মুরাদুল ইসলাম » ব্লগ » মনস্তত্ত্ব ও মার্কেটিংঃ হেলো ইফেক্ট এবং কারণ দেখানো

মনস্তত্ত্ব ও মার্কেটিংঃ হেলো ইফেক্ট এবং কারণ দেখানো

যেখানে মানুষকে নিয়ে কাজ সেখানেই আসে মানব সাইকোলজি তথা মানুষের মনস্তত্ত্ব। যেমন, মার্কেটিং এ সাইকোলজি’র নানা বিষয় ব্যবহার করা হয় মানুষকে প্রভাবিত করার জন্য। অর্থনীতিতে বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে মনস্তত্ত্ব, মনস্তাত্ত্বিক অর্থনীতি’র নানা ত্তত্বের উপর এবং গবেষনার উপর ভর করে বিভিন্ন দেশে পাবলিক পলিসি ডিজাইন করা হচ্ছে।

সব ধরনের কোম্পানি, সরকার বা অন্য কোন প্রতিষ্ঠানের মনস্তাত্ত্বিক উপায়ে মানুষকে প্রভাবিত করার দুইটা ধরন আছেঃ

১। উইন-উইন- এই ধরনে যারা বিজ্ঞাপন দেয় বা ডিজাইন করেন তারা লাভবান হন। এবং যারা ভোক্তা তারাও লাভবান হন।

২। স্মাগলিং- যেখানে বিজ্ঞাপন দাতা কিংবা পন্য বিক্রেতাই লাভবান হন। যিনি ভোক্তা তার ক্ষতি হয়।

উইন-উইন ভালো এবং স্মাগলিং অবশ্যই খারাপ।

মনস্তত্ত্ব ও মার্কেটিং নামে নতুন বিভাগ শুরু করলাম। এখানে মনস্তত্ত্বের একাডেমিক রিসার্চের উপর ভিত্তি করে মার্কেটিং ও অন্যান্য বিষয় নিয়ে আলোচনা করার চেষ্টা করব। এবং আমরা যেসব বিজ্ঞাপন দেখে থাকি, বা অন্য কোন ভাবে কোম্পানিগুলি আমাদের যে প্রভাবিত করতে চায়, তার মধ্য থেকে উইন-উইন এবং স্মাগলিং দুইটাই দেখার চেষ্টা করব এই বিভাগের পোস্টগুলিতে।

এর পোস্টের বিষয়গুলি হবে মার্কেটিং, ডিজিটাল মার্কেটিং, মনস্তাত্বিক অর্থনীতি তথা মনস্তত্ত্ব এবং অর্থনীতি।

এখান থেকে যারা বিজ্ঞাপন দেন তারা উইন-উইন পদ্বতিতে তাদের বিজ্ঞাপনকে আরো কার্যকরী করার নানা উপায় বিষয়ে জানতে পারবেন। আর ভোক্তারা জানতে পারবেন স্মাগলিং শনাক্ত করা এবং এগুলি থেকে বেঁচে থাকার উপায় সম্পর্কে।

উপরের ছবিতে দেখা যাচ্ছে, আমাদের চিন্তার তথা সিদ্ধান্ত গ্রহনের বড় অংশটিই অবচেতনে। এখানেই কাজ করে নিউরোমার্কেটিং কোন সিদ্ধান্তের ব্যাপারে আমাদের প্রভাবিত করতে। মহিলাদের সিগারেট খাওয়ার সামাজিক ট্যাবু দূর করা তথা সিগারেটের বিক্রি বাড়ানোর জন্য এডওয়ার্ড বার্নে এই অবচেতনকে নিয়ন্ত্রণ করেছিলেন, যার বর্ননা এই লেখায় পাওয়া যাবে

 

বিজ্ঞাপন এনালাইসিস বা পর্যালোচনা

 

এই বিজ্ঞাপনটি কিছুদিন আগে আমার ফেইসবুক টাইমলাইনে এসেছিল। তখন স্ক্রিনশট নিয়ে রেখেছিলাম।

 

বিনোদন৬৯ নামে এক বিনোদন পত্রিকা ফেইসবুকে বিজ্ঞাপনটি দিয়েছেন। এখানে একটি ছবি ব্যবহার করা হয়েছে, যা বাংলা চলচ্চিত্রের একজন সর্বাধিক জনপ্রিয় নায়ক সালমান শাহ এর। সালমান শাহ এর ট্র্যাজিক মৃত্যু তাকে একজন ট্র্যাজিক হিরো’র অবস্থান দিয়েছে দর্শকদের মাঝে। এছাড়া তার ভালো অভিনয় তো ছিলোই। ফলে দেশের একটি বড় অংশের মানুষের পছন্দ এবং অনুভূতির খুব কাছাকাছি এই ছবি।

