মুরাদুল ইসলাম » ব্লগ » জ্যারেড ডায়মন্ডঃ কীভাবে ধনী হওয়া যায়

জ্যারেড ডায়মন্ডঃ কীভাবে ধনী হওয়া যায়

সবচাইতে ওয়ান্ডারফুল একজন থিংকার জ্যারেড ডায়মন্ড। গান জার্মস এন্ড স্টিল তার বিখ্যাত বই। এই লোক যখন কীভাবে ধনী হতে হয় তা নিয়ে লেকচার দেন, তখন বিষয়টা ইন্টারেস্টিং হবে তা আগে থেকেই বলে দেয়া যায়। জ্যারেড ডায়মন্ডের চিন্তা প্রক্রিয়া হলো মাল্টি-ডিসিপ্লিনারি। তিনি ইতিহাস-জিয়োগ্রাফি-বায়োলজি-বিবর্তনীয় সাইকোলজি সহ নানা বিষয় এক করে চিন্তা করেন, তার মত  করে উপস্থাপন করেন। মাল্টি ডিসিপ্লিনারি চিন্তা আমার পছন্দ। তাই জ্যারেড ডায়মন্ডও পছন্দ।

ছবিঃ জ্যারেড ডায়মন্ড, ছবি কপিরাইটঃ ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক

কীভাবে ধনী হতে হয় লেকচারে ডায়মন্ড প্রথমত বলেছেন আমাদের দেখতে হবে ইতিহাসে। পৃথিবীর ইতিহাসে। কারণ পৃথিবী হলো প্রাকৃতিক পরীক্ষাকেন্দ্র। সেখানে মানুষকে নিয়ে নানা রকম পরীক্ষা নিরীক্ষার মধ্যে ফেলছে প্রকৃতি হাজার বছর ধরে। ভিন্ন ভিন্ন ভূ-প্রাকৃতিক অবস্থায়, ভিন্ন ভিন্ন রাজনৈতিক সামাজিক পরিস্থিতিতে। এগুলি দেখে আমরা দেখতে পারি কারা সফল হলো, কেন সফল হলো।

তখন আমরা বুঝতে পারবো, কোন একটি বৃহৎ গ্রুপ একা বাইরের বিশ্বের সাথে না মিশে কেমন পারফর্ম করতে পারবে? এক ডিক্টেটরশীপের ব্যবস্থায় কেমন হবে? কোন রিজিয়নে নানা গ্রুপ থাকলে ও তাদের মধ্যে প্রতিযোগীতা থাকলে কেমন হবে, ইত্যাদি।

এর মাধ্যমে আমরা কোন কোম্পানি বা বিজনেসের জন্য কোন পদ্বতি সবচাইতে বেশী প্রোডাক্টিভ তাও বের করে নিতে পারি। সেই বের করে নেয়া ইনসাইটটা হবে পৃথিবীর ইতিহাসের নিরিখে।

জ্যারেড ডায়মন্ড অনেক উদাহরণ দিয়ে দিয়ে বুঝিয়েছেন। আমি সংক্ষেপে সারমর্মটা লিখে রাখছিঃ

১। পৃথিবীর ইতিহাসে দেখা গেছে যারা আইজোলেটেড হয়ে থেকেছে তারা উন্নতি করতে পারে নি। দ্বীপে যারা আবদ্ধ হয়ে ছিল এমন মানুষেরা (যেমন তাসমানিয়ায়) হাজার বছরের ব্যবধানে নিজেদের জানা প্রযুক্তিগুলিও ভুলে গেছে।

কারন অধিকাংশ গ্রুপই তাদের সেরা চিন্তা ও উদ্ভাবনের অধিকাংশই পায় বাইরের গ্রুপ থেকে। তাই বাইরের গ্রুপের সাথে আদান প্রদান, তথ্য ও আইডিয়ার ফ্রি ফ্লো খুবই গুরুত্বপূর্ন।

 

