ফেসবুকে বুদ্ধিজীবী হবার কলা কৌশল

ফেসবুকে যদি আপনি বুদ্ধিজীবী হতে চান তাহলে প্রাচীন সোফিস্টদের ব্যাপারে হালকা জানাশোনা থাকলে ভালো। আপনার মূল কাজ হবে তাদের মত। 

ফেসবুকে মানুষেরা আছেন। তাদেরকে পারসুয়েড করাই আপনার কাজ হবে। সত্য মিথ্যা যাই হোক না কেন, আপনার কাজ হল যে মতে আপনি আছেন, সেই মতে ওদের পারসুয়েড করা। 

সোফিস্টদের সম্পর্কে 

এক 

প্রাচীন সফিস্টদের তর্কবিদ্যায় দখল ছিল। কয়েকটা ফিল্ডে, যেমন মিউজিক সাহিত্য ইত্যাদিতে তাদের জ্ঞান থাকত।

তারা শিখাইত কুতর্ক। টার্গেটেড শিক্ষার্থী ছিল হইতে চাওয়া রাজনীতিবিদেরা।

কারণ রাজনৈতিক বক্তিমায় এমনভাবে কথা বলতে হয়, যাতে লোকে কনভিন্স হয়। এটা প্রধান যোগ্যতা।

সোফিস্টদের নিজস্ব কোন অবস্থান থাকত না। সব কিছুর বিরুদ্ধেই তারা কুতর্ক করত, বা কুতর্কের একটা পয়েন্ট হাজির করত। এটা ছিল তাদের মার্কেটিং। এই করে তারা নিজেদের তর্কবিদ্যার ক্ষমতা দেখাইয়া দিত, ও ছাত্র পাইত।

নিজের কোন অবস্থান নাই, আজ এই যুক্তি কাল এই যুক্তি, ইত্যাকার কুতর্ক করে যাওয়ায় তারা কুতার্কিক হিসেবে ইতিহাসে রয়েছে। প্রাচীন গ্রীসের ঐ সময়ে সোফিস্ট গালি হয়ে গেছিল।

কীয়ের্কেগার্ড তার সময়ে অনেকরে বলতেন মডার্ন ডে সোফিস্ট। 

দুই 

সোফিস্টদের কাছে সত্য কী, এটা নিয়ে মাথাব্যথা ছিল না। তাদের উদ্দেশ্য থাকত তর্কে জেতা। হ্যানা আরেন্ট বলছিলেন, প্রাচীন সোফিস্টেরা সত্য বিসর্জন দিয়াও তর্কে জিতে খুশি থাকত। কিন্তু আধুনিক সোফিস্টেরা আরো বেশি চায়। তারা চায় দীর্ঘকালীন বিজয়, ইভেন বাস্তবতারে বিসর্জন দিয়া হইলেও।

তিন 

সবচাইতে বিখ্যাত সোফিস্ট প্রোতাগোরাসের এক উক্তি আছে, ম্যান ইজ দ্য মেজার অব অল থিংস। 

তিনি বলতে চাইছিলেন, কোন জিনিশ ঠিক না ভুল, ভালো না মন্দ, তা সব সময়  ব্যক্তির চাহিদার উপর নির্ভর করবে।

অর্থাৎ, সকল কিছুই আপেক্ষিক।

কিন্তু তার এই কথা সত্য হলে, তার উক্তিটিই সত্য হয় না। কারণ এটা তার জন্য সত্য হলে, আমার জন্য সত্য নাও হতে পারে, এটাই যেহেতু উক্তির মর্মার্থ।

চার 

সোফিস্টেরা ঐতিহ্যের ভিত্তি, নৈতিক ও সামাজিক অর্ডারকে চ্যালেঞ্জ করত। কিন্তু তারা নতুন কিছু এর পরিবর্তে দিতে পারে নি বা দেয়ার ইচ্ছাও তাদের ছিল না।

সক্রেটিস অবজেক্টিভ এবং ইটার্নাল সত্যের প্রতি আগ্রহী ছিলেন, খুঁজেছিলেন।

কিন্তু সফিস্টেরা প্রচার করত আপেক্ষিকতা ও সাবজেক্টিভিজম (আমিই সব), যেখানে প্রত্যেক ব্যক্তি ঠিক করবে তার জন্য সত্য কী, সুন্দর কী, ইত্যাদি।

সোফিস্টদের কোর্সগুলার নাম হত এমন, আধুনিক ভার্সনে ভাবানুবাদে –

  • যেকোন মতে থেকে তর্কে জেতার উপায়
  • যত খারাপ অবস্থানই হোক না কেন, যেভাবে তর্কে জিতবেন
  • কীভাবে চেষ্টা না করে ব্যবসায় সফল হবেন

তখনকার চিন্তাহীন মব এই জিনিশটা পছন্দ করেছিল। তারা দলে দলে আগ্রহী হয়েছিল, কারণ এগুলির মাধ্যমে তারা ক্রিটিক্যাল চিন্তা করছে এমন ভ্রম হত, এবং সকল কিছু আপেক্ষিক হওয়ায় “আজ সকলেই সকলেই কিংবদন্তী” হবার মজা পেত।

কিন্তু সমাজের কমন লাইফের ফাউন্ডেশনের জন্য এই এপ্রোচ কাজের ছিল না।

আধুনিক দিনে, পলিটিক্যালি দেখলে এই এপ্রোচ সকল সময় অত্যাচারী শাসকের পক্ষে কাজ করে। কারণ এটি ধ্বংসাত্মক এপ্রোচ, সৃষ্টিশীল না, এবং এটি বৃহত্তর বা সামগ্রিক মানুষের লাইফকে কেয়ারই করে না।

মানুষরে পারসুয়েড করবেন কীভাবে? 

