মুরাদুল ইসলাম » ব্লগ » আগুনের উপর হাঁটা, ফায়ারওয়াকিং কি ভুয়া?

আগুনের উপর হাঁটা, ফায়ারওয়াকিং কি ভুয়া?

বাংলাদেশের ক্রিকেটার নাইম শেখ জ্বলন্ত কয়লার উপর হেঁটেছেন, এই ভিডিও দেখলাম। এর আগে বাংলাদেশের সেরা ফাস্ট বোলার তাসকিন আহমেদ এইভাবে আগুনের উপর হেঁটেছিলেন। তাদের এগুলি করাইতেছেন একজন মটিভেশনাল গুরু, যার নাম সাবিত, পেইজের নাম সাবিত ইন্টারন্যাশনাল।

এই জ্বলন্ত কয়লার উপর হাঁটা, ফায়ারওয়াকিং প্রাচীন হিন্দু ধর্মের রিচুয়ালে ছিল, কালাহারি মরুভূমির আদিবাসীদের মধ্যে ছিল। আরও অনেক ডেঞ্জারাস রিচুয়াল নানা ধর্মে থাকে। যেমন, ফিলিপাইনের এক দল খ্রিস্টান আছেন যারা নিজেদের ক্রুশেই বিদ্ধ করে ফেলেন, হিন্দু ধর্মের শক্ত ধাতব হুক চামড়ার মধ্যে ঢুকিয়ে তারা শূন্যে ঝুলে যান উৎসবের দিনে। পিঠের চামড়ায় লোহার হুক ঢুকিয়ে রথ টেনে নিয়ে যান। অর্থাৎ, ধর্মসমূহে ডেঞ্জারাস রিচুয়াল কোন নতুন ঘটনা না।

কিন্তু এই মটিভেশনাল ফায়ার ওয়াকিং জিনিশটার মাহাত্ম্য কী? ক্যামনে কাজ করে?

১৯৭০ এর দশকে এটা আমেরিকায় পপুলার হইতে শুরু করে। টলি বুরকান নামে এক লোক এটা পপুলার করেন।

যারা এটি করান তারা দাবী করেন, এই ফায়ারওয়াকিং ভয় থেকে মুক্ত হতে সাহায্য করে, আত্মবিশ্বাস বাড়ায়।

সাধারণত উত্তপ্ত কয়লা বা আগুনে মানুষের ভয় থাকে। যখন সে আগুনের উপর হাঁটতে যায়, তিনটা পর্যায়ে এটা কাজ করে। এক, সে তার চিন্তার লিমিট বুঝতে পারে। দুই, ভয়রে পরাজিত করার উপায় তারে বের করতে হয়। তিন, যখন সে হাঁটে তখন সে ভয়ের বাঁধা দূর করার শক্তি পায়, যেটা তার লাইফের অন্যান্য ক্ষেত্রেও পজিটিভ চিন্তায় সাহায্য করে।

এইগুলা দাবী করেন এইটা যারা করান তারা।

যারা এই আগুনে হাঁটা প্রক্রিয়ায় যান, তাদের অনেকে জানান তাদের লাইফে পজিটিভ প্রভাব ফেলছে। ভয়, দুশ্চিন্তা দূর করছে, আত্মবিশ্বাস বাড়াইছে, ইত্যাদি।

কিন্তু, এই ফায়ারওয়াকিং যে কাজ করে এর বিশেষ কোন বিজ্ঞান ভিত্তিক প্রমাণ নাই।

সাইন্টিফিক্যালি দেখলে, এটা আসলে যে কেউ পারবে, এর মধ্যে বিশেষ কিছু নাই। কারণ কয়লার তাপ পরিবহন ক্ষমতা কম। কয়লার জায়গায় যদি হাই থার্মাল কনডাক্টিভিটির স্টিল থাকতো, তাহলে কনফিডেন্স ধোঁয়া হয়ে উড়ে যাইত।

