ছা, তুমি কি দরজার পাশে দাঁড়িয়ে ছিলে?
হাসানঃ তুমি ঐ লোকের কথা বিশ্বাস করো নাকী? আমি কেন এসে দাঁড়াব, আমি এইমাত্র এলাম, চা দাও।
অবন্তীঃ (হেসে।) দরজার পাশে না থাকলে কীভাবে জানলে উনি ওটা বলেছেন?
হাসান বিরক্ত ও বিব্রত হলো এবং রুম থেকে দ্রুত বেরিয়ে গেল।
সে গিয়ে দেখল অল্প দূরে আহসান কবির দাঁড়িয়ে রয়েছেন।
হাসানঃ (বেশ রাগান্বিত ভাবে এগিয়ে গিয়ে।) ব্যাপার কী আপনার?
আহসান কবির হাসানের দিকে তাকিয়ে মৃদু মৃদু হাসলেন ও আবার আস্তে আস্তে চলে যেতে লাগলেন। কোন কথা বললেন না।
হাসানঃ (ক্রুদ্ধ) কাপ ভেঙ্গেছেন ওটা পরিস্কার করবেন।
দৃশ্য- ৩
রান্নাঘর। সময় সন্ধ্যা।
আহসান কবির রান্নাঘরের মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ভাঙ্গা কাপের অংশগুলো জড়ো করছেন।
অবন্তীও এইসময় এসে প্রবেশ করল।
অবন্তীঃ আপনি এসব কেন করছেন? আমিই পরিস্কার করতাম।
আহসান কবির কাচগুলি নিয়ে ডাস্টবিনে ফেলতে লাগলেন, এবং ইচ্ছে করেই কাচ দিয়ে আঙ্গুল কেটে ফেললেন।
কাটা আঙ্গুল, টপ টপ রক্ত পড়ছে, তিনি ঘুরে দাঁড়ালেন।
অবন্তীঃ আরে! কী করেছেন আপনি, হাত তো কেটে ফেলেছেন!
আহসান কবির কেবল অবন্তীর দিকে তাকিয়ে রইলেন। তার তৎপরতার মধ্যেও তিনি সৌন্দর্য দেখছেন।
অবন্তীঃ (এগিয়ে এসে হাত ধরে কাটা জায়গা দেখার পর।) আসুন, ডেটল দিয়ে ধুয়ে ব্যান্ডেজ করে রাখতে হবে। চাপ দিয়ে ধরুন, রক্ত পড়া বন্ধ হবে।
আহসান কবিরকে নিয়ে অবন্তী বেরিয়ে এলো।
যে রুমে তারা এলো সেখানে হাসানও।
অবন্তীঃ (হাসানকে।) ঘরে ব্যান্ডেজ আছে?
হাসানঃ না নেই, কাটল কীভাবে?
অবন্তীঃ উনি কাচ সরাতে গিয়ে…
আহসান কবিরঃ আমি ব্যান্ডেজ আনছি।
আহসান কবির তার রুমে গেলেন। কিছু তুলা, ব্যান্ডেজ নিয়ে আসলেন।
অবন্তী তার হাত ডেটল দিয়ে ধুয়ে ব্যান্ডেজ করে দিতে থাকল।
আহসান কবির অবন্তীর দিকে তাকিয়ে ছিলেন। হাসানের দৃষ্টি এড়াল না।
ব্যান্ডেজ শেষ হলে অবন্তী বললঃ ব্যথা ট্যথা করলে আমাকে বলবেন। হয়ত এন্টিবায়োটিক খেতে হবে।
অবন্তী হাত বাঁধা শেষে তার রুমের দিকে গেল।
হাসানঃ (যেতে যেতে আহসান কবিরের দিকে তাকিয়ে, আস্তে করে।) সামান্য কেটেছে, ব্যান্ডেজও করতে পারেন না! স্যার, আপনি একটা জীবন্ত উৎপাত।
আহসান কবির তার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলেন। যেন তিনি তার প্রতিক্রিয়া উপভোগ করছেন।
এক্ট-৪
দৃশ্য-১
সময় রাত। আহসান কবির তার কক্ষে বসে বই পড়ছেন। তার কক্ষের একপাশে কিম্ভুত কিমাকার এক বিকট দর্শন পুতুল। কক্ষে রঙ তুলি, ছবি আঁকার স্ট্যান্ড, বই ইত্যাদি ছড়ানো আছে। হাসান একজন পুলিশের পোষাক পড়া লোককে নিয়ে প্রবেশ করলো।
হাসানঃ আহসান সাহেব, আমার এই বন্ধু হাসনাত পুলিশের ওসি হবার পরেও সাহিত্যের খপ্পর থেকে বের হতে পারে নি। এখনো নিয়মিত কবিতা লেখে। আপনার কথা বলতেই দেখা করতে চাইল। তাই নিয়ে আসলাম।
আহসান সাহেবঃ তাই নাকী! আসুন, বসুন।
ওসি হাসনাতঃ তা, একটু আধটু লেইখা থাকি আর কি। তবে ইদানীং আর কবিতা লেখতে পারি না। অপরাধ নিয়া কাজ করতে করতে হইছে কী, ক্রাইম ফিকশনের দিকে ঝুঁইকা গেছি। খুন, জখম, সুইসাইড, রেইপ। আপনিও তো ক্রাইম ফিকশন লেখছেন?
আহসান কবিরঃ হ্যাঁ, লিখেছি কিছু।
ওসি হাসনাতঃ এর কয়টা আমি পড়ছিলাম। ভালোই লেখছেন। ক্রাইমগুলা ভালোমত ফুটাইয়া তুলতে পারছেন। আমাদের দেশে তো হার্ড বয়েলড ক্রাইম ফিকশন তেমন হয় না। আর ক্রাইম ফিকশন তো কাজ করে মাইনশের জীবনের অন্ধকার দিক নিয়া, তাই সবাই এগুলি নিতেও পারে না। মানুষ তো হইলো এস্কেপিস্ট। পলায়নপর। জীবনের কঠিন বাস্তবতা থেকে খালি পলাইতে চায়। কী বলেন?
আহসান কবিরঃ হ্যাঁ, মানুষ সাধারনত এস্কেপিস্ট।
ওসি হাসনাতঃ কিন্তু দেশে ক্রাইম যে হয় না তা কিন্তু নয়। আমার অল্প কয়বছরের কর্মজীবনেই কত ধরনের অপরাধী দেইখা ফেললাম। শুনবেন নাকী একটা দুইটা কাহিনী, আপনার লেখার কাজে লাগলেও লাগতে পারে।
আহসান কবিরঃ (বিরক্তির সাথে) বলুন। শোনা যাক।
ওসি হাসনাতঃ আমি যেই বছর ওসি হিসেবে প্রথম কাজ করতে শুরু করি, সেই বছরই একটা সাইকো’রে পাকড়াও করতে হইছিল। বুড়ো পারভার্ট একটা মানসিক রোগী। একটা শপিং মলের মালিক ছিল। আর মহিলাদের কাপড় চেইঞ্জ করার রুমে ক্যামেরা লাগাইয়া রাখছিল হারামজাদা। এই ক্যামেরার সূত্র ধইরাই তার কাছে আমাদের যাইতে হয়। গিয়া আবিষ্কার করি সে এক ভয়াবহ খুনি। দুই দুইটা মেয়েরে খুন করছিল।
আহসান কবিরের মুখে স্পষ্ট বিরক্তির রেখা ফুটে উঠছে।
আহসান কবিরঃ ইন্টারেস্টিং ঘটনা।
ওসি হাসনাত চারিদিকে তাকিয়ে আহসান কবিরের কক্ষটি দেখতে লাগল।
ওসি হাসনাতঃ কবির সাহেব, আপনার আত্মীয় স্বজন কেউ কি আছেন নাকী?
