ইয়্যুবাল নোয়াহ হারারির নতুন বই ২১ শতকের জন্য ২১ শিক্ষা আজ ৪ সেপ্টেম্বর ২০১৮ তারিখে স্পাইজেল এন্ড গ্রাউ থেকে প্রকাশিত হয়েছে। বইটির এডুকেশন অধ্যায়ের ‘হ্যাকিং হিউম্যানস’ অংশ অনুবাদ করে দিলাম এখানে, এর গুরুত্ব বিবেচনা করে।
হ্যাকিং হিউম্যানস
যেই পোলার বয়স এখন পনের বছর, পড়তেছে দুনিয়ার কোন এক কোনায়, মেক্সিকো, ইন্ডিয়া বা আলাবামার কোন এক প্রত্যন্ত ইস্কুলে তারে আমার দেয়া বেস্ট উপদেশ কী হইতে পারে? বেস্ট উপদেশ হবে, বাবা, বড়দের উপর বেশি নির্ভর কইরো না। তারা যা বলে বা বুঝাইতে যায় অর্থাৎ তাদের উদ্দেশ্য খারাপ তা আমি বলি না। কিন্তু কথা হইল তারা নিজেরাই দুনিয়া বুঝে না। আগেকার দিনে বড়দের অনুসরণ করা আছিল নিরাপদ, কারণ তারা দুনিয়ারে বেশ ভালো রকমই বুঝতো। কিন্তু এখন হইতেছে কি, খুব দ্রুত, মানে খুবই দ্রুত সব বদলে যাইতেছে। তো এই দ্রুত বদলাইতে থাকা সময়ে, তুমি বাছাধন বুঝতে পারবা না বড়রা তোমারে দীর্ঘসময় ব্যবধানে অর্জিত প্রজ্ঞাংশ দিতেছে নাকি তাদের পুরান হইয়া যাওয়া মত আদর্শ ও পক্ষপাত তথা বায়াস ভইরা দিচ্ছে।
তো, তুমি কার উপর নির্ভর করবা বাপ? হয়ত প্রযুক্তির কথা ভাবতেছ? কিন্তু এইটা আরো ঝুঁকিপূর্ন জুয়া হয়। প্রযুক্তি অবশ্যই তোমারে অনেক সাহায্য করতে পারে। কিন্তু প্রযুক্তি যদি তোমার জীবনের উপর বেশি ক্ষমতা অর্জন কইরা ফেলে, তাইলে কিন্তু তুমি প্রযুক্তির হাতের পুতুলে পরিণত হইয়া যাইবা। দেখো, হাজার হাজার বছর আগে মানুষেরা কৃষি নামক এক প্রযুক্তি বাইর করছিল। এই প্রযুক্তি করছেটা কি দেখছো? অল্প সংখ্যক অভিজাত লোকের সুখ সমৃদ্ধি বাড়াইছে, আর বেশির ভাগ লোকরে বানাইছে দাস। বেশিরভাগ লোক দিনাতিপাত করে কাজ কইরা, সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত তারা আগাছা পরিস্কার করে, পানি বইয়া নিয়া আসে, ফসল চাষ করে, ফসল তোলে, তাও উত্তপ্ত সূর্যের নিচে। তো, তোমার ক্ষেত্রেও একই জিনিস ঘটতে পারে।
আমি কই না প্রযুক্তি খারাপ। তুমি যদি জানো তোমার জীবনে তুমি কী চাও তাইলে প্রযুক্তি তোমারে সাহায্য করতে পারে। কিন্তু তুমি যদি জানো না জীবনে কী চাও, তাইলে প্রযুক্তির জন্য সহজ হবে তোমার জীবনের নিয়ন্ত্রণ নিয়া নেয়া আর তোমার লক্ষ্য উদ্দেশ্যরে তার মতো কইরা তৈরী করা। যত প্রযুক্তি মানুষরে বুঝার ক্ষমতা বেশি অর্জন করতে থাকবে, ততো দেখবা তুমি প্রযুক্তির হইয়াই কাজ করতেছো, যদিও কথা ছিল সে তোমার হইয়া কাজ করবে। আইচ্ছা, রাস্তায় ঐ জম্বিগুলারে দেখছো তো যারা মুখের সামনে স্মার্টফোন ধইরা ধইরা হাঁটে? এই ইডিওটগুলারে প্রযুক্তি নিয়ন্ত্রণ করতেছে না এরা প্রযুক্তিরে নিয়ন্ত্রণ করতেছে, কী মনে হয় তোমার?
