অনলাইনে লেখাযুক্ত যেসব স্টার্টআপ আছে বাইরে যেমন বাজফীড বা ক্র্যাকড ইত্যাদি, এরকম বাংলাদেশেও শুরু হয়েছে। বাংলা ভাষাভাষী মানুষেরা দিন দিন ইন্টারনেট ব্যবহারে অভ্যস্ত হচ্ছেন। ফলে এ ধরণের ব্যবসা উদ্যোগের সম্ভাবনা তৈরী হয়েছে।
এবং আগামীতে বিভিন্ন ক্ষুদ্র মাঝারি ব্যবসা তাদের নীশ অনুযায়ী কন্টেন্ট দিয়ে তাদের সাইট সাজাবে।
এখনো বাংলাদেশে বেশীরভাগ আর্টিকেল সাইটে ট্রাফিক প্রায় সাইটই পায় ফেইসবুক থেকে। সোশ্যাল মিডিয়া ট্রাফিক সার্চ র্যাংকিং এর জন্যও ভালো, যদিও সোশ্যাল মিডিয়া লিংক নো-ফলো তথাপি সার্চ ইঞ্জিনকে সোশ্যাল ট্রাফিক ভালো সিগনালই দেয়।
সোশ্যাল মিডিয়ায় কেন লোকে কন্টেন্ট শেয়ার করে এটা জানা থাকা কন্টেন্টযুক্ত ওয়েবসাইটের জন্য দরকারি।
এক
কোন কন্টেন্ট মানুষ শেয়ার করে সোশ্যাল মিডিয়ায়, সেই কন্টেন্ট অসাধারণ এইজন্য না। এটা হয়ত হয়, কিন্তু খুবই কম। মূলত মানুষ শেয়ার করে নিজের আইডেন্টিটি প্রকাশ ও প্রচারের জন্য। যেমন, একজন ফিলোসফি পছন্দ করেন। ফিলোসফি নিয়ে বোরড পান্ডার এক পোস্ট তিনি শেয়ার করলেন, এখানে তার মূল উদ্দেশ্য নিজের আইডেন্টিটি প্রচার ও প্রকাশ করা।
দুই
ফেইসবুকে মানুষের যে নেটওয়ার্ক থাকে তাতে দুই ধরণের টাই থাকে মানুষে মানুষে। স্ট্রং টাই আর উইক টাই। স্ট্রং টাই বা বন্ধন চার পাঁচজন বন্ধুর সাথে গড়ে যাদের সাথে নিয়মিত দেখা হয়। কিন্তু বাকিদের সাথে থাকে উইক টাই। এই উইক টাই এ থাকা লোকজন ঐ ব্যক্তিকে সেইভাবে কাছ থেকে চিনে না, যেরকম স্ট্রং টাই এর বন্ধুরা চিনে। এজন্য মূলত ফেইসবুকে কন্টেন্ট শেয়ার মানুষ করে থাকে উইক টাই এর কাছে নিজের আত্মপরিচয়কে আরো বর্ধিত করার জন্য।
রেফারেন্সঃ [Coursera MOOC: Viral Marketing and How to Craft Contagious Content, University of Pennsylvania, The Wharton School , Taught by Jonah Berger. Week 4, Video 5: Social Ties and Active Sharing.]
তিন
ক্যাপিটালিজমের এই স্তরে এসে কনজিউমারের আইডেন্টিটি প্রকাশ টার্গেট করেই পণ্য ডিজাইন হয়। এইজন্য এপলের বিজ্ঞাপনে পণ্যের চাইতে ভোক্তাকে ও ভোক্তার আইডেন্টিটিকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছিল।
লিংক-১-ব্রেইনওয়াশড মানুষেরা যারা লেকচার শুনছে, আর দুই, প্রাণবন্ত মহিলাটি যে এগিয়ে এসে হাতুরি ছুঁড়ে মারল। এপল তার ব্যবহারকারীদের এই মহিলার রূপকে চিত্রায়িত করেছে আর বাকীদের ব্রেইনওয়াশড প্রায় রোবট।
(সমাজতত্ত্বের ক্লাসিক রিসার্চঃ মানুষকে সহজেই দুইভাগ করে ফেলা যায়, এবং কারণ ছাড়াই মানুষ গ্রুপের প্রতি বিশ্বস্ত হয়ে উঠে দ্রুতই। স্টিভ জবস এই টেকনিক ব্যবহার করে ভাগ করে মার্কেটিং করেছেন। তবে আমার পয়েন্ট এখানে এরকম গ্রুপ মার্কেটিং না, পয়েন্ট হলো পণ্যের চাইতে ভোক্তার আইডেন্টিটি গুরুত্বপূর্ন তা বলা। রিসার্চ পেপারের লিংক।)
চার
ডিজিটাল মিডিয়ায় এমন আইডেন্টিটি দরকার মানুষের। কারণ এখন মানুষ আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে আছে যাকে ক্রিটিক্যাল থিওরীতে স্কিজোফ্রেনিয়া বলে। ক্লিনিক্যাল রোগটি নয়। স্কিজোফ্রেনিয়া বলতে এখানে তার কোন আইডেন্টিটি নেই, এবং স্কিজোফ্রেনিয়া রোগীর মতো ভাঙ্গা ভাঙ্গা আইডেন্টিটি, প্রতিনিয়ত সে তৈরী করে নিচ্ছে বা করতে চায় এমন।