আহসান কবিরঃ না, নেই। কেন বলুন তো?
ওসি হাসনাতঃ না, এমনিতেই জিজ্ঞেস করলাম। আপনার লেখা পড়েছি তাই একটু আগ্রহ আর কি। তাছাড়া যেহেতু আমার বন্ধু এবং বন্ধুপত্নী’র নিকট প্রতিবেশী আপনি, তাই এখন তো এক ধরনের আত্মীয় আমাদের। কী বলেন?
অবন্তী এই সময়ে ট্রে তে করে চা নিয়ে এলো। আহসান কবির মুগ্ধ এবং নির্লজ্জ্বে মত অবন্তীর দিকে তাকিয়ে রইলেন। তার মনে হলো বিরক্তিকর আলোচনা থেকে পাশ কাটিয়ে যাবার এ এক দারুণ উপায়।
হাসান ওসি হাসনাতকে তা দেখতে ইশারা করল। ওসি হাসনাত দেখল বিষয়টা।
ওসি হাসনাত একটু কাশির সাথে জিজ্ঞেস করলঃ তা কবির সাহেব, এইবার কী নিয়া কাজ করেন?
অবন্তীর হাত থেকে চায়ের কাপ নিতে নিতে আহসান কবিরঃ একটা প্রেমের গল্প। ত্রিভূজ প্রেম।
ওসি হাসনাতঃ বেশ! বেশ! ত্রিভূজ প্রেম আমার বড় ভালো লাগে। কেন বলেন তো?
আহসান কবির (ওসি হাসনাতের দিকে তাকিয়ে।)- কেন?
ওসি হাসনাতঃ কারণ ত্রিভূজ প্রেমের সাথে ক্রাইমের একটা সংযোগ থাকে। হা হা। প্রেম ও মৃত্যু যে কাছাকাছি দুইটা বিষয় টা ত্রিভূজ প্রেমেই বুঝা যায়। তাই এইটাই আমার প্রিয় প্রেম। আমাদের বাংলা ফিল্মে নায়করাজের ছেলে বাপ্পারাজ এমন কিছু ফিল্মে অভিনয় করছিলেন। বড়ই প্যাথেটিক। দেইখা দুঃখ পাইছিলাম একসময়।
অবন্তী চা দিয়ে চলে যাচ্ছিল।
আহসান কবিরঃ অবন্তী তুমিও বসো। আড্ডায় তোমার মত কেউ না থাকলে জমে না।
হাসান তার রাগ যেন দমিয়ে রাখল। হাসান, ওসি হাসনাত মুখ চাওয়াচাওয়ি করল।
অবন্তীঃ (হাসিমুখে।) চুলায় রান্না আছে। তাই এখন বসার সুযোগ নেই। আপনারা কথা বলুন। পরে আসব।
অবন্তী চলে গেল।
হাসানঃ আহসান সাহেব, এটা অনেকের প্রশ্ন যে আপনি বিয়ে করলেন না কেন। আসলেই এর কারনটা কী?
আহসান কবির হাসানের দিকে তাকালেন।
আহসান কবিরঃ বিয়ে করার মত, প্রেম করার মত কাউকে পাই নি এতদিন।
ওসি হাসনাতঃ তা এখন পাইছেন মনে হয়?
আহসান কবির (সামান্য হেসে)- হয়ত।
হাসান এবং ওসি হাসনাত আবার মুখ চাওয়াচাওয়ি করল।
অতঃপর হাসনাত বললঃ কবির সাহেব, হাসান আমার কলেজ লাইফ থেকে বন্ধু। একসাথেই আমরা চলাফেরা করছি। সে যখন অবন্তীরে প্রপোজ করে তখনো আমি ছিলাম সাথে। ইভেন তার বিয়ার সময় দুইজন স্বাক্ষীর একজন ছিলাম আমি। জানেন নিশ্চয়ই?
আহসান কবিরঃ (চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে) এটা আমার জানার কথা?
ওসি হাসনাতঃ (বিব্রত হয়ে।) না মানে…আপনার জানা থাকা দরকার, হয়ত কোন গল্প টল্প লেখলেন, তাতে আমিও থাকলাম, এইজন্যই বলা।
আহসান কবিরঃ এটা ঠিক বলেছেন আপনি। জানা থাকা দরকার।
ওসি হাসনাতঃ ঠিক তাই। গল্পে আমার ভূমিকাটা হইল নায়কের পুলিশ বন্ধু। বুঝতেই পারছেন ওদের কেউ ক্ষতি করতে চাইলে আমি তারে কী করব।
আহসান কবিরঃ স্পষ্ট বুঝতে পারছি। তবে আমার গল্পগুলোতে নায়কের বন্ধুরা শেষে দেখা যায় তার শত্রু। ত্রিভূজ প্রেমের এক বাহু।
ওসি হাসনাতঃ হা হা। এইটা তো খুব সাধারণ বিষয়। বন্ধু পত্নীর লগে প্রেম পিরীতি খুবই কমন কেইস। কিন্তু আমাদের ক্ষেত্রে সেইটা না কবির সাহেব।
আহসান কবিরঃ না হলেই ভালো। কিন্তু যেহেতু ক্রাইম ফিকশন নিয়ে ভাবি, তাই সহজে এমন কথা বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয় না।
ওসি হাসনাত একটু বিব্রত হলো।
ওসি হাসনাতঃ (চা খেতে খেতে।) আচ্ছা, কবির সাহেব, আপনি বাসায় কোন অস্ত্র রাখেন? নিরাপত্তার জন্য?
আহসান কবিরঃ কেন হঠাৎ এই প্রশ্ন?
ওসি হাসনাতঃ আপনি তো একা থাকেনই প্রায়। হাসানরাও তো সব সময় থাকবে না এইখানে। শহরে যেইরকম ডাকাতি বাড়তেছে। তাই জিজ্ঞেস করলাম আর কি। এইরকম একা যারা থাকেন তাদের নিরাপত্তার জন্য লাইসেন্সকৃত পিস্তল ইত্যাদি থাকলে ভালো হয়। কখন কী হয় বলা যায় না। নিজের নিরাপত্তার দিকটা খেয়ালে রাখা উচিত।
আহসান কবিরঃ হ্যাঁ, তা ঠিক বলেছেন। আমার একটা আছে পিস্তল। অনেক আগে নিয়েছিলাম। কখনো ব্যবহার করতে হয় নি।
দৃশ্য- ২
রাত। ছাদে আহসান কবির ও হাসান সিগারেট খাচ্ছেন।
আহসান কবিরঃ তোমাদের বন্ধুটি বেশ ভালো। আমুদে লোক।
হাসানঃ জি।
আহসান কবিরঃ তবে, আমার কেন জানি সন্দেহ হয়।
হাসানঃ কী সন্দেহ?
আহসান কবিরঃ ওসি হাসনাত, তোমাদের বন্ধুটি অবিবাহিত। আর লেখক হিসেবে আমার যে পর্যবেক্ষণী দৃষ্টি তাতে আজ একটা জিনিস বুঝলাম।
হাসানঃ কী?
