এই ফিল্মগুলি আমি সম্প্রতি দেখেছি বলা চলে। মাত্র একটা বেশ কিছুদিন অর্থাৎ এক বা দুই মাস আগে দেখেছিলাম। হেইস্ট মুভি রিফিফি। বাকীদের দেখা হয়েছে কয়েক সপ্তাহের মধ্যে। প্রায় সবক’টাই থ্রিলার। সাদাকালো থ্রিলার ফিল্ম আমার ভালো লাগে। আগে দেখার কারণে গ্যাসলাইট বা ওরসন ওয়েলেসের টাচ অফ ইভিল, অথবা দ্য ট্রেইন, ডেড রিংগার, হিচককের রোপ নিয়ে কিছু নাই এখানে, তবে এই ধরনের ফিল্ম যাদের ভালো লাগে তারা এসবও দেখতে পারেন।
ডায়াবোলিক (Les Diaboliques)
হেনরি জর্জ ক্লুজো
ডায়াবোলিকস একটি ফ্রেঞ্চ থ্রিলার ফিল্ম যার মূল কাহিনী শুরু হয় একটি স্কুলে। স্কুলের হেডমাস্টার মিশেল খুবই অত্যাচারী স্বভাবের। তার বউ হেডমিস্ট্রেস ক্রিস্টিনা, ধর্মভীরু, নিরীহ ও ভালো স্বভাবের। মিশেলের একজন মিস্ট্রেস আছে, সে স্কুলেরই শিক্ষিকা, নাম নিকোল। বউ ক্রিস্টিনা এতে কোন বাঁধা দেয় না।
কিন্তু তবুও মিশেল বউয়ের সাথে সে চরম দুর্ব্যবহারে অভ্যস্থ।
এই মিস্ট্রেস নিকোল ক্রিস্টিনাকে প্ররোচিত করে হেডমাস্টারকে খুন করার জন্য। দুজনে মিলে পরিকল্পনা করে। এবং তারা কার্য সমাধাও করে। খুনের পর মৃতদেহ পুলে ডুবিয়ে দেয়। কিন্তু পরবর্তীতে দেখা যায় মৃতদেহ আর নাই। পুলের পানি সরালেও মৃতদেহ আর পাওয়া নাহি যায়।
এই নিয়ে ফিল্মের শেষ অর্ধেক কাহিনী এগিয়ে যেতে থাকে। একে হিচককের বেস্ট কাজগুলির মত ইফেক্টিভ সাসপেন্স থ্রিলার বলেছেন রজার এবার্ট। হিচকক এই ফিল্ম দ্বারা অনুপ্রাণিত হন, এমনকী “সাইকো” উপন্যাসের লেখক রবার্ট ব্লক এর সব সময়ের প্রিয় হরর ফিল্ম এই ডায়াবোলিকস। হিচকক তার সাইকো সাদা কালোতে নির্মান করেন, এর একটি কারণ ছিল এই ফিল্মের প্রতি তার ভালো লাগা।
Pierre Boileau and Thomas Narcejac এর উপন্যাস She Who Was No More উপরভিত্তি করে ফিল্মটি নির্মান করেন Henri-Georges Clouzot।
সিটিজেন কেইন
ওরসন ওয়েলেস
তার বিশাল প্রাসাদ জানাডুতে মারা গেছেন চার্লস ফস্টার কেইন। একজন অতি সম্পদশালী মানুষ, মৃত্যুর সময় তার হাতে ছিল একটি স্নো গ্লোব, তা হাত থেকে পড়ে যায় এবং তিনি উচ্চারণ করেন, “রোজবাড” শব্দটি।
কেইন ছিলেন বিখ্যাত, প্রকাশ করতেন সংবাদপত্র; তার সম্পদ ও খ্যাতির জন্য তার মৃত্যু সংবাদ ও মৃত্যুর সময় উচ্চারিত শব্দ “রোজবাড” প্রচার হতে থাকে। কিন্তু কেইন এই রোজবাড দিয়ে কী বুঝাতে চেয়েছিলেন?
এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার মধ্য দিয়ে ফিল্মের গল্প বলা হয়। ফিল্মের গল্প বলতে কেইনের গল্প। রিপোর্টার জেরি থম্পসনের উপর দায়িত্ব পড়ে এই রোজবাড রহস্য উন্মোচন করার। তিনি জানতে পারেন কেইনের শৈশব কেটেছে দারিদ্রের মধ্যেই। হঠাৎ তার মা জমিতে সোনার খনি পান এবং এরপরে কেইনকে পাঠিয়ে দেন শহরে পড়ালেখার জন্য ব্যাংকার ওয়াল্টার পার্ক থ্যাচারের তত্ত্বাবধানে।
কেইনের পার্সোনাল বিজনেস ম্যানেজার মিস্টার বার্ন্সটাইন, কাছের বন্ধু জেদিদাহ এবং সাবেক স্ত্রীর কাছে যান থম্পসন। তাদের কথায় উঠে আসে চার্লস ফস্টার কেইনের সংবাদপত্র ব্যবসায় চলে আসায়, তার সামাজিক দায়িত্ব পালনের ইচ্ছা এবং পরবর্তীতে ক্ষমতা অতি আকাঙ্খায় হলুদ সাংবাদিকতায় জড়িয়ে যাওয়া।
বিভিন্ন বক্তা থাকায় ফিল্মের গল্পটি বিভিন্ন দিক থেকে দেখা হয়, যেমন হয়েছিল আকিরা কুরোসাওয়ার রাশোমনে। তবে এখানে কেইনের চরিত্রটিই মূল বিষয়, তার ক্ষমতাকাঙ্খা, আত্মপ্রেম এবং মৃত্যু কালে মনে হওয়া ‘রোজবাডের’ স্মৃতি।
রেবেকা
আলফ্রেড হিচকক
রেবেকা এক রহস্যময় নারী চরিত্র, যাকে ফিল্মে দেখা যায় না। ফিল্মের গল্প শুরু হবার আগেই তার মৃত্যু হয়েছে। ম্যাক্সিম ম্যাক্সিমিলিয়ান ডি উইন্টার সাহেবের প্রথম বউ ছিলেন তিনি। ডি উইন্টার দ্বিতীয় বিয়ে করেন এক সাধারণ মেয়েকে, এবং তাকে নিয়ে যান তার বিশাল প্রাসাদ ম্যান্ডারলিতে। সেখানে ছড়িয়ে আছে রেবেকার স্মৃতি, এবং সেই রেবেকা রহস্যের দিক উন্মোচিত হতে থাকে ফিল্ম যত এগিয়ে যায় ততো।
ফিল্মের নির্মান গথিক স্টাইলে। ভয় ভয় আবহ বিদ্যমান। প্রধান নারী চরিত্রের অভিনয় ভালো এবং বিশেষত ডি উইন্টার সাহেবের হাউজকিপার মিসেস ডেনভারের অভিনয় ভীতিজনক। এই মিসেস ডেনভার ছিল রেবেকার অতি ভক্ত।
রেবেকার কী হয়েছিল বা কেন রেবেকা এত রহস্যময় তা বলে দিলে ফিল্মেরই সবই বলে দেয়া হয়। ফলে সে পর্যন্ত যাচ্ছি না আর।
দ্য লাস্ট অব শীলা
হার্বার্ট রস
শীলা ছিলেন একজন গসিপ কলামনিস্ট। একরাতে পার্টি থেকে তিনি রাগ করে বেরিয়ে যান, হয়ত অল্প মাতালও ছিলেন। রাস্তায় একটা গাড়ি এসে তাকে ধাক্কা দেয়। তিনি মারা যান। এভাবেই শুরু হয় দ্য লাস্ট অব শীলা ফিল্মটি।
শীলার জামাই এর এক বছর পরে ঐ পার্টিতে তাকা বন্ধুদের সবাইকে আবার আমন্ত্রণ জানান ফ্রান্সে। শিলার জামাই একজন মুভি প্রডিউসার, এবং বন্ধুদের আবার আমন্ত্রণ করে নিয়ে আসার পিছনে তার একটি সূক্ষ্ণ পরিকল্পণাও ছিল। সে জানত যে এদের মধ্যে কেউ একজন ঐদিন রাতে শীলাকে গাড়ি চাপা দেয় অথবা তা বের করতেই সে এক অদ্ভুত খেলার পরিকল্পণা করে।
সে সবাইকে একটি করে কার্ড দেয়। সেই কার্ডগুলিতে একেকটি গোপন বিষয় লেখা আছে। যেমন, হোমোসেক্সুয়াল, চাইল্ড মলেস্টার, শপ লিফটার ইত্যাদি। এগুলি এদেরই একেকজনের সিক্রেট। প্রতি রাতে একটা কার্ডের ক্লু দেয়া হবে এবং তারা খুঁজতে বের হবে। শীলার জামাইয়ের ক্লু অনুসরন করে যারা সেইদিনের কার্ড এর সিক্রেট ও কার্ডধারী বের করতে পারবে সে পয়েন্ট পাবে। খেলার নিয়ম নিজের কার্ড অন্যকে দেখানো যাবে না, এবং অন্যদের সিক্রেট বের করতে হবে।