সালমান শাহ এর প্রতি পছন্দ, এবং ভালো লাগার অনুভূতির জন্য মানুষেরা এই পেইজে লাইক দিতে পারেন। কোন ব্যক্তি, বস্তু বা ব্র্যান্ড ইত্যাদি’র প্রতি ভালো লাগা’র জন্য তার সাথে যুক্ত অন্য একটি বিষয়ের প্রতি মানুষের ভালো লাগা তৈরী হয়। একে বলে হেলো ইফেক্ট।

হেলো ইফেক্ট এর ধারণা প্রথম দেন সাইকোলজিস্ট এডওয়ার্ড থর্নডাইক।[১] ১৯৭৪ সালে সাইকোলজিস্ট ল্যান্ডি এবং সিগাল[২] তাদের গবেষনায় দেখান যে, সুন্দরী নারীর চেহারা কীভাবে বিচারকদের পজেটিভলী প্রভাবিত করে। তারা ষাট জন আন্ডারগ্র্যাজুয়েট ছাত্রকে কিছু প্রবন্ধ বিচার করতে দেন। এগুলির মধ্যে ভালো লেখা ও খারাপ লেখা ছিল। তারা মোট তিনভাগে ভাগ করে, এক ভাগে যোগ করেন সুন্দরী নারী’র ছবি লেখক হিসেবে, আরেক ভাগে সুন্দর নয় এমন নারী’র ছবি লেখক হিসেবে এবং তৃতীয় ভাগে কোন ছবি দেন নি।

দেখা গেল বিচারকেরা সুন্দরী নারী লেখকদের প্রবন্ধগুলিকে বেশী মার্ক দিয়েছেন। ভালো প্রবন্ধ অসুন্দরী লেখক হলে যেখানে দেয়া হয়েছে ৫.৯ সেখানে সুন্দরী লেখক হলে ৬.৭!

অর্থাৎ, মানুষ তার ব্যক্তিগত ভালো লাগার উর্দ্ধে উঠতে পারে না। সুন্দর চেহারার মানুষ দেখে আমরা মানষেরা তাকে বেশী সুখী, ভালো গুণযুক্ত ইত্যাদি মনে করি। অসুন্দর চেহারার হলে তার সাথে খারাপ গুন যুক্ত করে দেখি। সাইকোলজিস্ট ডাইয়ন এবং তার কলিগেরা ১৯৭২ সালের একটি গবেষনায়[৩] এমনি ফলাফল পান।

এজন্য লোকে বলে “চোরের মত চেহারা!”। কিন্তু এই চোরের মত চেহারাটা কী? চোর বা যিনি চুরি করেন তিনি নিশ্চয়ই আলাদা প্রজাতির কোন মানুষ না। আর বহু সুন্দর চেহারা’র মানুষ আছেন যারা অসুন্দর চেহারার মানুষদের চাইতে বেশী কার্যকর ভাবে চুরিকর্ম সমাধা করে থাকেন।

আমাদের এই হেলো ইফেক্ট এর জন্যই হয়ত রূপকথায় বা ফিল্মে ভিলেনদের খুবই কুৎসিত চেহারার দেখানো হয়। আর নায়ককে দেখানো হয় খুবই সুন্দর চেহারার।

যাইহোক, শেষ একটি কথা বলে আবার বিজ্ঞাপনে ফিরে যাবো। হেলো হচ্ছে একধরনের গোলাকার চাকতি। প্রাচীন শিল্পকর্মে কোন ধর্মীয় পবিত্র মানুষের মাথায় এই চাকতি দেয়া হতো।

গৌতম বুদ্ধ
গান্ধারা ভাস্কর্য, বুদ্ধ। তার মাথার পিছনে চাকতি দেখা যাচ্ছে। ১-২ সেঞ্চুরী এডি।

 

প্রথমত এই বিজ্ঞাপনে হেলো ইফেক্ট কাজ করবে। একটি বিনোদন পত্রিকা হিসেবে হয়ত সালমান শাহ এর ছবি পত্রিকাটি ব্যবহার করতে পারে।

কিন্তু কেবলমাত্র ছবি দিয়ে অনুভূতিতে স্পর্শ করা হয় নি বিজ্ঞাপনটিতে। ছবির বর্ননায় বলা হয়েছে “সালমান শাহ এর ভক্তরা এখনো যদি তাকে ভালোবাসেন তাহলে আমাদের লাইক দিয়ে সাথে থাকুন।”

এটা অযৌক্তিক এবং হাস্যকর শোনায়। যেন হঠাৎ আপনার সাথে একজনের দেখা হলো, সে বলল আপনি যদি সালমান শাহকে লাইক করেন তাহলে আমার এই কাজটি করে দিন। অযৌক্তিক না?