আহসান কবিরঃ অবন্তীর প্রতি ওর দূর্বলতা আছে। অবশ্য অবন্তী যেরকম সুন্দরী মেয়ে তাতে অনেকেরই ওর প্রতি দূর্বলতা থাকতে পারে।
হাসানঃ আপনার পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা একেবারেই বাজে। ওর এরকম কিছুই নয়।
আহসান কবিরঃ তাও, আমি বলি কি, একটু চোখ কান খোলা রেখে দেখো, কিছুই বলা যায় না।
হাসানঃ আপনি একটা চালাক লোক। আপনি ভেবেছেন এগুলো বললে আমি ক্ষেপে যাবো? তা হচ্ছে না। বরং আমি আপনার প্রতিক্রিয়ায় মজা পাচ্ছি। বুঝাই যাচ্ছে আপনি ভয় পেয়েছেন।
আহসান কবিরঃ আমি কেবল আমার ধারণার কথা বললাম। আর ভয় পাবো কেন?
হাসান ধোঁয়া ছেড়ে, সিগারেট ফেলে দিয়ে, মৃদু হেসে চলে গেল।
দৃশ্য-৩
সময় রাত। অবন্তী ও হাসানের বেডরুম। তারা বিছানায়।
অবন্তীঃ আজ এটা কি ঠিক হলো? ভদ্রলোককে এভাবে হুমকি দেয়া?
হাসানঃ অবশ্যই। এর দরকার ছিল। তবে এতে লোকটার শিক্ষা হবে কি না বুঝতে পারছি না।
অবন্তীঃ আমার কিন্তু তাকে খারাপ মনে হয় না। লেখক মানুষ, এদের এরকম কিছু বৈশিষ্ট্য থাকে। তাই বলে এটা খারাপ না।
হাসানঃ লুইচ্চামি অবশ্যই খারাপ। তলস্তয় করলেও খারাপ, রবীন্দ্রনাথ করলেও খারাপ। এদের প্রশ্রয় দিলে মাথায় উঠবে।
অবন্তীঃ কী জানি!
হাসানঃ কী জানি না, এটাই সত্য। লুইচ্চামিকে এরা শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গেছে। আমার সামনে তোমার সাথে ফ্লার্ট করতে চায়। তার চোখমুখ দেখে আমি বুঝতে পারি। আরেকদিন দেখলে যে কী করব ঠিক নেই।
অবন্তীঃ তুমি প্যারানয়েড হয়ে যাচ্ছো উনাকে নিয়ে। যা করার মাথা ঠান্ডা রেখে করো।
হাসান বিছানার পাশের একটা ড্রয়ার খুলে একটি পিস্তল বের করল।
অবন্তীকে দেখিয়ে বললঃ এটা এই ড্রয়ারে থাকবে। কখনো যদি দরকার হয়…এই দেখো এভাবে আনলক করতে হয়…
অবন্তীঃ তুমি আসলেই প্যারানয়েড হয়ে যাচ্ছো।
হাসানঃ দেখো, এটা হাসনাতের কথায় রাখা। ডাকাতির ভয়ও আছে। নিরাপত্তার জন্য এমন জিনিস থাকা খারাপ কিছু না।
অবন্তীঃ আশ্চর্য! হাসনাত তোমাকে এই বুদ্ধি দিল!
অবন্তী পাশ ফিরে শুয়ে পড়ল।
হাসান পিস্তলটির দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। ম্যাগাজিন খুলে গুলি দেখল। সবক’টা গুলিই আছে। সে পিস্তলটি আবার ড্রয়ারে নিয়ে রাখল।
দৃশ্য -৪
আহসান কবির তার রুমে। তিনি ছবি আঁকছেন। তিনি গুণ গুণ করে গান গাচ্ছেন। সামনে থেকে দেখা যাচ্ছে অর্থাৎ ছবিটা দেখা যাচ্ছে না।
“যে গুনে বন্ধুরে পাবো, সে গুণ আমার নাই গো।
প্রাণ পাখি মনের আনন্দে, ঠেকেছে পিরীতের ফান্দে
তবে কেন নিরানন্দে, কেঁদে দিন কাটাই গো
যে গুণে বন্ধুরে পাবো, সে গুণ আমার নাই গো।”
(ব্যাকগ্রাউন্ডে কালা মিয়ার কন্ঠে শাহ আব্দুল করিমের এই গান বাজতে পারে।)
তুলি তুলে আহসান কবির তৃপ্তির সাথে মুগ্ধ হয়ে ছবিটি দেখতে লাগলেন। ক্যামেরা ছবির দিকে যাবে এবার। দেখা যাবে এটা অবন্তীর ছবি।
দৃশ্য – ৫
সকাল। ছাদ। আহসান কবির চিন্তিত মুখে ছাদে পায়চারী করছিলেন তখন দেখতে পেলেন পাশের ছাদে একটি লোক লুঙ্গি ও গেঞ্জি পরে দাঁড়িয়ে আছে।
আহসান কবিরঃ (লোকটিকে লক্ষ্য করে।) কী ব্যাপার রহিম মিয়া? আছো কেমন?
জলিলঃ স্যার, আমার নাম রহিম না, জলিল।
আহসান কবিরঃ ইয়েস! ইয়েস! কী খবর জলিল মিয়া?
জলিলঃ ভালো স্যার। আপনার কী খবর?
আহসান কবিরঃ আমারও ভালো। মফিজুল সাহেব কি বাসায় আছেন?
জলিলঃ না, স্যার বাসায় নাই। কক্সবাজার গেছেন।
আহসান কবিরঃ উনার বউ মিথিলা কি সাথে গেছেন?
জলিলঃ না, ম্যাডামের অফিস, তাই যান নাই। স্যার চলে আসবেন কাল পরশু।
আহসান কবিরঃ ঠিক আছে। তোমার স্যার চলে আসলে তাকে বলবে যে গল্প তাকে নিয়ে লেখব বলেছিলাম তা শেষ হয়েছে। গল্পটির নাম দেয়া হয়েছে মাউগা মফিজ। নামটা কেমন হলো বলো তো?
জলিল অপ্রস্তুত হয়ে গেল। সে বেশ সন্দেহজনক দৃষ্টিতে আহসান কবিরের দিকে তাকাল এবং এরপর নিচে নেমে গেল।
আহসান কবির মজা পেয়ে হাসলেন। তিনি হাঁটতে হাঁটতে হাসিমুখে টোকন ঠাকুরের কবিতা বলছিলেন।
দিনের ফেরারী বন্ধু
রাতের জুয়াড়ী, ব্রাদার
আমিও পড়ে, গেলাম,
প্রেমে; পরস্ত্রীঃ রাধার
এক্ট-৫
দৃশ্য-১
বিকাল। ছাঁদ। আহসান কবির সাহেব রেলিং ধরে তাকিয়ে আছেন উপরের দিকে। হাসান এলো সিগারেট এর বাক্স হাতে নিয়ে।
সে একপাশে গিয়ে সিগারেট ধরাল।
আহসান কবির তাকে দেখে এগিয়ে এলেন।
আহসান কবিরঃ কী খবর হাসান? ভালো আছো?
হাসানঃ (ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে।) জ্বি ভালো।
আহসান কবিরঃ একটা সিগারেট হবে তোমার কাছে? ছেড়ে দিয়েছিলাম কিন্তু তোমায় খেতে দেখে আবার ইচ্ছে হচ্ছে, দুয়েকটা টান দেই, কী বলো?
