অবচেতনের নিয়ন্ত্রণ- এনিমি

জ্যাক গিলেনহাল অভিনীত এনিমি মুভিটি পরিচালনা করেছেন ডেনিস ভিলেন্যুব। নোবেল বিজয়ী পর্তুগিজ লেখক হোসে সামারাগো’র উপন্যাস “ডাবল” এর উপর ভিত্তি করে এই ফিল্ম নির্মিত। লেখক সামারাগোর বয়স যখন তিন বছর যখন সামরিক বাহিনী পর্তুগালের সরকার হটিয়ে ক্ষমতা দখন করে নেয়। এরপর ৪৮ বছর ফ্যাসিস্ট শাসন ব্যবস্থায় থাকতে হয় দেশটিকে। বিভিন্ন ধরনের রূপকের মাধ্যমে সামারাগো তার উপন্যাসগুলো লিখেছেন। টোটালিটারিয়ান শাসন ব্যবস্থার সমালোচনা অনেক সময় উঠে এসেছে তার লেখায়।

jose samarago

এনিমি ফিল্মে ইতিহাসের শিক্ষক এডামকে (জ্যাক গিলেনহাল) তার ক্লাসে ফিল্মের শুরুর দিকে টোটালিটারিয়ান শাসন ব্যবস্থা নিয়ে বলতে দেখা যায় –

“নিয়ন্ত্রণ, এর সব কিছুর মূলে নিয়ন্ত্রণ। প্রতিটি স্বৈরশাসকের একটা অবসেশন থাকে, এবং এটা হলো এই নিয়ন্ত্রণ। প্রাচীন রোমে তারা লোকদের খাদ্য এবং সার্কাস দিয়েছিল। তারা জনগনকে বিনোদন দিয়ে ব্যস্ত রেখেছিল কিন্তু অন্য একনায়ক ব্যবস্থা অন্য পদ্বতি অবলম্বন করে জ্ঞান ও চিন্তাকে নিয়ন্ত্রনের জন্য। কীভাব তারা করে? শিক্ষা ব্যবস্থার মান নামিয়ে দেয়, সংস্কৃতিকে সীমাবদ্ধ করে, তথ্যকে সেন্সর করে, মানুষের মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে হ্রাস করে, এবং এটা মনে রাখা প্রয়োজন এই প্যাটার্ন ইতিহাসে বার বার হয়ে আসছে।”

 

                  *স্পয়লার বিদ্যমান*

 

এনিমি ফিল্মে ইতিহাসের শিক্ষক এডাম একটা সাধারন জীবন যাপন করে। ক্লাসে লেকচার দেয় এবং ঘরে ফিরে আসে। গার্লফ্রেন্ড মেরির সাথে সেক্স করে। সে মুভি টুভি দেখতে যায় না।

একদিন তার এক কো-ওয়ার্কার তাকে একটা ফিল্মের কথা বলে। সেই ফিল্মের ডিভিডি নিয়ে দেখতে বসে এডাম। এবং আবিষ্কার করে ফিল্মটিতে খুব ক্ষুদ্র এক চরিত্রে একজন অভিনেতা দেখতে ঠিক তার মতো।

সে তার সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করে।

সেই অভিনেতাকে একসময় সে খুঁজে পায়।

অভিনেতা এনথনি একজন বিবাহিত লোক। তার বউ ছয়মাসের অন্তঃস্বত্তা। কিন্তু সে বউয়ের সাথে প্রতারণা করে অন্য মেয়ের সাথে সম্পর্ক রাখে। এটা জানা যায় বউয়ের সাথে তার কথোপকথনে।

এনথনির সাথে এডাম দেখা করে একটি আধো অন্ধকার হোটেল রুমে। তারপর সেই অভিনেতা এনথনি সন্দেহ করে এডাম হয়ত তার স্ত্রী হেলেনের সাথে সেক্স করেছে। এজন্য এনথনি চায় এডামের গার্লফ্রেন্ড মেরির সাথে সেক্স করতে। সে শর্ত দেয়, একমাত্র তাহলেই সে এডামের জীবন থেকে দূরে সরে যাবে।

এডাম এতে রাজী হয়। সে এনথনিকে এপার্টমেন্টের চাবি দিয়ে চলে যায় এনথনির বাসায়। সেখানে এনথনির ছয়মাসের অন্তঃস্বত্তা বউ। এনথনি এডামের গার্লফ্রেন্ড মেরিকে এপার্টমেন্টে নিয়ে আসে। মেরি একসময় বুঝে ফেলে সে এডাম না। তাদের ঝগড়া হয় এবং গাড়িতে আসার সময় তাদের কার এক্সিডেন্ট হয়। সম্ভবত তারা দুজনই মারা যায়।

