ফেইস এপ নামক এপ ব্যবহার করে ছেলেরা মেয়ে হতে পারতেছেন, আর মেয়েরা ছেলেরা হতে পারতেছেন। অন্তত, ছবিতে। সেগুলি তারা পোস্ট দিচ্ছেন ফেইসবুকে। আবার এগুলা নিয়া মেয়েদের দল থেকে ও ছেলেদের দল থেকে সমালোচনাও দেখা যাইতেছে। এই হলো বর্তমান নয়া ট্রেন্ড এবং এর একটা এনালাইসিস করার মজা থেকে নিজেরে বিরত রাখতে পারলাম না।
কার্ল গুস্তাম (ইয়ুং) জাংগিয়ান সাইকোলজিক্যাল তত্ত্ব অনুসারে মানুষেরা বাইরের দুনিয়ায় আচার আচরনের জন্য একটা মুখোশ পরিধান করেন, যেটারে বলে পারসোনা।
কিন্তু মানুষের এই মুখোশ পরিহিত অভিনয়ের ভেতরে আরেকটা জিনিস থাকে, যেটা ইমোশনাল এবং যাবতীয় অন্ধকার বৈশিষ্ট্যাদি (রাগ, এগ্রেশন ইত্যাদি) ঐখানে থাকে, জাং এর নাম দিয়েছেন শ্যাডো।
এই শ্যাডোর মধ্যেই থাকে এনিমা ও এনিমাস।
আর সমগ্রটা নিয়ে হয় সেলফ। পারসোনা, শ্যাডো, এনিমা/এনিমাস, ও কালেক্টিভ আনকনশাস। গুস্তাব জাং এর কথায়, ‘‘The Self embraces ego-consciousness, shadow, anima, and collective unconscious in indeterminable extension.’
এনিমা হইল প্রতিটা পুরুষের ভেতরে থাকা নারী বৈশিষ্ট্য। ধরেন, প্রতিটা পুরুষের ভেতরে একজন নারী বাস করেন। এই নারীটি নারীত্বের বৈশিষ্ট্য যেমন ইমোশন, সহমর্মীতা, দয়া মায়া ইত্যাদির বহন করেন। আর এনার চরিত্রটি নির্মিত হয় পুরুষটির মা থেকে এবং চারপাশের পরিবেশ থেকে।
আর প্রতিটা নারীর ভেতরে পুরুষ বৈশিষ্ট্য থাকে, তার শ্যাডোতে। এই নারীর ভেতরে থাকা পুরুষটির নাম এনিমাস। ইনি পৌরষিক বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য যেমন, উচ্চাকাঙ্খা, কারেজ, দৃঢ়তা ইত্যাদি ধারণ করেন।
ফেইস এপ ব্যবহার করে পুরুষদের নারী হওয়ার যে তাড়ণা, এটা হলো তার ভেতরে থাকা এনিমার তাড়ণা। নারীদের ক্ষেত্রে পুরুষ হবার যে তাড়ণা তা তার এনিমাসের তাড়ণা। এই আর্কিটাইপই সম্ভবত এপটি ভাইরাল হতে ভূমিকা রেখেছে।
এখন কথা হইল যে, পুরুষের ভেতরে যে নারী আছে তার বিপদ কী, ঐ পুরুষের ব্যক্তিত্ব নির্মানে। যদি পুরুষটি পুরোপুরি ভাবে একে রিজেক্ট করে, মানে টোটালি রিপ্রেসড থাকে, তাহলে তার কিছু জিনিস বিকৃত হয়ে যায়, যেমন তার ইমোশন বদলে হয়ে যায় মুডিনেস, হিস্ট্রিরিয়া, সেন্টিমেন্টালিটি। বিশ্বস্থতা বাদ দিয়ে সে হয়ে যায় পজেসিভ।
একইভাবে, নারীর ক্ষেত্রে যদি তার এনিমাসের সীমা সে না বুঝে তাহলে, সে র্যাশনাল থিংকিং করতে গিয়ে করে ফেলে তর্ক, এবং হয়ে উঠে তর্কবাজ। দৃঢ়তা হয়ে যায় এগ্রেসিভনেস। ইত্যাদি।
এখন, ধরা যাক কোন ছেলে এক জায়গায় গিয়ে একটা মেয়েকে দেখলো, আর তার প্রেমে পড়ে গেল। লাভ এট ফার্স্ট সাইট যাকে বলে। এর কারণ হিসাবে, জাংগিয়ান এনিমা এনিমাস আর্কিটাইপ তত্ত্ব থেকে বলা যায়, ছেলেটি তার ভেতরে যে মেয়েটি আছে, তার সাথে ঐ মেয়েটির মিল পেয়েছে। তাই তার প্রেমে পড়েছে।
একইভাবে মেয়েদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
এখানে তারা আসলে কার প্রেমে পড়লো? নিজের ভেতরের মেয়ে/ছেলেটির সাথেই তাদের মূল প্রেম। তার সাথে অন্য কারো মিল দেখে, প্রেমে পড়লো, এবং পরে যদি দেখে মিল নেই, সে বলতে পারে তুমি তো এমন ছিলে না!
