বিভিন্ন ধরনের চিন্তার উপায় আছে। এর মধ্যে শক্তিশালী একটি উপায় হচ্ছে ইনভার্স থিংকিং। অর্থাৎ, কোন ঘটনা নিয়ে চিন্তা করার সময় তা উলটে দিয়ে চিন্তা করা। যেমন, আমার বই সফল হবে কীভাবে, না ভেবে ভাবা, কীভাবে আমার বই ব্যর্থ হতে পারে। তখন কীভাবে বই ব্যর্থ হতে পারে সেই বিষয়গুলি সামনে আসবে, এবং সেগুলি এড়িয়ে চললেই হবে। বই নিয়ে উদাহরণ দিলাম, কিন্তু প্রায় যেকোন সমস্যা নিয়ে এভাবে ভাবা যায়। গণিতবিদ জাকোবি এই চিন্তার জন্য বিখ্যাত ছিলেন।
আরেক ধরনের চিন্তা হলো কোন সমস্যার একেবারে মূল নিয়ে ভাবা। যেমন, ইলন মাস্ক ২০০২ তে মঙ্গলে প্রথম রকেট পাঠানোর জন্য তার কাজ শুরু করলেন। এই কাজে তিনি পৃথিবীর নানা রকেট কোম্পানি ঘুরে বেড়ালেন। দেখলেন একটি রকেটের দাম প্রায় ৬৫ মিলিয়ন ডলার। মাস্ক তখন রকেট নিয়ে ভাবতে বসলেন।
একটা এমন রকেট কী দিয়ে বানানো হয়, তিনি ভাবলেন।
তার কথায়, “আমি কোন জিনিস পদার্থবিদ্যার ফ্রেইমওয়ার্কে ভাবতে পছন্দ করি। পদার্থ বিজ্ঞান তুলনা দিয়ে বুঝার চাইতে মূলনীতি দিয়ে বুঝতে চায়। তাই আমি বললাম, ঠিক আছে, দেখা যাক রকেট বানাতে কী কী লাগে। এরোস্পেস গ্রেডের এলুমিনিয়াম শংকর, কিছু টাইটেনিয়াম, কপার, কার্বন ফাইবার। তারপর নিজেকে প্রশ্ন করলাম, এই জিনিসগুলির দাম কতো সাধারণ পণ্য বাজারে? দেখা গেল একটা সাধারণ রকেটের মূল বস্তুগুলির দাম মূল রকেটের দামের মাত্র দুই শতাংশ।”
ইলন মাস্ক রকেট কেনার পরিকল্পনা বাদ দিলেন, রকেট বানানোর কাজে হাত দিলেন। কাচামাল কম দামে কিনে নিজের কোম্পানি থেকে রকেট বানালেন। জন্ম হলো স্পেইস-এক্স এর।
কয়েক বছরের মধ্যে স্পেইস-এক্স নিজেদের লাভ রেখেও রকেটের দাম কমিয়ে ফেললো দশগুণ। ইলন মাস্ক এখানে যে পদ্বতি কাজে লাগিয়েছেন এবং রকেটের উচ্চমূল্যকে পাশ কাটিয়ে কম মূল্যে রকেট তৈরী করতে পেরেছেন, এটা হলো মূলনীতি ভিত্তিক চিন্তা। কোন সমস্যার একেবারে মূলে কী আছে।
তবে এই ধরনের চিন্তা নতুন না। বহু পুরাতন। এরিস্টটল এটি প্রয়োগ করতেন। তিনি এর সংজ্ঞা হিসেবে বলেছেন, “কোন বস্তুর একেবারে প্রথম মূল ভিত্তি, যা থেকে শুরু তার পরিচয়।”
মানে ধরা যাক, সমস্যাটিকে খুড়ে যেতে হবে, এবং একেবারে শেষ মূল সত্য বা মূলবস্তুগুলিকে বের করতে হবে।
রেনে দেকার্তে যেমন সব কিছুকেই সন্দেহ ও প্রশ্ন করতে করতে, একেবারে শেষের যে পরম সত্য, যাকে আর সন্দেহ ও প্রশ্ন করা যায় না, সেখানে যেতেন। একে বলে কার্তেসিয়ান ডাউট।
তবে সাধারনত আমাদের রেনে দেকার্তের মত এত গভীরে যেতে হবে না।
জন বয়েড নামের ফাইটার পাইলট ও মিলিটারী স্ট্র্যাটেজিস্ট এর কথায় বিষয়টা এরকমঃ
১। আপনার আছে একটি মটরবোট, সাথে স্কিয়ার।
২। আছে মিলিটারি ট্যাংক।
৩। এবং একটি বাই সাইকেল।
এখন, দেখা যাক, এগুলিতে আলাদা আলাদা কী কী যন্ত্রাংশ আছেঃ
মটরবোটঃ মটর, বোটের কাঠামো, একজোড়া স্কিয়ার।
মিলিটারি ট্যাংকঃ মেটাল ট্রেডস, ধাতুর তৈরী বর্ম, বন্দুক।