অন্যদিকে এনথনির বউ হেলেন বুঝতে পারে তার সাথে থাকতে আসা লোক এনথনি নয়, এডাম। কিন্তু তাতে তার কোন আপত্তি থাকে না। ফলে কার এক্সিডেন্টের পরে এডামের এনথনি হয়ে থাকার সুযোগ সৃষ্টি হয়। শেষ দৃশ্যে দেখা যায় এনথনির বউ হেলেন একটি বৃহৎ মাকড়শায় পরিণত হয়েছে। অবশ্য তাতে এডাম ভয় পায় না বা অবাক হয় না।

enemy

এই মূলত ফিল্মের কাহিনী। আলফ্রেড হিচকক প্রেজেন্টস-সিজন ওয়ান এর দশ নাম্বার পর্বে কাহিনীটার নাম ছিলো দ্য কেইস অফ মিস্টার পেলাম। সেখানে মিস্টার পেলামের মতো দেখতে একজন লোক পেলামকে কৌশলে হটিয়ে নিজেই মিস্টার পেলাম হয়ে বসে থাকে। এনিমিও একই রকম ইম্পোস্টার ফিল্ম হতে পারতো কিন্তু এনিমি তার দূর্বোধ্যতার জন্য আরো ভিন্ন কিছু ইন্টারপ্রিটেশনের সুযোগ করে দিয়েছে। এনিমি ফিল্মটিতে হিচককীয়ান সাইকোলজিক্যাল টেনশন আনার চেষ্টা করা হয়েছে।

মুভির মেকিং অন্ধকার অন্ধকার পরিবেশে যাকে বলা যায় ফ্রাণৎস কাফকা টাইপের আবহাওয়া। ইতিহাসের শিক্ষক এডামের স্বাভাবিক জীবন যাপন দেখে তাকে প্রথম থেকে খুব একটা স্বাভাবিক বলে মনে হয় না। ফিল্মটি এডামের মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব নিয়ে। একে এভাবে দেখা যেতে পারে, দৈনন্দিন জীবন যাপনে বিরক্ত একজন ইতিহাসের শিক্ষক তার এই ধরনের জীবন থেকে বেরিয়ে আসতে চায়। তার ভেতরে বিভিন্ন ধরনের ফ্যান্টাসীর তৈরী হয়। এর মাঝে একটি হল অভিনেতা হবার। আরেকটি সেক্সুয়াল।

এজন্য সে তৈরী করে তার আরেকটি ভার্শন এনথনি। সেই এনথনি থার্ড রেটের মুভিতে ক্ষুদ্র চরিত্রে অভিনয় করে। এরোটিক সেক্স ক্লাবে যায়।
এখানে মূলত ইতিহাসের শিক্ষক এডামের স্ত্রীই ছয়মাসের অন্তঃস্বত্তা। এডাম স্ত্রীকে না জানিয়ে অন্য একটা এপার্টমেন্টে গার্লফ্রেন্ড মেরিকে নিয়ে যায়। এর জন্য তার মধ্যে অপরাধবোধ কাজ করে। ফলে তার দুই স্বত্তার মধ্যে দ্বন্দ্বের উদ্ভব হয় এবং এই দুই ক্যারেক্টারের অন্তর্গত দ্বন্দ্বই ফিল্মের বিষয়বস্তু।

দুই ক্যারেক্টারের কথাবার্তা হলো ইগো এবং অল্টার ইগোর আলাপ।

 

enemy2

ফিল্মের পুরোটা জুড়ে বিভিন্ন সময়ে মাকড়শা বা মাকড়শাল জাল দেখানো হয়েছে। প্রথমদিকে এডাম স্বপ্নে দেখে সে একটা সেক্স ক্লাবে। সেখানে প্রথম মাকড়শা দেখা যায়। এই দৃশ্যে যে এডাম থাকে, অর্থাৎ তার স্বপ্নে, সেখানে তার হাতে বিয়ের আংটি দেখা যায়। এর মানে এডাম এবং এনথনি দুজনই এক ব্যক্তি।

আরেকটি লক্ষণীয় বিষয় হল ফিল্মের শুরুতে এরোটিক সেক্স ক্লাব, টরানটোলা মাকড়শা ইত্যাদি দেখানোর পরই প্রেগনেন্ট হেলেনকে খুব অল্প সময়ের জন্য দেখানো হয়। একা বিছানায় বসে আছে। এই সময়ে তাকে দর্শকের চেনার উপায় নেই কারণ হেলেন চরিত্র আরো অনেক পরে ফিল্মে আসে।

এই দৃশ্যের মাধ্যমে বুঝানো হয়েছে ইতিহাসের শিক্ষক এডাম প্রেগনেন্ট বউকে ফেলে এরোটিক সেক্স ক্লাবে গিয়েছে বা যাওয়ার ফ্যান্টাসীতে আছে।
এছাড়া এডাম তার মায়ের সাথে কথা বলতে যায় এ বিষয়ে। তখন তার মা এ নিয়ে তেমন কোন উচ্চবাচ্য করেন না। তিনি তার পুত্র এডামকে থার্ড রেটের মুভির তুচ্ছ অভিনেতা হবার ফ্যান্টাসী বাদ দিতে বলেন। মায়ের সাথে সংলাপেও প্রতীয়মান হয় এডাম একজন মানসিকভাবে বিধ্বস্ত মানুষ।