আপনারা অনেকেই জ্বলন্ত মোমবাতি হাঁট দিয়া নিভাইছেন। যেখানে মোমবাতির উত্তাপ ১৫০০ ডিগ্রি ফারেনহাইট পর্যন্ত হতে পারে, জ্বলন্ত কয়লা ৯০০ ডিগ্রি ফারেনহাইটে থাকে।

যারা এটি করায় তারা কয়লার উপরে এক ধরণের ছাই ঘন আস্তরণ দিয়ে দেয় যাতে উত্তাপ ছড়াতে না পারে।

পা উত্তপ্ত হবার প্রসেস ধীর, এবং ওইখানে তাপমাত্রা থাকে কম, কয়লা তাপের বাজে পরিবাহক, তাই, পা গরম হইতে হইতে আপনি হেঁটে চলে যান।

কিন্তু ওইখানে যদি দাঁড়িয়ে থাকে কেউ, তাহলে পুড়ে যাবে।

বড় কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের নানা চেষ্টা থাকে এমপ্লয়ি মোটিভেশন বাড়ানোর। এই ফায়ার ওয়াকিংও কর্পোরেট দুনিয়ার কিছু জায়গায় গৃহীত হয়। সব সময় যে কাজ হবার জন্য তারা এগুলা করে এমন না, অনেক সময় হয় ভাঁওতাবাজির জন্য বা জাস্ট ট্রেন্ডে থাকতে। গত বছর সুইজারল্যান্ডের এক এড এজেন্সি তার এমপ্লয়ীদের কনফিডেন্স বাড়াতে ফায়ারওয়াকিং করে, পরে ১২ জনরে হাসপাতালে নিতে হয়। দশটা এম্বুলেন্স, দুইটা এমারজেন্সি মেডিক্যাল টিম, নানা এজেন্সির পুলিশ আসে দূর্ঘটনা সামলাতে।

সাধারণত এই ধরণের মোটিভেশন ব্যবসায়ীরা নাকি ১৫ ফিট কয়লা বিছায়। নাইম শেখের ভিডিওতে দেখলাম আরো কম বিছাইছেন তারা। কয়লাতে তার তিনটা স্টেপ পড়ছে মাত্র!

সাইকোলজিস্ট রিচার্ড ওয়াইজম্যান একবার ঠিক করলেন এটা পরীক্ষা করে দেখা হবে। বিবিসিতে তার শোতে তিনি ফায়ারওয়াকিং এর আয়োজন করলেন।

রিচার্ড ওয়াইজম্যান বিছাইছিলেন ৬০ ফিট। আর তিনজন টপ কয়লার উপর হাঁটা মোটিভেশন বিক্রেতাকে আনলেন।

প্রথম জন বিশ ফিট গিয়াই লাফাইয়া সরে গেল। দ্বিতীয়জনও বিশ ফিট। তৃতীয় জন আর অংশ নেন নাই। সেকন্ড ডিগ্রি বার্নে প্রথম দুইজনরে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

ওয়াইজম্যান তখন বলছিলেন, মেন্টাল স্ট্রেংথ দেখি ১৮ ফিটে শেষ হয়ে যায়!

লম্বা হইলে কেন হাঁটা যায় না? কারণ বেশী সময় থাকলে কয়লা থেকে তাপ পরিবাহিত হয়ে পা পুড়াইয়া দেয়।

এই ফায়ারওয়াকিং এর জিনিশটা ধাপ্পা, সাবিত ইন্টারন্যাশনালের মার্কেটিং। কতো মানুষ যে এগুলা দেখে তাদের কাছে গিয়া ভীড়বে! যে পজেটিভ চেইঞ্জ আসে, যদি আসে আর কি, তা প্লাসিবো ইফেক্ট, সে বিশ্বাস করে তাই কাজ করে।

Leave a Comment

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

×
গুরুত্বপূর্ণ
Scroll to Top
বই মডেলিং