মুরাদুল ইসলাম » ভূ-রাজনীতি ও ইতিহাস » ভারতে ইংরাজ কোম্পানির উত্থানের পেছনে নৈরাজ্য ও ভাগ্যের হাত

ভারতে ইংরাজ কোম্পানির উত্থানের পেছনে নৈরাজ্য ও ভাগ্যের হাত

ঐতিহাসিক উইলিয়াম ডালরিম্পল ১৫৯৯ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রতিষ্ঠা থেকে শুরু করে ১৮০৩ সাল পর্যন্ত এর বিস্ময়কর উত্থানের এবং ভারতীয় উপমহাদেশে আধিপত্য বিস্তারের ইতিহাস লিখেছেন তার নতুন বই দি এনার্কিঃ দি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি, কর্পোরেট ভায়োলেন্স এন্ড পিলেজ অব এন এম্পায়ার’তে।

সাধারণত তিনি যেসব উৎস বেশি ব্যবহার করা হয় নি এমন উৎস থেকে তথ্য নিয়ে তার ব্যাখ্যা উপস্থাপন করেন, এই বইতেও তার ব্যতিক্রম হয় নি।

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বড় হওয়া, এবং উপমহাদেশে কর্তৃত্ব বিস্তারের কারণ হিসেবে তিনি মূলত এনার্কি বা নৈরাজ্যকে উপস্থাপন করেন। এর জন্য বইয়ের নাম দি এনার্কি।

প্রথমত ডালরিম্পল দাবী করেন মুগল সাম্রাজ্যের পতনের শুরুয়াত হয় আওরঙ্গজেব তথা বাদশা আলমগীরের হাত ধরে। অরাঙজেবের রাজত্ব কাল ১৬৫৮ থেকে ১৭০৭। এই সময়ে মুগল সাম্রাজ্য সর্বাধিক বিস্তৃত হয় যুদ্ধ বিগ্রহের মাধ্যমে। এই সেনাশক্তির অধিক বৃদ্ধি একটি বড় সাম্রাজ্যের পতন ডেকে আনে, সেই ক্লাসিক পথেই হেঁটেছে মোগল সাম্রাজ্য। যখন আলমগীর মারা গেলেন তখন এই বড় সাম্রাজ্যকে শাসন করার মত কেউ ছিল না।

শুরু হয় ক্ষমতা দখল নিয়ে মারামারি। স্থানীয় রাজারা এই সময়ে কেন্দ্রের দূর্বলতার সুযোগ নিয়ে কর দেয়া বন্ধ করে দেন। স্বাধীনতা ঘোষনা করেন। পথে ঘাটে বেড়ে যায় ডাকাতি।

১৭১৯ সালে ময়ুর সিংহাসন হাত বদল হলো চারবার! মুগল ঐতিহাসিক খইর উদ্দিন ইলাহাবাদীর মতেই, এইসময়ে ঐশ্বর্যময় সাম্রাজ্যটি পরিণত হলো নৈরাজ্যের লীলাভূমিতে।

১৭৩৭ সাল,  দুই মিলিয়ন লোকের বাস তখন দিল্লীতে। তখনো ঐশ্বর্যে দিল্লী অতুলনীয়। ভগ্নপ্রায় সাম্রাজ্যের বুকে লোভনীয় অলঙ্কার।

১৭৩৯ সালে ইরানের নাদির শাহের আক্রমণ হয়। সম্রাটকে রাতের খাবারে ডেকে নিয়ে গিয়ে বন্দি করা হলো। ৫৭ দিল চললো হত্যাযজ্ঞ।

এরপর, ৭০০ হাতি, ৪০০০ উট, ১২০০০ ঘোড়ায় টানা ওয়াগন ছুটল ইরানে। এগুলি পূর্ণ ছিল স্বর্ণ, রৌপ্য, ও অন্যান্য মূল্যবান পাথরাদিতে।

ডালরিম্পলের মতে, এই সময় মুগলদের পরে ভারতে সবচেয়ে শক্তিশালী সেনাবাহিনী ছিল মারাঠাদের।

মারাঠারা বাংলা আক্রমণ করলো। যেই মারাঠাদের বন্দনা করতে করতে বাঙালী সাহিত্যিকেরা হিন্দুত্মবাদী জাতি গঠনের স্বপ্ন দেখেছেন পরে।

বাংলা তখন সবচাইয়ে সমৃদ্ধ প্রদেশ। মারাঠারা আক্রমণ করে হত্যা, লুট, ধর্ষণ করেছিল প্রায় ৪০০,০০০ মানুষকে।

মারাঠাদের ভয়ে লোকেরা জনপদের সবচাইতে নিরাপদ স্থানে চলে গেল, এবং সেটি ছিল ইস্ট ইন্ডিয়া  কোম্পানির এলাকা।