এই মোটামোটি দ্য লাস্ট অব শীলা ফিল্মের বেইজ, এর উপর ভিত্তি করে ফিল্মের গল্পটি বাড়তে থাকে।
এটি একটি ভিন্নরকম থ্রিলার ফিল্ম। পরিচালক হার্বার্ট রস।
রিফিফি
জুলস ডাসিন
রিফিফি একটি দারুণ হেইস্ট থ্রিলার মুভি। অগাস্ত লি ব্রেটন এর একই নামের উপন্যাসের উপর ভিত্তি করে এই ফিল্মটি নির্মান করেন জুলস ডাসিন।
ফিল্মের গল্প একটি অলংকারের দোকানে চুরি এবং তৎপরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে। প্রধান চরিত্র টনি, এই চরিত্রে অসাধারন অভিনয় করেছেন যে অভিনেতা তার নাম জ্যা সারবেইজ। টনি একজন গ্যাংস্টার যে আরেকটু অলংকার চুরি ঘটনায় পাঁচ বছর জেল খেটে বেরিয়ে এসেছে। সে এবং তার দুই বন্ধু মিলে পরিকল্পনা করে একটি জুয়েলারি শপে চুরি করার। তারা হায়ার করে এক ইতালিয়ান সেইফক্র্যাকারকে। এক রাতে শুরু হয় তাদের অভিযান।
পুরো চুরি প্রক্রিয়াটি, অর্থাৎ ছাদের পর দিয়ে গর্ত করে ভেতরে ঢোকা পুরোটাই দেখানো হয়। এরকম গর্ত করা দ্য হোল ফিল্মেও দেখা গিয়েছিল, কিন্তু সেটা ছিল কয়েদিদের জেল থেকে পালানোর জন্য। এখানে চুরির জন্য কৌশলী গর্ত করা হয় এবং এর জুয়েলারি শপের ভেতরে প্রবেশ করে চুরি কর্ম সমাধা হয়।
টনি বিপক্ষ শক্তি আরেক গ্যাংস্টার। পিয়েরে গাটার, যে গাটার গ্যাং এর নেতা ও একটি নাইটক্লাব চালায়। তার আরেকটি ব্যাপার হলো টনি জেলে যাবার পর টনির গার্লফ্রেন্ডের সাথে এই গাটারের সম্পর্ক তৈরী হয়, ফলে গাটার ও টনির আগে থেকেই শত্রুতা ছিল।
টনি চরিত্রে অভিনয়কারী গ্যাংস্টার আবেগহীন এক চরিত্র। তাকে হাসি বা দুঃখ কিছুই স্পর্শ করে না। সে ঠান্ডা মাথায় ও ধীরে কাজ করে। অভিনেতা যখন ফিল্মটি করেন তখন তার কেরিয়ার প্রায় শেষ হয়ে গেছে এলকোহলিজমের কারণে। সম্ভবত এই মাদকাসক্তির একটা ছাপ তার মুখে ও কথায় ছিল, যা ফিল্মের চরিত্রটির সাথে অসাধারণভাবে মানিয়ে গেছে।
গল্পের কাহিনী খুব অপরিচিত কিছু নয়। যে উপন্যাসটি থেকে ফিল্মটি নির্মিত তাও বাজে উপন্যাস হিসেবে পরিচিত ছিল, এমনকী পরিচালক নিজেও তা অপছন্দ করতেন। স্বল্প বাজেটে, কোন স্টার ছাড়াই ছবিটি তিনি নির্মান করেছিলেন ফ্রান্সে, হলিউডে কম্যুনিস্ট ধারার হবার কারণে ব্ল্যাকলিস্টেড হবার পর। এটি ছিল পাঁচ বছরের মধ্যে তার প্রথম ফিল্ম। হলিউডে ব্ল্যাকলিস্টেড হবার পর ইউরোপে ফিল্ম নির্মানে আসার পর তিনি কয়েকটি নির্মানে হাত দিয়েছিলেন কিন্তু আমেরিকান সরকার ও এম্বেসীর চাপে সেগুলি করতে পারেন নি। পরবর্তীতে ফ্রান্সে এই ফিল্মটি করার সুযোগ পান।
এই ছবিটিই ব্যাপক সাফল্য পায়, এবং পরিচালককে এনে দেয় কান চলচ্চিত্র পুরস্কার ১৯৫৫ সেরা পরিচালকের খেতাব। ফ্রেঞ্চ স্টাইলিশ ক্রাইম ড্রামার একটি সর্বকালের সেরা হিসেবে ফিল্মটিকে ধরা হয় এখন। ফিল্ম ক্রিটিক রজার এবার্টের মতে টরান্টিনোর রিজার্ভার ডগস এবং স্ট্যানলি কুবরিকের দ্য কিলিংস এ রিফিফির প্রভাব দেখা যায়।