২। যেসব গ্রুপ খুব এক হয়ে থাকে এরা কম প্রোডাক্টিভ। উদাহরণ হিসেবে চীন। তারা এক শাসকের নিচে, এক ইউনিট হয়ে আছে অনেক বছর ধরে ইতিহাসের। একসময় তারা সমুদ্র যাত্রায় সবার আগে ছিল জাহাজ নিয়ে, কিন্তু একবার তাদের নতুন শাসক এসে বন্ধ করে দিলে, তার মনে হয়েছিল এসব অহেতুক। তাই তারা জাহাজ প্রযুক্তিতে পিছিয়ে পড়ে। একসময় প্রায় শেষ হয়ে যায়।

ইউনিটি তাই বিরাট গ্রুপের জন্য ভালো নয়।

কলম্বাস ছিলেন ইতালিয়ান। তিনি জাহাজ নিয়ে আটলান্টিকের দিকে যাত্রায় যেতে চাইলে ইতালি এটাকে মনে করলো গর্দভের চিন্তা। তারা সাহায্য করতে রাজি হলো না। কলম্বাস গেলেন প্রতিবেশী দেশ ফ্রান্সে। তারাও মনে করলো গর্দভী চিন্তা। রাজী হলো না। কলম্বাস গেলেন পর্তুগালে। তারাও ফিরিয়ে দিল। কলম্বাস গেলেন স্পেনের ডিউকের কাছে, তারা ফিরিয়ে দিল। কলম্বাস গেলেন স্পেনের রাজা রানীর কাছে। তারা ফিরিয়ে দিল। কলম্বাস শেষপর্যন্ত ৭ম বারে আবার গেলেন স্পেনের রাজা রানীর কাছে। তারা বললেন যদিও গর্দভী চিন্তা তথাপি আমরা তিনটা ছোট জাহাজ দেব।

কলম্বাস গেলেন। নতুন দুনিয়া বের করলেন। পরেই ইউরোপিয়ান দেশগুলি উপনিবেশ বিস্তার ও সম্পদ আহরণের যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়ল।

এখানে ইউরোপ একচ্ছত্র এক ইউনিট হলে কিন্তু কলম্বাসের কাছে মাত্র একটি অপশন থাকতো। এতো অপশন থাকতো না।

জাপানে একসময় পার ক্যাপিটা বন্দুক ছিল সবচাইতে বেশি। বন্দুক প্রযুক্তিতে তারা এগিয়ে ছিল সব দেশের চাইতে। কিন্তু সামুরাইরা দেখল লোকের হাতে বন্দুক থাকলে তাদের অসুবিধা। তাই তারা নানা নিয়ম কানুন চাপিয়ে দিয়ে বন্দুক উৎপাদন একেবারে বন্ধ করে দিল একসময়। জাপান অবশেষে বন্দুক ত্যাগ করে।

ইউরোপের ক্ষেত্রেও এমন হয়েছে। অনেক প্রিন্স বন্দুক নিষিদ্ধ করেছে। কিন্তু তাদের প্রতিবেশী রাজ্যের প্রিন্স দেখা গেল বন্দুক অনুমোদন দিয়েছে। ফলে যে প্রিন্স বন্দুক নিষিদ্ধ করেছিল সে চাপে পড়ল কারণ তার হাতে বন্দুক না থাকলে অন্য প্রিন্স রাজ্য নিয়ে যেতে পারে। ফলে সেও বন্দুক অনুমোদন দিল।  একইভাবে প্রিন্টিং প্রযুক্তি নিষিদ্ধ করার চেষ্টা করেছিল কোন কোন ইউরোপিয়ান প্রিন্স। কিন্তু পারে নি শেষপর্যন্ত প্রতিবেশীদের সাথে প্রতিযোগিতার কারণে।

এভাবে যেকোন প্রযুক্তি নিষিদ্ধ করতে পারতো না তারা, যেহেতু প্রতিবেশীদের সাথে প্রতিযোগিতা ছিল। এরকম প্রতিবেশীহীন জাপান বা চীনের ক্ষেত্রে এমন প্রতিযোগিতা ছিল না। ফলে উদ্ভাবন বিস্তৃত হয় নি।