বাংলার জন্য মারাঠাদের আক্রমণ ছিল বিভীষিকাময়, কিন্তু এটাই কোম্পানির জন্য লাভজনক হয়ে উঠল। কোম্পানির এলাকায় ইংরাজ সাম্রাজ্যের দক্ষ যোদ্ধারা (মাসকিটারস) ছিলেন নিরাপত্তার জন্য, তাই মারাঠারা পেরে উঠত না।

এছাড়া, এলাকাটিকে আক্রমণ থেকে রক্ষার জন্য কোম্পানি খাল বা পরিখা খনন করেছিল, তাই সহসা আক্রমন সহজ ছিল না।

এলাকাটির আকার তিনগুণ বেড়ে গেল এক দশকে। জন্ম নিল কলকাতা শহর।

শুধু নিরাপত্তা নয়, কলকাতা ছিল একেবারে প্রথমদিকের চার্টার সিটির উদাহরণ। ইংরাজ কমার্শিয়াল আইন, ও কমার্শিয়াল কন্ট্রাক্ট ইত্যাদি আইনে চলায় ব্যবসার স্বর্গ রাজ্যে পরিণত হয় এবং কেবল বাংলা নয়, পার্সি, গুজরাতি, মারওয়ারি ইত্যাদি জাতের ব্যবসায়ীরা ভীড় জমান এখানে।

ডালরিম্পল বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজকে ভালো বলেন নি। তাকে সাইকোটিক রেপিস্ট নামে আখ্যায়িত করেছেন। সিরাজ গঙ্গা নদীতে নৌকা ডুবিয়ে দিয়ে ভ্রমনকারীদের ডুবে যাওয়া এবং আহাজারী দেখে মজা পেতেন এই নবাব। এই সিরাজের অযোগ্যতা ইংরাজ কোম্পানির আরেক সৌভাগ্য নিয়ে আসে।

তবে, হয়ত তার অযোগ্যতা নিয়েও সিরাজ টিকে যেতেন যদি না তার ব্যাংকার জগতশেঠদের সাথে বিবাদে না জড়াতেন। এটাই তার কাল হয়েছিল। জগতশেঠেরা ক্লাইভের সাথে হাত মেলালেই সিরাজের পতন সূচিত হয়, যা বাস্তবায়িত হয় পলাশির প্রান্তরে।

কোম্পানির উত্থানে ভাগ্যের হাত অনেক। যেমন শেষ মুগল সম্রাট শাহ আলমকে দিল্লী থেকে বিতারিত করে আফগানি, পারসিয়ান ও মারাঠিদের এক যৌথশক্তি। পরে অনেক বছর ঘুরে বেরিয়ে,  তিনি সেনা সংগ্রহ করে প্রায় দিল্লী দখল করে নিয়েছিলেন। কিন্তু পালকপুত্র গোলাম কাদিরের হাতে নির্মম ও আকস্মিক ভাবে খুন হন তিনি। এই পুত্র ছিল জিবিতা খানের, একে শাহ আলম দত্তক নিয়েছিলেন ১৬ বছর আগে জিবিতা খানকে যুদ্ধে হারিয়ে।

এরপরে, ১৮০৩ সালে মারাঠারাও ইংরাজ কোম্পানিকে হারাতে পারতো। কিন্তু তাদের ভিতরেও দ্বন্দ্ব ছিল অনেক। তুকজি হলকার ও দৌলত রায় সিন্ধিয়ার মধ্যে বিরোধ থাকা স্বত্ত্বেও তারা এক হয়েছিলেন ইংরাজ কোম্পানির বিরুদ্ধে। এই সময়ে সিন্ধিয়া একটা চিঠি পাঠান পেশোয়া বালাজি রাওকে, যে ইংরাজদের সরানোর পর আমরা হলকারকেও দেখে নেব। ইংরাজ কোম্পানির হস্তগত হয় এই চিঠি। তারা এটি হলকারের কাছে পৌছে দেয়।

কোম্পানি তার সৈন্যদের বেশি বেতন দিত। ফলে ভালো সৈন্যরা তাদের সাথে যোগ দিয়েছিল। কোম্পানির ল্যান্ড রেভিনিউ ছিল, ছিল মহাজন এবং ব্যাংকারদের সমর্থন। সুতরাং, অর্থনৈতিক শক্তিতে তারা শক্তিশালী ছিল। তারা দ্রুত অর্থনৈতিক শক্তি সংগ্রহ ও স্থানান্তর করতে পারতো, এবং এটাই তাদের অন্যদের চাইতে এগিয়ে রাখে।

 

  প্রাসঙ্গিকঃ পলাশীর যুদ্ধ ও দুনিয়ার জটিল সমীকরণ 

Leave a Comment

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

×
গুরুত্বপূর্ণ
Scroll to Top
বই মডেলিং