ফেইস এপ ব্যবহার করে কোন ছেলে যখন তার মেয়ের ছবি দিচ্ছে, ঐ ছেলের বাস্তব জীবনের প্রেমিকা জিনিসটা পছন্দ করবে না।
আনকনশাসলি সে জানে, এই মেয়েটিই তার প্রকৃত সতীন।
যদি কোন সতীন তার থেকে থাকে, তাহলে সে বাইরের দুনিয়াতে কখনো বাস করে না, বাস করে তার প্রেমিকের ভেতরে, প্রেমিকের আনকনশাসের একটা অংশ হিসেবে।
ফেইস এপ তার কারিকুরির মাধ্যমে ঐ সতীনকে দৃশ্যমান করে তোললো আর কি।
একইভাবে ছেলেদের ক্ষেত্রেও বলা যায়। তার প্রেমিকা ছেলে হয়ে ছবি দিলে এটা তার ভালো লাগবে না। কারণ আনকনশাসলি সে ফিল করবে, ঐ ছেলেটিই তার প্রেমিকার এনিমাস, তথা আসল প্রেমিক।
এবার জাংগিয়ান তত্ত্বের বাইরে গিয়ে দেখা যাক একটু, পরীক্ষা এই সব ব্যাপারে কী বলে।
বিভিন্ন সময়ে দেখা গেছে যে, রোমান্টিক কাপলদের চেহারা একইরকম হয়। এই নিয়ে সাইকোলজিস্টেরা গবেষণা করে যাচ্ছেন।
একটা থিওরী হলো মানুষ তার নিজের চেহারার সাথে বেশি পরিচিত। ফলে যেসব মানুষের চেহারায় তার চেহারার সাথে মিল আছে, তাদের সে পছন্দ করে।
২০১৩ সালে একটা স্টাডি করা হয়েছিল। কিছু মানুষকে তাদের রোমান্টিক পার্টনারের ছবি ডিজিটালি পরিবর্তন করে দেখানো হলো, কোনটা বেশি ভালো তা রেট করতে। ডিজিটালি পরিবর্তন করার সময় কিছু ছবিতে অন্য অনেকের চেহারার নানা ফিচার এড করা হলো আর কিছু ছবিতে ঐ ছেলে বা মেয়ের চেহারার নানা ফিচার তার রোমান্টিক পার্টনারের চেহারায় বসিয়ে দেয়া হলো। দেখা গেল সব ক্ষেত্রেও ছেলে ও মেয়েরা ওইসব ছবিকেই বেশি পছন্দ করেছে যেগুলিতে তাদের চেহারার ফিচার যোগ করা হয়েছে। এছাড়া, আরেক স্টাডিতে একইভাবে ছবি দিয়ে পরীক্ষা করে দেখা গেছে, মানুষেরা তাদের বিপরীত সেক্সের পিতামাতার চেহারার সাথে মিল আছে এমন মানুষের দিকে রোমান্টিক্যালি আকৃষ্ট হয়। ২০১৮ সালের একটি স্টাডিতে দেখাগেছে, মানুষ বিপরীত সেক্স না, তার পিতামাতার চেহারার সাথে মিল আছে, এমন মানুষের দিকে আকৃষ্ট হয়।
আর ফেইসএপের করা ছেলের মেয়ে ফেইস বা মেয়ের ছেলে ফেইসই তাদের চেহারার সাথে বেশি মিলবে, ফলত, তাদের ভালোবাসা বেশি থাকার কথা ঐ ফেইসের প্রতি।
এইরকম একটা গল্পও লেখা যায়। এক ছেলে ফেইস এপে তার মেয়ে চেহারার এমন প্রেমে পড়ে গেলো যে, তার প্রেমই ভেঙ্গে গেলো…