 

৩। অতিরিক্ত ইউনিটি বা অতিরিক্ত বিভেদ খারাপ। অতিরিক্ত বিভেদের উদাহরণ ভারতের ভূ-প্রকৃতি। অতিরিক্ত ইউনিটির উদাহরণ চীনের ভূ-প্রাকৃতিক অবস্থা।

কোম্পানির ক্ষেত্রেও ছোট ছোট ভাগ বা দল থাকলে ভালো। তাদের মধ্যে প্রতিযোগিতা থাকবে, কিন্তু তথ্য ও আইডিয়ার মুক্ত প্রবাহ থাকতে হবে। এটাই ধনী হবার বা কোম্পানির সফল হবার মূলমন্ত্র। মাইক্রোসফট এ পদ্বতিতেই সফল। আইবিএম চীনের মত একক (ইউনিট) ব্যবস্থায় ব্যর্থ ছিল, ইউরোপের মত খন্ড খন্ড দল করে, প্রতিযোগিতা বাড়িয়ে সফল হয়েছে।

জ্যারেড ডায়মন্ড মনে করেন এই জাপানের খাদ্য শিল্প এবং জার্মানীর বিয়ার শিল্প নিজেদের মার্কেটে মনোপলি করে তাদের কোম্পানিগুলির মাধ্যমে। ফলে প্রতিটি কোম্পানির লোকাল মনোপলি থাকলেও বাইরের বিশ্বের সাথে প্রতিযোগিতা না থাকায় এদের উৎপাদন আমেরিকার উল্লিখিত শিল্পের চাইতে অনেক অনেক কম।

পক্ষান্তরে, স্টিল কোম্পানিগুলির নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতা আছে, বাইরের বিশ্বের সাথেও প্রতিযোগিতা আছে তাই এদের উৎপাদন আমেরিকান স্টিল শিল্পের উৎপাদনের সাথে পাল্লা দেয়। জাপানের স্টিল ইন্ড্রাস্ট্রির প্রোডাক্টিভিটি আমেরিকান স্টিল ইন্ড্রাস্ট্রির চাইতে ৪৫% বেশি।

 

বাংলাদেশের জন্যঃ

জ্যারেড ডায়মন্ডের উল্লিখিত চিন্তা বাংলাদেশের ফিল্ম ইন্ড্রাস্ট্রিতে যদি আমরা প্রয়োগ করি, তাহলে প্রাথমিক ভাবে এমন মনে হতে পারে যে,  আমাদের সিনেমা হলগুলিতে হিন্দি ফিল্ম চললে, তা বাংলাদেশের সিনেমা শিল্পের জন্য ভালো হবে। কারণ তখন শক্ত প্রতিযোগি থাকবে বাজারে।  কিন্তু, ডায়মন্ড বলেছেন তথ্যের ফ্রি ফ্লো বা মুক্ত প্রবাহ থাকতে হবে। প্রযুক্তির আদান প্রদান। এসব সুবিধা কি বাংলাদেশের সিনেমা ইন্ড্রাস্ট্রি পাবে? মনে হয় না। উপরন্তু বাজেট স্বল্পতা, গল্প-অভিনয় ও নির্মানে ধুকতে থাকা বাংলা ফিল্ম ইন্ড্রাস্ট্রি একেবারে দূর্বল। এই অবস্থায় প্রচণ্ড শক্তিশালী বলিউডের ফিল্মের সাথে সে প্রতিযোগিতা করতে পারবে না। জাপানের স্টিল ইন্ড্রাস্ট্রি বা জার্মানীর স্টিল ইন্ড্রাস্ট্রি ধুকতে থাকলে আমেরিকান স্টিল ইন্ড্রাস্ট্রির সাথে প্রতিযোগিতা করে টিকতেই পারতো না।

 

 

পুরো লেকচারের ট্রান্সক্রিপ্টঃ How to get Rich by Jared Diamond

Leave a Comment

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

×
গুরুত্বপূর্ণ
Scroll to Top
বই মডেলিং