তাইলে কি তুমি তোমার নিজের উপর নির্ভর করবা ভাবতেছ? এইটা সিজাম স্ট্রিটের মতো শিক্ষামূলক সিরিজে বা পুরানা ডিজনি ফিল্মের জন্য হইলে সুন্দর শোনায়। কিন্তু বাস্তব জীবনে এইটা ঠিকমতো কাজ করে না। এমনকী ডিজনিও এইটা বুঝতে পারছে। তাদের ক্যারেক্টার রাইলি এন্ডারসনের মতো, বেশিরভাগ লোকই নিজেরে চিনতে পারে না, আর যখন তারা ‘নিজের কথা শুইনা’ চলার ব্রত করে তখন দেখা যায় সহজেই বাইরের নানা উৎস তাদের ম্যানিপুলেট করতেছে। আমরা আমাদের মাথার ভিতরে যে কন্ঠস্বর শুইনা থাকি, এইটা কখনো বিশ্বাসযোগ্য নয়। কারণ এই কন্ঠস্বররে ম্যানিপুলেট কইরা রাখে রাষ্ট্রীয় প্রোপাগাণ্ডা, মতাদর্শিক ব্রেইনওয়াশিং এবং বাণিজ্যিক বিজ্ঞাপনাদি, আর আমাদের বায়োক্যামিক্যাল তথা শারিরীক মানসিক যেসব চিন্তা সমস্যা বা বাগস আছে সেগুলার কথা আপাতত বাদই দিলাম।
এখন হইছে কি, আরো শুনো। বায়োটেকনলোজি আর মেশিন লার্নিং উন্নত হইতেছে। এরা যত উন্নত হবে তত মানুষের গভীরতম আবেগ অনুভূতি ও চাহিদারে ম্যানিপুলেট করা তার জন্য হবে সহজ। তখন কেবল নিজের হৃদয় যা বলে তারে অনুসরণ করা হবে সবচাইতে বিপদজনক। কোকাকোলা, এমাজন, বাইডু বা সরকার যখন তোমার ব্রেইন আর হার্টের নিয়ন্ত্রণের চাবিকাঠি নিয়া বইসা থাকবে, তখন কি তুমি কখনো বুঝতে পারবা কোনটা তুমি আর কোনটা তাদের বানানো তুমি?
তো এইটা তো বিরাট কাজ বৎস। তোমারে প্রচুর প্রচুর পরিশ্রম কইরা তোমার অপারেটিং সিস্টেমটারে আরো ভালো কইরা জানতে হবে। জানতে হবে তুমি কী, তুমি জীবন থেকে কী চাও। এইটা অবশ্যই সেই পুরানা উপদেশইঃ নো দাইসেলফ বা নিজেরে জানো। হাজার হাজার বছর আগে থেকে দার্শনিকেরা ও নবীরা লোকদের নিজেরে জানার কথাই কইয়া গেছেন। কিন্তু এই উপদেশ আজকের দিনে যেমন দরকারী, তেমন দরকারী আগে কোন কালে হয় নাই আর। এই ২১ শতক, লাওসে বা সক্রেটিসের কালের সময় না। কোকাকোলা, বাইডু বা সরকার এখন প্রতিযোগিতা করতে তোমারে হ্যাক করার। তোমার ঐ স্মার্টফোন না, তোমার কম্পিউটার না, বা তোমার বালের ব্যাংক একাউন্ট না – তারা প্রতিযোগিতায় আছে তোমারে হ্যাক করতে। তোমার যে প্রাকৃতিক অপারেটিং সিস্টেম আছে, ঐটারে হ্যাক করতে। তুমি হয়ত শুইনা থাকবা যে, আমরা এখন কম্পিউটার হ্যাক হবার যুগে বাস করতেছি, এই কথা অর্ধ সত্য। আসলে আমরা মানুষ হ্যাক করার সময়ে বাস করতেছি।
এলগোরিদম তোমারে দেখতেছে। যাইবা কই? যেখানেই যাও, যেই জিনিসই কিনো, যার সাথেই দেখা করো, তারা দেখতেছে। শীঘ্রই তারা তোমার সব পদক্ষেও, তোমার সব নিঃশ্বাস, তোমার সব হৃদকম্পনের খোঁজ রাখবে। তারা বিগ ডেটা আর মেশিন লার্নিং এর উপর নির্ভর করতেছে তোমারে আরো আরো বেশি ভালো ভাবে জানার জন্য। তো তারা যখন একসময় তোমারে তোমার চাইতে ভালোভাবে জাইনা ফেলতে পারবে তখন তারা তোমারে নিয়ন্ত্রণ ও ইচ্ছানুযায়ী ম্যানিপুলেট করতে পারবে, আর তোমার তখন বেশি কিছু করার থাকবে না। তুমি বাস করবা এক ম্যাট্রিক্সে বা দি ট্রুমান শো ফিল্মের মতো অবস্থায়। তো শেষে, যদি এলগোরিদম তোমার ভিতরে কী হইতেছে তা তোমার চেয়ে বেশি ভালো ভাবে বুইঝা ফেলতে পারে তাইলে তোমার নিয়ন্ত্রণ বা অথরিটি চলে যাবে তাদের হাতে।
তো, এইখানে কথা আছে। তুমি তোমার অথরিটি তাদের হাতে দিয়া, বিশ্বাস কইরা কিন্তু সুখে থাকতে পারবা। তারা তোমার হইয়া সিদ্ধান্ত নিবে, এবং বাকি পৃথিবীর সিদ্ধান্ত নিবে। তুমি যদি এতে সুখে থাকো, তাইলে মজা নিতে থাকো, উপভোগ কইরা যাও। তোমার কিছু করতে হবে না। এলগোরিদম সব কইরা দিবে। কিন্তু, যদি তুমি তোমার জীবনের কিছু নিয়ন্ত্রণ চাও, তোমার ব্যক্তিগত অস্তিত্বে এবং তোমার জীবনের ভবিষ্যত নিয়া তাইলে কিন্তু তোমারে এলগোরিদমের চাইতে দ্রুত দৌড়াইতে হবে। এমাজনের চাইতে দ্রুত, সরকারের চাইতে দ্রুত। তোমার নিজেরে জানতে হবে, তাদের তোমারে জানার আগে। দ্রুত দৌড়াইতে হইলে কিন্তু বাছাধন তুমি লগে বেশি জিনিস নিতে পারবা না। তো তোমার যেইসব বিভ্রান্তি আছে (মতাদর্শিক বালছাল বায়াস আর কি) ছুইড়া ফেলে দাও। এইগুলা খুব ভারী।