এ নিয়ে মানব প্রকৃতি বুঝে কিছু সাইকোলজিক্যাল ট্রিক প্রয়োগ করতে হবে। যেহেতু আপনার কোন নৈতিক পজিশন নাই, সত্য মিথ্যা আপনার কাছে ম্যাটার করে না, মানুষের ভালো মন্দ ম্যাটার করে না, তাই নির্দ্বিধ্বায় এইসব ট্রিকস ব্যবহার করে যেতে পারবেন। 

১। মানুষ যে জিনিশ নিয়ে বেশি সময় ভাবে, অযৌক্তিক ভাবে ঐ জিনিশ তার কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে হতে থাকে। তাই, মানুষকে বেশি সময় আপনি যে বুদ্ধিজীবী এবং বিশাল কাজ করে যাচ্ছেন, তা ভাবাতে হবে। এভাবেই আপনি মানুষের ব্রেইনকে নিয়ন্ত্রণ করে নিজের গুরুত্ব তৈরি করে নিতে পারেন। 

এতে কোন ইয়াং লোক, বুদ্ধিজীবী তারে অধিক গুরুত্বপূর্ণ জ্ঞান করে, সব কিছু ছেড়ে দিয়ে আপনার মত বুদ্ধিজীবী হবার সাধনায় লেগে যেতে পারে। 

আপনি এটাকেও ভালো ভাবে দেখবেন। কারণ এতে আপনার দল ভারী হল। 

২। কোন ঘটনা ঘটলে বেশীরভাগ মানুষ যা বলছে তার বিপরীতে একটা পয়েন্ট বের করুন। 

কারণ পারসুয়েশনের এক টেকনিক হল, মানুষ যা ভাবছে তা বলে ফেলা, ফলে মানুষ মনে করবে আপনি তার কথাই বলছেন, যেন এক অমোঘ সত্য বলে পথ দেখালেন। 

তাহলে বেশীরভাগের বিপরীতে কেন বলবেন? এটা নিনজা টেকনিক। 

বেশরভাগ যখন কোন জিনিশরে ভালো বলছে, তখন এই ভালো ভালো দেখতে দেখতে কিছু মানুষ বিরক্ত। তাড়া উলটা ভাবছে। আপনার টার্গেট অডিয়েন্স এরা। 

যখন আপনি বলে ফেলবেন, এরা শেয়ার করে অন্য “এরা” দের কাছে পৌঁছে দেবে। 

ফেসবুকের বিশাল জনগোষ্ঠীর মধ্যে ৫% এর কাছে গেলেও সংখ্যায় তা বিশাল। 

৩। লেখার সময় অগুরুত্বপূর্ণ এবং যেসব জায়গায় ওই টার্গেটেড পাঠককে আক্রমণ করা হয়, এবং পাঠক মনে করে “এটা তো আমি না” – এইসব অংশ বাদ দিন। এইখানে এমন অবস্থা রাখুন যে পাঠক যাতে নিজের সুবিধামত, সবচাইতে বেটার জিনিশ নিজের জন্য কল্পনা করে নিতে পারে। 

৪। আপনার যে সুকৌশল তর্ক ট্রিকে অভিজ্ঞ হতে হবে তার নাম হাই গ্রাউন্ড ম্যানুবার। 

মনে রাখবেন ভাষা আপনি কীভাবে ব্যবহার করেন তা মানুষকে প্রভাবিত করে। ফেসবুক বুদ্ধিজীবীর মূল কাজ ভাষা নিয়ে খেলাধুলা করা। 

আইফোন ফোর একভাবে ধরলে ফোন কেটে যেত। এটা নিয়ে সমালোচনা হচ্ছিল। 

স্টিভ জব প্রেস কনফারেন্স ডাকলেন। 

ধারণা করা হচ্ছিল তিনি ক্ষমা চাইবেন। 

কিন্তু তিনি প্রয়োগ করলেন হাই গ্রাউন্ড ম্যানুভার। পুরা তর্কের কনটেক্সট বদলে দিলেন। 

তিনি বললেন, আমরা পারফেক্ট নই। ফোন পারফেক্ট নয়। আমরা সবাই তা জানি। কিন্তু আমরা চাই আমাদের ইউজারদের খুশি করতে। 