কিন্তু বিজ্ঞাপনের মনস্তাত্ত্বিক ট্রিক হিসেবে এটি কার্যকরী। মানুষ কারণ চায়। আপনি তাকে যত অযৌক্তিক কারণই দিন না কেন, তাতে কারণ না দেয়ার চাইতে বহুগুণ বেশী উপকার হবে।

যেমন রিজেকশন থেরাপি’তে দেখা গেছে, কাউকে যেকোন অযৌক্তিক অনুরোধ করে যদি কোন কারণ দেখানো যায়, তা অযৌক্তিক হলেও লোকে বেশী রাজী হয়, কারণ না দেখানো অবস্থার চাইতে।

মজুমদার, রাজ এবং সিনহা ২০০৫ সালে তাদের গবেষণা প্রবন্ধে[৪] উল্লেখ করেন, ইডিএলপি স্টোরগুলি (যেমন ওয়ালমার্ট) প্রায়ই কোন ডিসকাউন্ট দিলে বা অফার দিলে তার কারণও উল্লেখ করে দেয়, প্রমোশনের ঋণাত্মক প্রভাব দূর করতে।

যেমন, ৮০% ছাড় দিচ্ছেন আপনি। কোন কারণ নেই। মানুষ মনে করতে পারে হয়ত কোন সমস্যা আছে। কারণ যদি না দেন, মানুষ কারণ কল্পনা করে নিবে। কারণ ছাড়া মানুষ কিছু নিতে পারে না, তার অস্বস্থি হয়। তাই আপনি যদি বলেন, ক্লিয়ারেন্স সেল বা এরকম কোন কারণ তাহলে ভালো।

ক্লিয়ারেন্স সেল ইত্যাদির ক্ষেত্রে সিচুয়েশনটা হয় উইন-উইন। ভোক্তারও লাভ হয়, বিক্রেতারও। কিন্তু আলোচ্য বিজ্ঞাপনটিতে যে কারণ দেখানো হয়েছে, তাতে ভোক্তার কোন লাভ নেই। এবং স্পষ্টত তাদের মনস্তাত্ত্বিক ভাবে ব্যবহার করা হয়েছে, এজন্য এটা উইন-উইন হয় নি।

 

উপসংহারঃ

যে বিজ্ঞাপনটি নিয়ে আলোচনা করা হলো তারা যে পড়ালেখা করে জেনে শুনেই এই সাইকোলজিক্যাল ট্রিকগুলি ব্যবহার করেছে, তা নাও হতে পারে। হতে পারে তারা অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছে এমন বিজ্ঞাপন বেশী গ্রহনযোগ্যতা পায়। এইসব ক্ষেত্রে সফলতার জন্য ট্রায়াল এন্ড এরর মেথডে কাজ করতে হয়। হয়ত তারা এভাবেই জেনেছে।

এই বিজ্ঞাপনটি নিয়ে লেখা হলেও তা কেবলমাত্র এই বিজ্ঞাপনটি নিয়েই নয়। আপনারা যারা ভোক্তা আছেন তারা হেলো ইফেক্ট ব্যবহার করে আপনাকে কেউ ভুল প্রভাবিত করছে কি না তা খেয়াল রাখতে পারেন। ধরেন, কোন মোটিভেশনাল স্পিকার তাহসানের সাথে ছবি দিল। তাহসান আপনার প্রিয় অভিনেতা ও গায়ক, ফলে আপনি ঐ মোটিভেশনাল স্পিকারের দ্বারা ভুলভাবে প্রভাবিত হচ্ছেন কি না, তার পন্য কারণ ছাড়াই কিনছেন কি না, পুনরায় ভাবতে পারেন।

 

রেফারেন্সঃ

[১] Thorndike, EL (1920), “A constant error in psychological ratings”, Journal of Applied Psychology, 4 (1): 25–29, doi:10.1037/h0071663.

[২] Landy, D; Sigall, H (1974), “Task Evaluation as a Function of the Performers’ Physical Attractiveness”, Journal of Personality and Social Psychology, 29 (3): 299–304, doi:10.1037/h0036018.

[৩] Dion, K; Berscheid, E; Walster, E (1972), “What is beautiful is good”, Journal of Personality and Social Psychology, 24 (3): 285–90, doi:10.1037/h0033731, PMID 4655540.

[৪] Tridib Mazumdar, S.P. Raj, Indrajit Sinha (2005) Reference Price Research: Review and Propositions. Journal of Marketing: October 2005, Vol. 69, No. 4, pp. 84-102, doi:10.1509/jmkg.2005.69.4.84

Leave a Comment

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

×
গুরুত্বপূর্ণ
Scroll to Top
বই মডেলিং