হাসানঃ কাল রাতেই দেখলাম খেলেন। ছাড়লেন কবে?
হাসান সিগারেটের প্যাকেট এবং লাইটার এগিয়ে দিল।
আহসান কবিরঃ কাল রাতেই ছেড়ে দিয়েছিলাম।
আহসান কবির সিগারেট ধরালেন ও ধোঁয়া ছাড়লেন।
আহসান কবিরঃ বুঝলে হাসান, মেয়েমানুষ হচ্ছে বহুত ক্রিটিক্যাল প্রানী।
হাসান কোন উত্তর দিল না। সে আগের মতই ধুমপান করতে লাগল। আহসান কবির তার দিকে তাকালেন।
আহসান কবিরঃ কী? আমার কথা বিশ্বাস হচ্ছে না? আমি বাংলা সাহিত্যের বড় লেখক আহসান কবির বলছি এই কথা। পুরা বাংলায় কয়টা লোক আছে এমন আমার মতো মানব সাইকোলজি বুঝে? বিশ্ব লিটারেচারেই বা এমন কয়টা লোক আছে, আমার আগে মাত্র একজন সাহিত্যিক মানব সাইকোলজি বুঝতে পেরেছিলেন, ফিওদর দস্তয়ভস্কি।
হাসান কোন কথা বলল না।
আহসান কবিরঃ শুধু পড়ালেখায় নয়, পর্যবেক্ষণ এবং অভিজ্ঞতার মাধ্যমে আমি এই সিদ্ধান্তে এসেছি। গতকাল তোমার বন্ধু, কী যেন নাম ছিল ভদ্রলোকের?
হাসানঃ হাসনাত।
আহসান কবিরঃ হ্যাঁ, ওই ওসি হাসনাত সাহেবের সাথে যখন কথাবার্তা বলছিলাম তখন তুমি হঠাৎ প্রশ্ন করে বসলে আমি কেন বিয়ে করি নি। এ নিয়ে ইন্টারভিউতেও অনেকে প্রশ্ন করে থাকে। কিন্তু সেদিন আমি তোমাকে যা উত্তর দিয়েছিলাম তা ঠিক নয়। মিথ্যা। আসলে আমি প্রেম করেছিলাম। একটা নয়, কয়েকটা।
হাসানঃ (অন্যদিকে তাকিয়ে থেকেই।) তা আপনাকে দেখেই বুঝা যায়।
আহসান কবিরঃ তাই নাকী! হা হা। তবে যাই বলো, প্রেমগুলি আমাকে একটি শিক্ষা দিয়েছে। জানবে সেটা কী?
হাসানঃ কী?
আহসান কবিরঃ আসল প্রেম বলতে কিছু নেই। মানুষ যখন নতুন প্রেমে পড়ে ওটাই তার কাছে আসল প্রেম। কিন্তু সেই সময়ে বাকীগুলি নকল প্রেম হয়ে যায় না। সব প্রেমই একটি অন্যটির চাইতে আলাদা। বৈচিত্রময়। টিনেজ বয়সের প্রেম, মধ্য বয়সের প্রেম, বুড়ো বয়সের প্রেম, সবগুলাই মহান।
হাসানঃ এসব আপনার প্রেমের উপন্যাসে চলে। বাস্তবে চলে না।
আহসান কবিরঃ এই কী কথা বললে তুমি হাসান? তুমি নিজেই প্রেম করে বিয়ে করেছ। অন্তত তোমার মুখে প্রেমবিরোধী কথা মানায় না। তা যা বলছিলাম, রমনী ক্যারেক্টার হচ্ছে বহুত ক্রিটিক্যাল, এটাই আমার পয়েন্ট। এ ব্যাপারে তোমার দ্বিমত আছে কি?
হাসানঃ আমার এ ব্যাপারে কোন মত নেই।
আহসান কবিরঃ তাহলে বলি শুনো। আমি একবার একটা প্রেম করেছিলাম। তখন ধরো আমি মধ্য যৌবনে। আমার যিনি প্রেমিকা ছিলেন, তিনিও একই বয়সের প্রায়। তো উনি কী করতেন, প্রায়ই আমাকে এসে বলতেন পাড়ার একটি ছেলে তাকে প্রেমপত্র দিয়েছে, কলেজের একজন শিক্ষক তার দিকে অন্যভাবে তাকিয়েছে ইত্যাদি নানা কিছু। আমি তো শুনতে শুনতে প্রায়ই ঈর্ষান্বিত হয়ে উঠতাম। উনার সাথে আমার প্রেম টিকেছিল তিন বছর। এটাই আমার দীর্ঘতম প্রেম। এরপর আমি যে কয়টা প্রেম করেছি, সব খানেই দেখি একই ব্যাপার। প্রেমিকা আমাকে বলেন, বুঝাতে চান অন্য কতো ছেলেরা তার জন্য পাগল। এগুলি দেখতে দেখতে আমি বুঝতে পারলাম আসলে ঐ কথাগুলি সত্য ছিল না। প্রেমিকারা গুরুত্ব চান, মিথ্যা গুরুত্ব তৈরী করার জন্যই তারা এমন করতেন। রমনীরা এমনই ক্রিটিক্যাল।
হাসানঃ হয়ত।
আহসান কবিরঃ তবে আমার এসব বলা হয়ত ঠিক হয় নি। এজন্যই আমি আমার প্রেমিকাদের নিয়ে কিছু বলতে চাই না। একজন ভদ্রলোক কখনো তার পূর্বের প্রেমিকাদের নিয়ে খারাপ কিছু বলেন না।
হাসানঃ (তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে এবং আহসান সাহেবের দিকে তাকিয়ে।) আপনি কি ভদ্রলোক?
আহসান কবিরঃ আমার তো তাই মনে হয়।
হাসানঃ বেশ।
আহসান কবিরঃ কিন্তু আমার অবজার্ভেশনটা হলো, মহিলারা বা মেয়েরা মিথ্যা গুরুত্ব তৈরী করার জন্য স্বামী বা প্রেমিকের কাছে বলেন অন্য লোকেরা তাদের প্রতি আকৃষ্ট। যেমন, একটা উদাহরণ দেই। ধরো অবন্তী বললো আমি ওর দিকে অন্যরকম ভাবে তাকাই, অন্যরকমভাবে কথা বলতে চেষ্টা করি, এটা দ্বারা তুমি কী বুঝবে?
হাসানঃ কী বুঝবো?
আহসান কবিরঃ বুঝবে যে তুমি ওকে ঠিকমত সময় দিচ্ছ না। ও তোমার কাছে আরো গুরুত্ব ও সময় চায়। তবে স্বামীদের ক্ষেত্রে এখানে একটি ডিলেমা তথা উভয়সংকট আছে?
হাসানঃ কী রকম?
আহসান কবিরঃ ধরো স্বামী বেশী সময় দিচ্ছে না স্ত্রীকে। সে কাজ করছে। কাজ করছে টাকার জন্য। তার স্ত্রী তার কাছে সময় ও গুরুত্ব চাচ্ছে। এখন সে যদি কাজে সময় কম দিয়ে স্ত্রীকে সময় দেয়, তাহলে স্ত্রী আপাতত খুশি হবে ঠিক কিন্তু তার রোজগার কমে যাবে। আর আরেকটা ব্যাপার তো জানোই মেয়েরা গরীব প্রেমিক মেনে নিতে পারে হয়ত কিন্তু গরীব স্বামী অত সহজে মানতে পারে না। ফলে স্বামী বেচারাকে কাজে বেশী সময় দিতেই হয়। ঠিক কি না?