পাঁচ
এই আইডেন্টিটি বা উইক ইগো খুব সহজে তৈরী করতে পারে ডিজিটাল মিডিয়া। আর্টিকেলযুক্ত স্টার্ট আপের কাজ হয় সোজা কথায় তার পাঠকদের আইডেন্টিটি দেয়া। যদি সে তা দিতে পারে তাহলে তার কন্টেন্ট সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচুর শেয়ার হবে। মানুষ শেয়ার করবে নিজের গরজে।
ছয়
পাঠককে আত্মপরিচয় বা আইডেন্টিটি দিতে বা পাঠকের অনলাইন আইডেন্টিটির সম্প্রসারনে সাহায্য করতে কন্টেন্টগুলিতে সরাসরি পাঠককে যুক্ত করতে হবে। যেমন, উদাহরণ ২৫ টি লক্ষণ বলে দেয় আপনি কখনো মেসে থেকেছেন, এই হাড়কাপানো শীতে ২৫ টি মিম বলে দেবে আপনার অবস্থা, এই দশটি লক্ষণ মিলে গেলে আপনার দার্শনিক চিন্তাশক্তি রয়েছে, ইত্যাদি ইত্যাদি। সব কন্টেন্ট না হলেও অন্তত ৩০/৪০ ভাগ এমন কন্টেন্ট দরকার যা কোনভাবে পাঠকের আইডেন্টিটি প্রচারে সাহায্য করে। কন্টেন্ট তৈরীর সময় ভাবতে হবে কীভাবে এতে পাঠকের আত্মপরিচয়কে যুক্ত করা যায়।
সাত
বাজফীড মূলত এই ফিলোসফির উপর দাঁড়িয়ে। বাজফীডের ফাউন্ডার জোনাহ পারেতির ১৯৯৬ সালে প্রকাশিত একাডেমিক আর্টিকেলে এমন বিষয় নিয়ে লেখা ছিল। লিংক। ক্যাপিটালিজমের আধুনিক পর্যায়ে এসে মানুষের আইডেন্টিটিই ক্রাইসিসের মূলে, এর থিওরিস্ট জেমসন এবং ফ্রেঞ্চ কালচারাল থিওরিস্ট দ্যেলুজ ও গাতারি।
শেষকথা
সব কন্টেন্ট এর সাইট মাত্রই যে এভাবে আইডেন্টিটি দিয়ে নিজেদের আইডেন্টিটি তৈরী করে বা করবে তা নয়। যেমন, এই সাইট, বা এই সাইটের মতো ওয়েবসাইট যার প্রধান ফোকাস ভাইরাল হওয়া নয়। এনালিটিক ওয়েবসাইটগুলির এর প্রয়োজনীয়তা নেই।
কিন্তু ব্যবসা-উদ্যোগ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত কন্টেন্ট সাইটগুলি, যারা পপুলার ডিজিটাল মিডিয়া হতে চায় তারা এই টেকনিক ব্যবহার করবে বা করতে পারে। অন্য ধরণের ডিজিটাল মিডিয়া, যেমন এপ ইত্যাদি, এবং ডিজিটাল বিজ্ঞাপনও এভাবে ভোক্তার আইডেন্টিটি টার্গেট করে কাজ করতে পারে অনলাইন মাধ্যমে। সম্প্রতি কোকাকোলার নিঁখোজ শব্দের খোঁজে নামক বিজ্ঞাপন ক্যাম্পেইনটির ব্যাপারে আপনি হয়ত জানতে পেরেছেন আপনার ফেইসবুক ফ্রেন্ডলিস্টের কোন একজনের শেয়ারের মাধ্যমে।
কোকাকোলার এই ডিজিটাল অবদান সনদ আপনি বুঝতেই পারছেন ফালতু, যিনি শেয়ার করছেন তিনিও বুঝতে পারছেন ফালতু, তথাপি এটি তার আইডেন্টিটি বর্ধিত করছে। প্রচার করছে যে তিনি একটি শব্দের অর্থ যোগ করেছেন, এবং এরকম আরো অনেক শব্দ তিনি জানেন। এই যে পরিচয় বা উইক ইগো তা সহজেই এক অবদান সনদের মাধ্যমে ভোক্তার মধ্যে তৈরী করতে পারছে কোকাকোলা। এজন্য তাদের বলতে হচ্ছে না লোকদের বার বার শেয়ার করার জন্য। লোকেরা নিজেদের ইগো বা পরিচয় প্রকাশের জন্য নিজের গরজেই শেয়ার করছে।
কোকাকোলা যে বিজ্ঞাপন ক্যাম্পেইন করে প্রচুর টাকা খরচ করে, তারা চাইলেই হারিয়ে যাওয়া বাংলা শব্দাবলীর অধিকাংশই লোক নিয়োগ দিয়ে যোগ করে ফেলতে পারতো। কিন্তু, এটা না করে তারা ভোক্তাকে অংশগ্রহণের সুযোগ দিয়েছে, ও তাদের উইক ইগো তৈরীতে সাহায্য করেছে, যাতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তিনি নিজের সেই ইগো প্রচার করেন ও সেই ওছিলায় কোকাকোলা নিজের প্রচারটা পায়।
এভাবেই ডিজিটাল মিডিয়া ডিজিটাল মানুষদের ব্যবহার করে, ডিজিটালি গড়ে উঠে।