আর কোন ক্ষমা চাওয়া নাই। 

জবস কিছু সত্য উচ্চারণ করলেন, আসলেই তো কেউ পারফেক্ট না। ফোন পারফেক্ট না। 

এর পরে তর্ক বদলে গেল। বিভিন্ন পত্রিকায় অন্যান্য ফোনের কী কী ইম্পারফেকশন আছে, তা নিয়ে আলাপ হতে লাগল। 

এভাবে হাই গ্রাউন্ড ম্যানুভার প্রয়োগ করতে হয়। 

এক উদাহরণ দেই। ধরা যাক, বিখ্যাত আমেরিকান দার্শনিক, বুদ্ধিজীবীর সাথে বাংলাদেশের একজন লোক ফেসবুক লাইভ আয়োজন করল। সে এই লাইভের ব্যাপারে ফলাও করে প্রচার করল। নির্ধারীত সময়ে ঐ দার্শনিক এসে বসে আছেন, কিন্তু আমাদের লোকটি নেই।

ভদ্রতার খাতিরে দার্শনিক অপেক্ষা করলেন ও লাইভ শুরু হলে তারে বললেন এখন সময় আর নেই। স্বাভাবিক, কারণ এমন লোকের স্কেজিউলে নানা কাজ থাকতে পারে।

তখন, ফেসবুক সমাজ আমাদের লোকটির অভদ্রতা নিয়ে সমালোচনা শুরু করল।

তখন ফেসবুক বুদ্ধিজীবী হিসেবে আপনি প্রথমেই সবার উলটা কথা বলবেন। এখানে হাই গ্রাউন্ড ম্যানুভার প্রয়োগ করতে হবে।

বলতে হবে, ঐ দার্শনিক লোকটি পশ্চিমা সম্পদ।

এই কথা এক অর্থে ঠিক, দার্শনিক ঐখানে জন্ম নেয়ায় ঐখানেরই সম্পদ হন।

এটা বলে, পূর্ব পশ্চিম বিভাজন, আমরা তারা’তে কথাবার্তা নিয়ে গেলেন। এরপর বলতে হবে, সময়নুবর্তীতা একটা পশ্চিমা ব্যাপার।

এটাও অনেকে ঠিক মনে করবে, যেহেতু টেকনোলজি এখন পশ্চিম থেকে আগত বেশি, আর ঘড়ি টেকনোলজির প্রতীক।

তবে অবিশ্বাস্য বা হাস্যকর বা উদ্ভট, যেরকমই কথাটি হোক না কেন, আপনার সমর্থকেরা এটি খাবে। কারণ আপনি প্রসঙ্গটারে পশ্চিমা ও আমরাতে নিয়ে গেছেন।

জীবনের স্তরে স্তরে পরাজিতরা জগতের সকল কিছুকে পশ্চিমা ষড়যন্ত্র ভেবে বসে আছে, ফলে আপনার কথা তাদের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে। কী বলছেন তার মেরিটে না অবশ্যই, পশ্চিমের বিরুদ্ধে বলছেন এই যোগ্যতায়।

তবে পশ্চিম বিরোধিতার এই মোক্ষম অস্ত্র দিনরাত সফল ভাবে প্রয়োগ করে গেলেও আপনি লাইফস্টাইলে পশ্চিম, চিন্তাতেও পশ্চিম হতে পারবেন অবলীলায়, কারণ আপনি যা বলেন তা বিশ্বাস করেন না। আপনার প্রসেসটা হচ্ছে, তর্কের জন্য তর্ক করা, যেখানে বিশ্বাসের কোন জায়গাই নেই।

৫। মনে রাখবেন সামান্য বিরক্তিতে মানুষ অভ্যস্থ হয়ে যায়। অর্থাৎ, আমি যদি আমি আমি আমি করেন, আপনি যদি নিজেরে দার্শনিক বুদ্ধিজীবী রকেট সুপারনোভা ইত্যাদি বলতে থাকেন, মানুষ সামান্য বিরক্তি হবে, কিন্তু একসময় এতে অভ্যস্থ হয়ে যাবে। 

৬। মনে রাখবেন, রিপিটেশন পারসুয়েসিভ। বার বার করে যাবেন। একই জিনিশ বার বার বলবেন। মানুষ যাতে বেশি এটি দেখতে পারে। বার বার দেখতে থাকলে মানুষের ব্রেইন এটাকে সত্যি বলে ধরে নেয়। 

পুনশ্চ, উপরিউক্ত ট্রিক সমূহ প্রয়োগ করে মানুষের চিন্তা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা আপনি করে যাবেন, যাতে সে বুদ্ধিজীবী হিশাবে আপনাকে মেনে নেয়। সত্য মিথ্যা, মানুষের ভালো মন্দ, এমন কোন বাটখাড়া আপনি মানবেন না, কারণ আপনার জীবন সাধনা বুদ্ধিজীবী হওয়া। 

এভাবে করে যেতে থাকলে আপনি ফেসবুক বুদ্ধিজীবী হিশাবে পরিচিত হয়ে যাবেন, এবং বিশ্বকাপ পাবেন। আপনাকে আগাম অভিনন্দন।