হাসানঃ (সিগারেট ফেলে।) এসব থিওরী আপনার প্রেমের উপন্যাসে দিন।
আহসান কবিরঃ (হেসে) তা তো দেবোই, কিন্তু তোমাকে আমার একটা প্রশ্ন করার আছে। প্রশ্নটা নিয়ে আমি ভাবছি। কিন্তু উত্তর মেলাতে পারছি না।
হাসানঃ কী প্রশ্ন?
আহসান কবিরঃ ধরো কেউ কাউকে ভালোবাসে, তাহলে সে ঐ মানুষটাকে ভালোবাসে না ঐ মানুষটার বিশেষ বৈশিষ্ট্য বা গুণ, যেমন সৌন্দর্য, বুদ্ধিমত্তা এগুলিকে ভালোবাসে? ভালোবাসা আসলে কোন জায়গায় থাকে?
হাসানঃ আমি বলতে পারব না। আমি আপনার মত এত জটিল করে ভাবি না। জটিল করে ভাবলে সব জিনিসই জটিল। এবং কোন জিনিস জটিল করায় কোন মাহাত্ম্য নেই।
আহসান কবিরঃ (হেসে) সে না থাকুক, কিন্তু আমার প্রশ্নটা তুমি খেয়াল করেছো তো? গুরুত্বপূর্ন প্রশ্ন কিন্তু। ধরো তুমি যে অবন্তীকে ভালোবাসো তা কী অবন্তী মানুষটাকে, না ওর রূপ, সৌন্দর্য, বুদ্ধিমত্তা ইত্যাদি গুনগুলিকে ভালোবাসো? কোনটা?
হাসানঃ (বিরক্ত এবং অল্প রাগান্বিত হয়ে।) দেখুন আহসান সাহেব, হতে পারেন আপনি একজন বড় লেখক, কিন্তু আপনার কথাবার্তা, আচরণ আসলেই বিরক্তিকর। আপনি অবন্তীকে নিয়ে আর কোন কথা বলবেন না।
হাসান হেটে চলে গেল। আহসান কবির হালকা হেসে আবার তাকালেন আকাশের দিকে।
আহসান কবির হাসানের চলে যাওয়া দেখলেন। অল্প হাসলেন।
দৃশ্য-২
সিগারেটে শেষ টান দিয়ে ফেলে দেবার সময় তিনি দেখতে পেলেন পাশের ছাঁদ থেকে একটি লোক তার দিকে তাকিয়ে আছে। লোকটির পরনে লুঙ্গি ও গেঞ্জি। পাশের বাসার কাজের লোক, জলিল। ছাঁদে শুকাতে দেয়া কাপড় সে নিয়ে যেতে এসেছিল, সেজন্য তার হাতে কয়েকটি শুকনো কাপড়।
আহসান কবিরঃ (লোকটার দিকে তাকিয়ে।) এই তোমার নাম করিম না?
জলিলঃ জি না স্যার। জলিল, আব্দুল জলিল।
আহসান কবিরঃ (ওদিকে এগিয়ে যেতে যেতে।) হ্যাঁ, আব্দুল জলিল।
লোকটা ওপাশের ছাঁদে কিছুটা পেছনে ফিরে গেল। যেন সে আহসান কবিরকে ভয় পাচ্ছে। এর চিহ্ন তার মুখেও ফুটে উঠছে।
আহসান কবিরঃ তুমি আমাকে ভয় পাও নাকি?
জলিলঃ জি না স্যার।
আহসান কবিরঃ ভয় পাবে না, ভয় পাওয়ার কিছু নেই। আমি নিরীহ একজন লেখক। লেখকের কামড়ে বিষ থাকে না। থাকে কি?
জলিলঃ না স্যার।
আহসান কবিরঃ তোমাকে আজ কিছু গুরুত্বপূর্ন কথা বলব। তোমার কোন আপত্তি আছে?
জলিলঃ না স্যার, বলেন।
আহসান কবিরঃ বুঝলে জলিল, মানুষকে কঠিন সত্য বললে সে তা পছন্দ করে না। একটু আগে আমি যার সাথে কথা বললাম, সবই তো দেখলে শুনলে, তোমার কি মনে হয় আমি ভুল বলেছি?
জলিলঃ (লুকিয়ে কথা শোনে ধরা পড়ার ভয়, লজ্জ্বা এবং এক ধরনের ভ্যাবাচেকা ভীতি’র সাথে।) জি না স্যার। আপনি ঠিক বলেছেন।
আহসান কবিরঃ তাহলে এখন আরেকটি কঠিন সত্য কথা বলি শুনো। ছোটলোকের বাচ্চারাই অন্যদের কথা লুকিয়ে শুনে মজা পায়।
জলিলের মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেল।
আহসান কবির তা উপভোগ করলেন।
জলিল দ্রুত দড়িতে ঝুলানো বাকী কয়টা শুকনো কাপড় নিয়ে নিচে চলে গেল। আহসান কবির আপন মনে হাসলেন নিঃশব্দে।
অল্পক্ষণ পরে তিনি আবৃত্তি করতে লাগলেন ভাস্কর চক্রবর্তী’র কবিতা, ক্যামেরায় তখন শেষ বিকেলের আকাশ।
প্রতিটা বিপদ থেকে আমাকে মোহন সিং বাঁচায় নিমেষে
বলেঃ লেখো তুমি। – আমি লিখি। আমি
তোমাকে আমাকে লিখি পারুলের কথা লিখি
এক্ট-৬
দৃশ্য-১
সময় সন্ধ্যারাত। আহসান কবির তার কক্ষে, নিজের আঁকা ছবিটি দেখছিলেন। এর মধ্যে অবন্তী এসে প্রবেশ করল।
আহসান কবিরঃ (হাসিমুখে।) তুমি এসেছো, এই দেখো ছবিটি।
অবন্তী দেখল এবং অবাক হয়ে গেল।
অবন্তীঃ অসাধারন হয়েছে! আপনি যে এতো ভালো ছবি আঁকেন তা আসলেই জানতাম না।
আহসান কবিরঃ অনেকদিন আঁকি নি। তোমাকে দেখে আবার নতুন করে আঁকতে ইচ্ছে হলো। তোমার সৌন্দর্য আমার ভেতরটাকে আবার সজীব করে দিয়েছে।
অবন্তীঃ (ছবিটা দেখতে দেখতে।) এই ছবিটা কি আমাকে গিফট করবেন?
আহসান কবিরঃ তুমি নিতে পারো। হাসান কোথায়?
অবন্তীঃ একটু বাইরে গেছে। ফিরে আসবে।
আহসান কবিরঃ ঠিক আছে, তোমাকে তাহলে আমার নতুন লেখাটা নিয়ে বলি। বসো এখানে।
অবন্তী খাটে বসল। আহসান কবির চেয়ার টেনে বসলেন।
আহসান কবিরঃ আমার নতুন লেখাটা হচ্ছে প্রেমতত্ত্ব নিয়ে। প্রেম কী আসলে, প্রেম কী কেবল স্বামী স্ত্রী’র মধ্যে হয়? তাছাড়া একবার প্রেম হলে কী আর হওয়া যাবে না?
অবন্তী মনে হলো মজা পাচ্ছে।
অবন্তীঃ না, তা কেন হবে। আপনার তত্ত্বটা কী?