বাই সাইকেলঃ হ্যান্ডেল, চাকা, গিয়ার, সিট।
আপনি এই যন্ত্রাংশগুলি দিয়ে কী বানাতে পারেন? সাইকেলের হ্যান্ডেল আর সিট, ট্যাংকের মেটাল ট্রেড আর মটরবোটের মটোর আর স্কি নিয়ে বানাতে পারেন একটি স্নোমোবিল (বরফে চলা গাড়িবিশেষ)।
সংক্ষেপে এটাই মূলনীতি ভিত্তিক চিন্তা। সাধারণভাবে দেখলে বাই সাইকেল ও মিলিটারী ট্যাংকের মধ্যে কোন সম্পর্ক নেই, কিন্তু মূলনীতি ভিত্তিক চিন্তা করলে এদের থেকে স্নোমোবিল বানানো যায়।
মোভেবল টাইপ নামে এক ধরনের ছাপানোর পদ্বতি শত বছর ধরে চালু ছিল। জোহানেস গুটেনবার্গ সেই ছাপার পদ্বতিটির সাথে ওয়াইন বানানোর মেশিনের স্ক্রু প্রেস, কাগজ ও কালি মিলিয়ে বানিয়ে ফেললেন ছাপার যন্ত্র বা প্রিন্টিং প্রেস। মানব সভ্যতার এক অন্যতম বড় আবিষ্কার যা সভ্যতার উপর প্রভাব ফেলেছে মারাত্মকভাবে।
মূলনীতিতে গিয়ে, বিভিন্ন ডিসিপ্লিন ব্যবহার করে এই ধরনের চিন্তা উদ্ভাবনী পরিবেশ তৈরী করে। আর উদ্ভাবনই একমাত্র জিনিস যা কিছু মানুষকে অন্যদের চাইতে এগিয়ে নিয়ে গেছে মানব সভ্যতায়।
অধিকাংশ ক্ষেত্রে মূলনীতি ভিত্তিক চিন্তার বাঁধা হলো মানুষ, ফর্ম নিয়ে বেশী চিন্তা করে কিন্তু ফাংশন নিয়ে ভাবে না। যেমন, রোমানরা কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে খাদ্য নিয়ে গ্রামীন বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়াত। কিন্তু রোমে তখন চাকাওয়ালা নানা ধরনের গাড়ির প্রচলন ছিল।
কিন্তু কেউ ভাবে নি চাকার সাথে ব্যাগ যুক্ত করে টেনে নেয়া সম্ভব, ও সহজতর।
এরকম চাকাওয়ালা ব্যাগের আবির্ভাব ১৯৭০ সালে, বার্নার্ড শেডো প্রথম ব্যাপারটি লক্ষ করেন। তিনি এক এয়ারপোর্টে দেখতে পেয়েছিলেন এক শ্রমিক ভারী মেশিনকে চাকাযুক্ত করে টেনে নিয়ে যাচ্ছে।
কিন্তু ১৮০০ থেকে ১৯০০ পর্যন্ত ব্যাগে অনেক উদ্ভাবন হয়েছে। চেইন এসেছে, স্যুটকেস, স্কুলব্যাগ, ট্র্যাভেল ব্যাগ…সবাই ব্যাগের আকার নিয়েই ভেবেছেন। কিন্তু চেইন লাগিয়ে তার কাজকে সহজতর করার প্রক্রিয়া বের করতে অপেক্ষা করতে হয়েছে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত।
উদ্ভাবনের মত হলেও ব্যাগের আকার, সৌন্দর্য বর্ধন এগুলি তেমন উদ্ভাবনই ছিল না, কারণ এগুলি ফাংশন বা কাজকে সহজ করে নি। অবশেষে শেডো ব্যাপারটি বুঝতে পারেন, এবং ফাংশনের দিকে তাকিয়েই তিনি উদ্ভাবন করেন।
পুরনো, প্রচলিত ধারণা, যেগুলি একজন মানুষ প্রশ্নহীনভাবে ধারণ করে, এগুলি সম্পর্কে তার সচেতন থাকা দরকার। কারণ এগুলি তার সৃষ্টিশীলতার সীমা বেঁধে দেয়, এবং অন্ধ করে তোলে।
একজন যে ফিল্ডে আছেন, তার একেবারে মূল নীতিগুলি যদি তিনি জানেন, তাহলে তা তার জন্য মঙ্গলজনক। কারণ মূলনীতি না জানলে ঐ বিষয় সম্পর্কে তিনি খুব বেশী জানতে পারবেন না, বা তার জানাটা শক্ত হবে না।
সমস্যার সমাধানের ক্ষেত্রে, বা এ সংস্লিষ্ট চিন্তার ক্ষেত্রে মূলনীতি ভিত্তিক চিন্তা একটি চিন্তার উপায়।
—
অন্যান্য মানসিক নকশাগুলি এখানে।