ফ্রয়েডের মোজেস ও একেশ্বরবাদ একটা ইন্টারেস্টিং বই। এখানে একেশ্বরাদের উৎপত্তি, ইহুদি জাতির উপরে ইজিপশিয়ান মোজেসের প্রভাব, ইহুদিদের উপর খ্রিস্টানদের বিদ্বেষের মনস্তাত্বিক কারণ ইত্যাদির সাথে মানুষের মধ্যে ধর্মের উৎপত্তি নিয়ে কিছু কথা আছে।
ফ্রয়েড প্রথমেই দেখাতে চেয়েছেন মোজেস ইহুদি জাতি উদ্ভূত না। তিনি ইজিপশিয়ান একজন ভাগ্যাহত অভিজাত। এক্ষেত্রে তিনি মোজেস নামটি একটি ইজিপ্সিয়ান নাম দেখিয়েছেন। আখনাটন নামে একজন ফারাও প্রথম পুরাতন ধর্ম ভেংগে দিয়ে সূর্যের পুজা শুরু করেন। এটা ছিল প্রথম একেশ্বরবাদ। তিনি কঠোরভাবে ধর্ম প্রচার করেন। সব মন্দির ভেংগে দিয়ে যাদুবিদ্যা ইত্যাদি নিষিদ্ধ ঘোষনা করেন।
তার এই ধর্ম সংস্কারের ফলে মিশরের পুরোহিত এবং অভিজাত লোকেরা তাকে সিংহাসনচ্যূত করে। এই আখনাটনের একজন সহচরের নাম ছিল তুতমিস। তুতমিসের নামের শেষে মোজেস যুক্ত ছিল। তিনি তার রাজার নতুন ধর্মে খুব আস্থা রাখতেন। আখনাটন রাজ্যচ্যূত হবার পর এই মোজেস রাজ্য ছেড়ে চলে যান এবং একদল প্রায় মূর্খ যাযাবর জাতির লোকদের গিয়ে বলেন ঈশ্বর তোমাদের পছন্দ করেন।
তিনি এই নতুন জাতির মধ্যে আখনাটন বা ইখনাতনের ধর্ম প্রচার করেন। এসময় তিনি কঠোরভাবে কিছু নীতি আরোপ করেন। যেমন পূর্বে সূর্য যখন দেবতা ছিল তখন তার রূপ কল্পনা করা যেত। মোজেস ঈশ্বরের রূপ কল্পনা নিষিদ্ধ করলেন। মোজেস এই জাতিকে নিয়ে নীলনদ অতিক্রম করে গিয়ে বসতি স্থাপন করেন। তার প্রচলিত একেশ্বরবাদী ধর্মে রীতি নীতি কঠোর ছিল এবং তিনি একটি যাযাবর জাতির উপর তা চাপিয়ে দিয়েছিলেন।
এতে এক সময় এরা বিদ্রোহী হয় এবং তাকে হত্যা করে। ইজিপ্সিয়ান মোজেসকে ; যিনি একটি সুসংহত একেশ্বরবাদ প্রচার করেছিলেন তিনি মারা যান দলের লোকেরা তার ধর্ম ও ত্যাগ করে। অন্য একটি জাতির সংস্পর্শে এসে তারা আগ্নেয়গিরির দেবতার আরাধনা শুরু করে। কয়েকশ বছর চলে যায় এভাবে।
এরপর তাদের পাশের জাতির একটি বুদ্ধিমান ও স্থিতধি লোক পর্বতে গিয়ে আগ্নেয়গিরির দেবতার কাছ থেকে টেন কমান্ডমেন্টস নিয়ে আসে। সে লোকটির নামও ছিল মোজেস। ইজিপ্সিয়ান মোজেস ছিলেন বদমেজাজি ও কর্তৃত্বপরায়ণ। আর এই মোজেস ছিলেন স্থির ও ন্যায়পরায়ণ। ইহুদিদের গ্রন্থে মোজেসের বিপরীতধর্মী চরিত্রের এটাই কারন।
তবে এসব গ্রন্থ বার বার পরিবর্তন করা হয়েছে। মোজেসের সাথে ইজিপ্টের সম্পর্ক মুছে ফেলা হয়েছে।
মোজেস ইজিপ্টের ছিলেন এবং তিনি ইজিপ্টের একটি ধর্ম প্রচার করেছেন তার পিছনে শক্ত যুক্তি হিসেবে ফ্রয়েড এনেছেন খতনা বা সুন্নতের প্রথার কথা। এটা মিশরে প্রচলিত ছিল। মিশরীয়রা নিজেদের অন্য জাতি থেকে আলাদা মনে করত। তাই এই প্রথাটা ছিল তাদের অন্যদের থেকে পবিত্র থাকার চিহ্ন। মোজেস ধর্ম প্রচার করার সময় প্রথাটা রেখে দিয়েছিলেন। এই প্রথারও একটি মনস্তাত্বিক ব্যাখ্যা ফ্রয়েড দিয়েছেন।
নতুন মোজেসের ধর্ম কিছুদিন চলার পর ইজিপ্সিয়ান মোজেসের একেশ্বরবাদী ধর্ম ফিরে আসতে শুরু করে। ওই জাতি মনে করতে থাকে তারা তাদের পিতাকে হত্যা করেছে। যিনি মহান ছিলেন এবং ছিলেন তাদের মুক্তিদাতা। ইজিপ্সিয়ান মোজেসের শেখানো রীতিনীতি আকড়ে ধরে। পিতা হত্যার অনুশোচনা থেকে তারা মোজেসের প্রতি আরো অনুরক্ত হয়।
এদের মধ্যে আবার একজন লোক একবার ঘোষনা দেয় অনেক আগে মোজেস হত্যার অপরাধের প্রায়শ্চিতের জন্য একজন মহাত্মা আত্মাহুতি দিয়েছেন। অতএব আর অনুশোচনার দরকার নেই। এর মাধ্যমেই খ্রিস্টান ধর্মের সূত্রপাত।
মোজেসের অনুসারী ইহুদিদের একটা অংশ তা মেনে নেয় নি। তারা পূর্বের ধর্ম থেকে সরে নি। এরাই এখনো ইহুদি। খ্রিস্টান ধর্ম একেশ্বরবাদী ধর্ম থেকে উদ্ভুত হলেও মূলনীতি থেকে সরে যায়। তারা বিভিন্ন বহুইশ্বরবাদী ধর্ম থেকে অনেক রীতি গ্রহণ করে।
[ প্রায় ছয়/সাত বছর আগে মোবাইলে লেখা। এই বইটি ফ্রয়েডের লেখা সর্বশেষ বই, ১৯৩৯ সালে প্রকাশিত হয়। ফ্রয়েড তার প্যাশেন্টদের রিপ্রেসড স্মৃতি যেভাবে এনালাইজ করতেন সাইকএনালিটিক পদ্বতিতে, একইভাবে তিনি এখানে জুদাইজমের ইতিহাস ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেন। বলাবাহুল্য তার এই প্রস্তাব বিতর্কিত হয়েছিল। ]