আহসান কবিরঃ তত্ত্বটা হচ্ছে, (চেয়ার ছেড়ে গিয়ে অবন্তীর পায়ের কাছে বসলেন। তিনি অবন্তীর একটি হাত নিজের দু’হাতের ভেতরে নিলেন। অবন্তী অবাক হলো কিন্তু বাঁধা দিল না।) বহু পুরনো। যেমন, মধ্যযুগের বৈষ্ণব কবি চণ্ডীদাস বলেছেন, “আমার বাহির দুয়ারে কপাট লেগেছে, ভিতর দুয়ার খোলা।” “তোরা পর পতি সনে, শয়নে স্বপনে সতত করিবি নেহা। তোরা সিনান করিবি, নীড় না ছুঁইবি, ভাবিনি ভাবের লেহা। কহে চণ্ডীদাস এমত হইলে, তবে ত পিরীতি সাজে।” বুঝেছ ব্যাপারটা? লেহা মানে হচ্ছে প্রেম, আর কার সাথে? পর পতি সনে।
দরজায় এসে দাঁড়াল হাসান। সে দাঁড়িয়ে দেখছে।
আহসান কবির দু’হাতের ভেতরে অবন্তী’র হাত ধরে আছেন। হাসান যে এসে দাঁড়িয়েছে ওদিকে অবন্তী বা আহসান কবির কারোরই লক্ষ নেই।
আহসান কবিরঃ তাছাড়া রাধারমণের গানে শুনো নাই? আমারে আসিবার কথা কইয়া, মান করে রাই রইয়াছো ঘুমাইয়া। এখানে যে গল্প, কৃষ্ণ রাধারে উদ্দেশ্য করে বললেন, রাধা কিন্তু এখানে পরস্ত্রী, বুঝেছো ব্যাপারটা? এটাই আসলে প্রেম।
হাসান খুব দ্রুত কক্ষে প্রবেশ করে।
হাসানঃ (প্রায় চিৎকার করে, উত্তেজিত হয়ে।) কী হচ্ছে এখানে?
অবন্তী হাত ছাড়িয়ে নিতে চাইল। কিন্তু আহসান কবির হাত ধরেই আছেন।
হাসানঃ (আহসান কবিরের দিকে তাকিয়ে।) হাত ছাড়েন!
হাসান আহসান কবিরকে প্রায় ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল।
হাসানঃ (অনুচ্চ স্বরে বলল।) হারামজাদা, এখানে প্রেমতত্ত্ব শেখানো হচ্ছে!
অবন্তীঃ এই কী করছো? থামো!
হাসানঃ বুড়া ভামটাকে চড়িয়ে দাঁত ফেলে দেয়া উচিত। হারামজাদা!
হাসান আহসান কবিরের কলার ধরতে যায়।
অবন্তী হাতে ধরে হাসানকে আটকায়।
আহসান কবির কোন কথা বলেন না। বসে থাকেন মেঝেতে।
হাসানের চোখ যায় আহসান কবিরের আঁকা ছবির দিকে।
সে গিয়ে ছবিটা স্ট্যান্ড থেকে ছাড়িয়ে আনে।
হাসানঃ (আহসান কবিরকে) তুই আমার বউয়ের ছবি কেন এঁকেছিস? বুড়া, লুইচ্চা; তোরে পুলিশে দেয়া উচিত। এই ছবি এটা তুই এখন পুড়িয়ে ফেলবি।
অবন্তীঃ (আটকাতে গিয়ে।) কী করছো, উনি…
হাসানঃ (অবন্তীর দিকে ফিরে।) তুমি চুপ থাকো। বুড়া হাত ধরে বসে আছে, আর তুমি ওর কথা শুনছো, আশ্চর্য!
আহসান কবির অবাক দৃষ্টিতে ওদের কথা দেখছেন।
হাসানঃ (আহসান কবিরের দিকে তাকিয়ে।) আমি কী বলছি? এটা এখনই পুড়িয়ে ফেলবি। আর কালই আমরা এ বাসা ছেড়ে চলে যাবো।
আহসান কবির ছবিটা হাতে নিলেন। হাসান তার হাতে লাইটার ধরিয়ে দিল।
আহসান কবির ছবিটিতে আগুন জ্বালালেন। ছবিটি অর্ধেক জ্বলে পড়ে গেল।
ছবির জ্বলা দেখাতে দেখাতে এই দৃশ্যের সমাপ্তি।
দৃশ্য-২
আহসান কবিরের কক্ষের মেঝেতে আধপোড়া অবন্তীর ছবিটা পড়ে আছে। আহসান কবির মেঝেতে শুয়ে আছেন।
তার চারপাশ ঝাপসা হয়ে আসছে। একটি বিদ্রুপের হাসি যেন আসছে তার কানে। দু হাত দিয়ে তিনি তার কান চেপে আছেন।
বিদ্রুপের হাসি দেখানোর সময়, দেখানো হবে ফ্রয়েড, দেরিদা, ফুকো, জিজেক, লাকা’র ছবি। যেন এইসব দার্শনিকেরা আহসান কবিরকে নিয়ে হাসছেন।
আহসান কবিরের অনুশোচনা, ও অপরাধবোধ বুঝাতে এই দৃশ্যের অবতাড়না।
যন্ত্রনাকাতর ও বিধ্বস্ত আহসান কবিরকে দেখাতে দেখাতেই এই দৃশ্যের সমাপ্তি।
[*এই দৃশ্যে বিদ্রুপের হাসি দেখানোর কালে হিচককের ভার্টিগো ফিল্মে জিমি স্টিওয়ার্টের দুঃস্বপ্নের কথা স্মরণ করা যায়। এই দৃশ্য আহসান কবিরের অপরাধবোধ এবং মানসিক অসুস্থতা বুঝাতে।]
ফ্রয়েড- http://www.alternet.org/sites/default/files/story_images/1024px-sigmund_freud_1926-edited.jpg
দেরিদা – http://blog.lareviewofbooks.org/wp-content/uploads/2014/10/larb-blog-derrida.jpg
ফুকো – http://www.critical-theory.com/wp-content/uploads/2014/11/foucault-graffiti-672×340.jpg
লাকা – http://www.eric-marie-psycho-social.com/medias/album/jacques-lacan.jpg
দৃশ্য-৩
ঘড়ি রাত তিনটা। ড্রয়িং রুমে হাসানের লাশ পড়ে আছে। তার মাথায় গুলি লেগেছে। তার পাশে বসে লাশটি নিরীক্ষণ করছেন আহসান কবির। তার এক হাতে পিস্তল।
অবন্তীঃ হাসান! হাসান! এত রাতে কোথায় গেলে?
আহসান কবিরকে দেখে অবন্তী দাঁড়াল। দেখে বুঝা গেল সে ঘুম থেকে উঠে এসেছে।
অবন্তীঃ আহসান সাহেব, হাসানকে দেখেছেন? হঠাৎ দেখি ও রুমে নেই।
তারপরই ওর চোখ গেল মেঝেতে এবং হাসানের লাশ দেখে সে বিকট চিৎকার দিয়ে উঠল।
অবন্তীঃ এটা আপনি কী করেছেন আহসান সাহেব? আপনি হাসানকে খুন করে ফেলেছেন!