এডাম যখন যায় এনথোনির এপার্টমেন্টে তখন এনথোনির ছয়মাসের অন্তঃস্বত্তা বউ বুঝতে পারে সে এনথনি না, কিন্তু তবুও সে অন্তরঙ্গ হয় তার সাথে। প্রথম দেখায় এরকম মনে হবে কিন্তু এখানের বিষয় হলো, এনথনির বউ হেলেন তার স্বামী ইতিহাসের শিক্ষক এডামের এনথনি সাজা অর্থাৎ তার দ্বৈত স্বত্তার জীবন যাপন সম্পর্কে জানতো। এইজন্যই সে তার সাথে অন্তরঙ্গ হয়।

Makorsha

ইতিহাসের শিক্ষক এডাম একনায়ক/স্বৈরশাসক নিয়ে ক্লাসে লেকচার দেয়। কিন্তু সে নিজেই তার সাবকনশাস মাইন্ড তথা অবচেতন মনের নিয়ন্ত্রনে আটকে আছে। অবচেতন মনের নিয়ন্ত্রন বুঝাতেই বার বার মাকড়শাল জাল এবং মাকড়শা দেখানো হয়েছে। মানুষ তার সাবকনশাস দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। শেষ দৃশ্যে হেলেনের বিরাট মাকড়শায় রূপান্তরিত হওয়ার মাধ্যমে বুঝানো হলো, যদিও এডামের জীবন থেকে এনথনি ক্যারেক্টারের ফ্যান্টাসি দূর হয়েছে তবুও সে তার সাবকনশাসের নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত হতে পারে নি।

এডাম এনথনির জন্য আসা একটা খামে এরোটিক সেক্স ক্লাবের চাবি পায়। এবং সে তা ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেয়। মোটের উপর, এডামের সেক্স ক্লাবে যাওয়ার ফ্যান্টাসী একটা পূর্নতা পেতে যাচ্ছে বুঝা যায়। এবং এর পরেই এডাম তার বউয়ের বিরাট মাকড়শা রূপ দেখে। অর্থাৎ, এডাম যেই জালে আটকা ছিলো সেই জালেই আটকা রইল।

এডাম বৃহৎ মাকড়শা দেখে ভয় পায় না কিংবা তার আলাদা কোন অনুভূতি হয় না, এর দ্বারা বুঝানো হল এডাম বুঝতে পারছে না তার উপর তারই অবচেতনের নিয়ন্ত্রণ। সে এই জালমুক্ত হতে পারে নি।

পরিচালক ভিলেন্যুব এই ফিল্ম নিয়ে বলতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘অবচেতন আমাদের ভিতরের থাকা স্বৈরশাসক’। এনালিটিক সাইকোলজির প্রতিষ্ঠাতা সুইশ সাইকিয়াট্রিস্ট এবং সাইকোথেরাপিস্ট। কার্ল গুস্তাব ইয়ুং (জং) এর কথায়, “অবচেতনকে তুমি যদি চেতনে পরিণত না করতে পারো তাহলে অবচেতন তোমার জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করবে এবং তুমি তাকে ভাগ্য বলে মেনে নেবে। আমরা হয়ত মনে করতে পারি নিজেদের উপর পুরো নিয়ন্ত্রণ আছে। কিন্তু কোন বন্ধু আমাদের সম্পর্কে সহজেই এমন কিছু প্রকাশ করতে পারে যা সম্পর্কে আমাদের নিজেরই কোন ধারণা ছিল না।”

ক্লাসে এডামে লেকচারে বলা কথাগুলো সত্য, পৃথিবীর ইতিহাসে এমন হয়েছে এবং হচ্ছে। কিন্তু আইরনি হলো, ফিল্মে এডাম তার সাবকনশাস দ্বারা একইভাবে নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে নিজের জীবনে। সে বুঝতে পারছে না কীভাবে তার সাবকনশাস তাকে নিয়ন্ত্রন করে চলেছে। যেভাবে হয়ত বুঝতে পারছে না পৃথিবীর অন্য সব মানুষেরাও।

এনিমি নির্মানে পরিচালক ভিলেন্যুবের কাজ কৃতিত্বের দাবীদার। অন্ধকার পরিবেশ, মাকড়শা, সাইকোলজিক্যাল টেনশন, বিভিন্ন রূপকে সাবকনশাসের নিয়ন্ত্রন বুঝানোর চেষ্টা ইত্যাদি অসাধারণ। অবশ্য ফিল্মটি দূর্বোধ্য বলতে পারেন অনেকে, ডেভিড লিঞ্চের লস্ট হাইওয়ের মতো। কিন্তু এটি একটি সাইকোলোজিক্যাল ফিল্ম হিসেবে উল্লেখযোগ্য এবং উপভোগ্য হয়ে থাকবে।