আহসান কবিরঃ বিশ্বাস করো আমি হাসানকে খুন করি নি। আমি জেগেই ছিলাম, হঠাৎ ধপাস করে কিছু পড়ার শব্দ হলো। সাথে সাথে আমার পিস্তলটা নিয়ে এখানে এসে দেখি হাসান এভাবে পড়ে আছে।
অবন্তীর চোখ গেল আহসান সাহেবের পিস্তলের দিকে।
অবন্তীঃ (কেঁদে) এটা আপনি কী করলেন?
আহসান কবিরঃ (উঠে) বিশ্বাস করো আমি…(হাত নেড়ে বুঝাতে গিয়েছিলেন তিনি, উত্তেজনায় ট্রিগারে চাপ পড়ে একটা গুলি বেরিয়ে গেল। গিয়ে লাগল টিভি পর্দায়।)
অবন্তী ভয়ে চিৎকার করে দৌড়ে তার রুমে চলে গেল এবং ভিতর থেকে দরজা বন্ধ করে দিল।
আহসান কবিরঃ অবন্তী! অবন্তী! আমার কথা শুনো, বিশ্বাস করো। আমি হাসানকে খুন করি নি।
আহসান কবির দরজায় গিয়ে ধাক্কাতে লাগলেন।
ভিতরে ভীত অবন্তী ফোন দিল ওসি হাসনাতকে।
(ফোনে) অবন্তীঃ হাসনাত, আহসান সাহেব হাসানকে একটু আগে খুন করে ফেলেছেন। আমাকেও মেরে ফেলবেন। আমাকে বাঁচাও।
ওসি হাসনাতঃ দরজা বন্ধ কইরা থাকো। আমি এখনই আসতেছি।
আহসান কবির দরজা ধাক্কাতে ধাক্কাতে ওদের কথা শুনলেন।
তিনি দরজার ওপাশে থেকেই অবন্তীকে বুঝানোর চেষ্টা করতে থাকলেন।
এর অল্পক্ষণ পরেই কলিংবেল বাজল।
আহসান কবির গিয়ে দরজা খুললেন।
বাইরে থেকে ওসি হাসনাতঃ হ্যান্ডস আপ। চালাকি করার চেষ্টা কইরেন না কবির সাহেব।
আহসান কবিরঃ আমার চালাকি করার কিছুই নেই। আমি খুন করি নি। আপনি নির্দিদ্ধায় আসতে পারেন ও আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারেন। আমি খুন করেছি প্রমান করতে পারলে আমাকে ধরে নিয়ে যাবেন। হিসাব সোজা।
ওসি হাসনাত ভিতরে প্রবেশ করল।
ওসি হাসনাতঃ ঠিক আছে।
ভিতরে প্রবেশ করে মেঝেতে পড়ে থাকা হাসানের লাশটা দেখল ওসি হাসনাত।
ওসি হাসনাতঃ অবন্তী কই?
আহসান কবিরঃ অবন্তী আমাকে মিছেমিছি ভয় পেয়ে নিজের ঘরে দরজা বন্ধ করে রয়েছে।
ওসি হাসনাতঃ ঠিক আছে। আমি ওরে এখানে নিয়া আসতেছি। আপনি সোফায় গিয়া বসেন।
আহসান কবিরঃ ঠিক আছে।
একটু পর ওসি হাসনাত ভীত অবন্তীকে নিয়ে এলো।
ওসি হাসনাতঃ (অবন্তীকে বলছিলো।) ভয় পাইও না। পুলিশ চইলা আসছে। নাথিং টু ওয়ারি।
ওসি হাসনাত বসল সোফায়, অবন্তী তার পাশে। অন্যদিকে আহসান কবির। মাঝখানে মেঝেতে হাসানের লাশ।
ওসি হাসনাতঃ (আহসান কবিরকে।) আপনি খুন করেন নাই বলছেন?
আহসান কবিরঃ অবশ্যই না। আমি জেগে ছিলাম, হঠাৎ এখানে শব্দ শুনে এসে দেখি এই অবস্থা। এর সাথে আমার বিন্দুমাত্র কোন সম্পর্ক নেই।
ওসি হাসনাতঃ কিন্তু আইজ রাইতেই হাসানের সাথে আপনার ঝামেলা হইছিল। হাসান আপনারে অপমান করছিল। তারা কাইলই এই বাসা ছাইড়া দিত। হাসান আমারে ফোন দিয়াও বলছিলো রাইতে এইসব কথা।
আহসান কবিরঃ হ্যাঁ হয়েছিল। কিন্তু তার মানে এই না যে আমি ওকে খুন করব। হাসান আমার অনেক প্রিয় ছিল। সন্তানের মতো।
ওসি হাসনাতঃ কেমন প্রিয় ছিল তা তো আমি জানতাম। দেখুন কবির সাহেব, চালাকি কইরেন না। বহু ঘাগু মাল ধরছি আমি, এই ওসি হাসনাত। এই বাড়িতে আপনারা তিনজন মানুষ। অবন্তী ঘুমাইয়া ছিলো, আর বাকী রইলেন আপনি। এছাড়া আর কে খুন করতে পারে, বলেন আমারে?
আহসান কবিরঃ কে খুন করতে পারে তা আমার জানার বিষয় নয়। এটা বের করা আপনার কাজ। আমি শুধু বলছি আমি খুন করি নি।
ওসি হাসনাতঃ তার মানে আপনি বলতে চাইতেছেন অবন্তী খুন করছে?
আহসান কবিরঃ আমি কিছুই বলতে চাচ্ছি না। কিন্তু এর সম্ভাব্যতা উড়িয়ে দেবার মত কি?
ওসি হাসনাতঃ না, তবে যে পিস্তল থেকে গুলি বাইর হইছে এইটা কার পিস্তল তা জানলেই তো আমাদের হইয়া যায়, তাই না লেখক ও দার্শনিক মিস্টার আহসান কবির?
আহসান কবিরঃ চেক করে দেখুন। ঘরে তো দু’টা পিস্তল আছে। দেখুন কারটা থেকে গুলি বেরুলো।
ওসি হাসনাতঃ অন্য পিস্তলটি’র খবর আপনি জানলেন ক্যামনে?
আহসান কবিরঃ তা আপনাকে জানাতে আমি বাধ্য নই।
ওসি হাসনাতঃ ওকে ঠিক আছে। এই দেখেন সেই পিস্তল।
সে একটি পিস্তল বের করে দেখাল।
ওসি হাসনাতঃ অবন্তীরে বইলা এইটা আমি নিয়া আসছি। আমিই এটা রাখতে বলছিলাম হাসানকে। কিন্তু দেখেন এইটা এখনো লক করা আছে।
আহসান কবিরঃ গুলি ছোড়ার পরে লক করা যায় না নাকী?
ওসি হাসনাত ম্যাগাজিন খুলে দেখাল। এবং দেখা গেল গুলি চারটা আছে, একটা নেই।
বিস্ফোরিত নেত্রে অবন্তীর দিকে তাকাল। তারপর আহসান কবিরের দিকে। তাকে অল্প চিন্তিত মনে হলো।
ওসি হাসনাতঃ (অবন্তীকে) বিষয়টা কী? একটা গুলি কই গেল?
অবন্তীঃ (কান্নাজড়িত কন্ঠে।) আমি কিছুই জানি না।
আহসান কবিরের মুখে ক্রুর হাসি দেখা গেল।
ওসি হাসনাতঃ (আহসান কবিরের দিকে তাকিয়ে।) ঠিক আছে। এবার আপনার পিস্তলটা আমারে দেখান।
আহসান কবিরঃ আমারটাতে একটি গুলি এমনিতেই কম আছে, কারণ আজ হাত ফসকে একটা বেরিয়ে গিয়েছিল, গিয়ে লেগেছে ঐ টিভি পর্দায়, প্রমাণ আছে। তাছাড়া অবন্তীও তা দেখেছে।
ওসি হাসনাতঃ ঠিক আছে। আপনার পিস্তল আমারে দেখান।
আহসান কবিরঃ আমার পিস্তল আমার রুমে আছে।
ওসি হাসনাতঃ ওকে, নিয়া আসেন। চালাকি কইরেন না। আপনি বুদ্ধিমান লোক, নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন চালাকি কইরা কোন লাভ নেই। বাইরে পুলিশের গাড়ি দাঁড়াইয়া আছে।
আহসান কবির হেঁটে তার রুমের দরজার ভেতর দিয়ে তার রুমে চলে গেলেন।
এরপর তার পিস্তলটা নিয়ে বেরিয়ে এলেন। এসে সোফার পাশে দাঁড়িয়ে।
আহসান কবিরঃ এই আমার পিস্তল।
ওসি হাসনাতঃ (হাত বাড়িয়ে) আমারে দেখতে দেন।
কথা শেষ হবার আগেই আহসান কবির গুলি করলেন পুলিশ অফিসার হাসনাতকে।
হাসনাত লুটিয়ে পড়ল।
ঘটনার আকস্মিকতায় অবন্তী চমকে উঠল। এবং চিৎকার দিল ভয়ে।
অবন্তী সোফায় হাসনাতের পাশে পড়ে থাকা পিস্তলটি নিয়ে দ্রুত গুলি ছুঁড়ল। আহসান কবিরের গায়ে না লেগে তা গিয়ে লাগলো পিছনের দেয়াল ঘড়িতে। কাঁচ ভেঙে গেল।
পরক্ষণেই আহসান কবির অবন্তীকে লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়লেন। অবন্তীর গায়ে লাগলো গুলি, সে লুটিয়ে পড়ল।
কয়েক মুহুর্ত পরে হেঁটে হেঁটে আহসান কবির গেলেন মৃতদেহগুলির পাশে। তিনি মেঝেতে বসলেন নিচু হয়ে। অবন্তীর মৃতদেহের দিকে তাকালেন, এরপর হাসানের মৃতদেহের দিকে।
আহসান কবিরঃ (অপ্রকৃতিস্থের মত) ভালোবাসা! আহা! ভালোবাসা!
তার এবং তাহার ভালোবাসা (অবন্তী এবং হাসানকে দেখিয়ে, হাতের পিস্তল দিয়ে।)
কিন্তু যখন তারাই চলে যায়, তখন ভালোবাসা যায় কোথায়?
আহসান কবিরকে বিভ্রান্ত দেখাল।
তিনি উঠলেন এবং হেটে তার রুমের দিকে চললেন। যাওয়ার সময় বিড়বিড় করতে লাগলেনঃ
Love, love, his and hers,
if they’ve gone, where did they go?
তিনি রুমে প্রবেশ করলেন। তার রুমের ভেতরটা দেখানো হবে না। দরজা দিয়ে যাওয়াটাই দেখানো হবে। একটু পর ভিতরে একটা গুলির শব্দ শোনা যাবে।
দৃশ্য -৪
টিভি পর্দা দেখানো হবে। যেখানে রাতে গুলি লেগেছিল। গুলির চিহ্ন সেখানে রয়েছে, কাচ ভাঙা।
ঘড়িতে সকাল এগারোটা বাজে। সেই ঘড়িটাই দেখানো হবে যেটাতে অবন্তীর গুলি লেগেছিল। তা ঠিকঠাকই আছে। গুলির আঘাত লেগেছে এমন কোন চিহ্ন নেই।
আহসান কবিরের ঘরের দরজা দিয়ে বের হলেন একজন পুলিশের লোক। নেমপ্লেট শফিউর রহমান।
আহসান সাহেবের বাড়ির সামনে পুলিশের গাড়ি, সাংবাদিক এবং মানুষ।
টিভিতে সাংবাদিকেরা বলছেন, “আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন লেখক ও দার্শনিক আহসান কবির আজ রাতে নিজ বাড়িতে মারা গেছেন। মাথায় বুলেটবিদ্ধ লাশ পাওয়া গেছে। পুলিশ এখনো কিছু জানান নি।”
পুলিশের বড় অফিসার, যিনি আহসান কবিরের রুমের দরজা দিয়ে বের হয়েছিলেন তিনি বের হতেই সাংবাদিকেরা তাকে ঘিরে ধরলেন।
একজন সাংবাদিকঃ লেখক আহসান কবিরের এই মৃত্যুটা সম্পর্কে পুলিশের প্রাথমিক ধারণা কী?
পুলিশ অফিসার শফিউর রহমানঃ প্রাথমিক আলামতে মনে হচ্ছে এটা সুইসাইড। লেখক দীর্ঘদিন ধরে তীব্র সিজোফ্রেনিয়ায় ভুগছিলেন। আগেও তিনি সাইকোটিক এপিসোড অর্থাৎ বাস্তবতা এবং কল্পনার পার্থক্য করতে না পারার মত অবস্থায় চলে গিয়েছিলেন কয়েকবার। গতকাল শেষরাতের দিকে প্রতিবেশীরা বেশ কিছু গুলির শব্দ পেয়েছিলেন। দিনের বেলায় কোন সাড়াশব্দ নেই দেখে তাদের আরো সন্দেহ হয়। আমরা সকালে এসে মূল দরজা ভেঙ্গেই ঘরে প্রবেশ করি। আহসান কবির তার নিজ রুমে মৃত অবস্থায় পড়ে ছিলেন। মাথায় বুলেটবিদ্ধ এবং এক হাতে তার পিস্তলটি ছিল। এই বাড়িতে তিনি একাই থাকতেন। তাই এটা খুব সম্ভবত আত্মহত্যা।
সাংবাদিকঃ উনার কোন লেখা ইত্যাদি কি পাওয়া গেছে?
পুলিশ অফিসারঃ হ্যাঁ, একটা অর্ধেক লেখা গল্প, “ত্রিভূজ প্রেম” পাওয়া গেছে। অসম্পূর্ন গল্পটির শেষ পাতায় লেখা আছে, “সবাইকে আমিই খুন করেছি। আমি অপরাধী।” লেখাটি আপাতত তদন্তের আয়তায় আছে। এছাড়া একটি আধপোড়া ছবি পাওয়া গেছে তার রুম থেকে।
সাংবাদিকেরা আরো প্রশ্ন করতে চাইলেন। কিন্তু পুলিশ অফিসার সেগুলিতে কান না দিয়ে গাড়িতে গিয়ে উঠলেন। গাড়ি চলতে লাগল।
দৃশ্য-৫
টিভি রিপোর্টারদের সামনে আব্দুল জলিলকে দেখা গেল। সে বেশ পরিপাটি হয়ে এসেছে, তাকে টিভিতে দেখাবে এজন্য সে উৎফুল্ল। সাংবাদিকদের মাইকের সামনে সে কথা বলছে।
আব্দুল জলিলঃ আমি সেইদিনও দেখছি স্যার ছাদের উপরে একলা একলা কথা বলেন আর হাসেন। আমি ভয় পাইয়া যাই……এমন ঘটনা……
-শেষ-