ভারত-চীন-পাকিস্তান নিউক শক্তিঃ যে কারণে চিন-ভারত ছোটখাটো যুদ্ধ হতে পারে

সাউদার্ন এশিয়ার তিনটি দেশ নিউক্লিয়ার অস্ত্র সমৃদ্ধ। চীন, ভারত এবং পাকিস্তান। দেশগুলোর নিজেদের মধ্যে সীমান্ত বিরোধ ও যুদ্ধের ইতিহাস রয়েছে। এ অঞ্চলে আছে নানা উগ্র মিলিট্যান্ট গ্রুপের অবস্থান। ফলে এই অঞ্চলের স্ট্যাটেজিক স্ট্যাবিলিটি সবচাইতে বেশী ঝুঁকিপূর্ন হিসেবে ধরে থাকেন অনেক আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞরা। এই লেখায় আমরা প্রথমত দেখার চেষ্টা করব তিনটি দেশের নিউক্লিয়ার অস্ত্র এবং সংস্লিষ্ট বিপদের আশংকা। দ্বিতীয়ত আমরা দেখব শিলিগুড়ি করিডোর বা চিকেন নেক নিয়ে ভারত এবং চীনের সাম্প্রতিক সমস্যাকে।

চীনঃ

চীনের নিউক্লিয়ার ট্রায়াড অর্থাৎ ভূমি, আকাশপথ ও সমুদ্রপথ ভিত্তিক পারমানবিক অস্ত্র ডেলিভারি সক্ষমতা অর্জনের কাছাকাছি আছে। আনুমানিক ২৫০ টি নিউক্লিয়ার ওয়ারহেড রয়েছে তাদের। যাদের মধ্যে আছে স্বল্প, মাঝারি ও দীর্ঘ পাল্লার ব্যালিস্টিক মিজাইল। তাদের ষাটটি দীর্ঘ পাল্লার ব্যালিস্টিক মিজাইল রয়েছে বলে ধারণা করা হয়, যা প্রায় ৪,৩০০ থেকে ৯,৩২০ মাইল দূরে গিয়ে আঘাত করতে সক্ষম।

বেইজিং বলে থাকে তাদের নিউক্লিয়ার তৎপরতা সম্পূর্নরূপে নিজেদের প্রতিরক্ষার স্বার্থে। তাদের প্রথম নিউক্লিয়ার টেস্টের পরেই চীন ঘোষনা দেয় নো ফার্স্ট ইউজ পলিসির। অর্থাৎ, কোন সংঘাতে তারা প্রথমে নিউক্লিয়ার অস্ত্র ব্যবহার করবে না। কেবল নিউক্লিয়ার অস্ত্র দ্বারা আক্রান্ত হলেই আত্মরক্ষার স্বার্থে পালটা নিউক ব্যবহার করবে।

 

ভারতঃ

ভারতের রয়েছে উন্নত নিউক্লিয়ার অস্ত্র ব্যবস্থা, এবং ধারণা করা হয় তাদের নিউক্লিয়ার ওয়ারহেডের পরিমাণ ১১০ থেকে ১২০। ২০১১ সালে নয়াদিল্লীর নিউকের পিছনে ব্যয় ছিল ৪ দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলার, যা আগের বছরে ছিল ৪ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ বুঝাই যাচ্ছে ভারত তার নিউক্লিয়ার অস্ত্র ব্যবস্থা উন্নত করে চলেছে।

ভারত প্রধানত ব্যালিস্টিক মিজাইল ডিফেন্স সিস্টেম, দীর্ঘ পাল্লার ব্যালিস্টিক মিজাইল, নিউক্লিয়ার সাবমেরিন, সমুদ্র পথ ভিত্তিক ক্রুজ মিজাইল ইত্যাদিতে বিশেষ নজর দিচ্ছে।

নয়াদিল্লী বেইজিং এর মতই নো ফার্স্ট ইউজ অর্থাৎ নিউক্লিয়ার বা বায়োলজিক্যাল অস্ত্র দ্বারা আক্রান্ত না হলে প্রথম নিউক ব্যবহার করবে না, এই নীতি অনুসরণ করেছে তাদের নিউক্লিয়ার ডকট্রিনে।

ভারত চীনের নিউক্লিয়ার অস্ত্র বৃদ্ধি এবং চীনের পাকিস্তানকে নিউক্লিয়ার ম্যাটেরিয়ালস ও প্রযুক্তিগত সাহায্য দেয়াকে গুরুত্বপূর্থ থ্রেট হিসেবে বিবেচনা করে। ফলে তাদের নিউক্লিয়ার অস্ত্র বৃদ্ধি এবং এ সংস্লিষ্ট ব্যয় হচ্ছে চীন ও পাকিস্তানকে কাউন্টার দেয়া।

 

পাকিস্তানঃ

১৯৬৫ সালে পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো বলেছিলেন, “যদি ভারত বোমা বানায়, তাহলে আমরা ঘাস খাব, না খেয়ে থাকব, কিন্তু আমরা নিজেদের বোমা বানিয়ে ছাড়ব।”

ভুট্টো সাহেবের এই কথা থেকে স্পষ্ট বুঝা যায় পাকিস্তানের নিউক বানানো এবং তার পেছনে অর্থ ব্যয়ের কারণ ভারতের থ্রেট মোকাবেলা করা। বর্তমানে পাকিস্তানের ১১০ থেকে ১৩০ টি নিউক্লিয়ার ওয়ারহেড আছে ধারণা করা হয়। তাদের বাহন যান দুই ধরনের, ভূমি থেকে ভূমিতে নিক্ষেপণযোগ্য এবং এয়ারক্রাফট।

পাকিস্তানের নিউক্লিয়ার অস্ত্র বৃদ্ধিকরণ প্রচেষ্টাকে পৃথিবীর সবচাইতে দ্রুততম বলে দেখা হয় কোন কোন হিসাবে। এক দশকের মধ্যে তারা ওয়ারহেডের পরিমান তিনগুণ করেছে। আগামী পাঁচ থেকে দশ বছরের মধ্যে তা ভারতের দ্বিগুন এবং চীন, ফ্রান্স এবং যুক্তরাজ্যকেও ছাড়িয়ে যাবে বলে ধারণা করা হয়। তখন আমেরিকা ও রাশার পরে পাকিস্তান হবে সবচেয়ে বেশী নিউক্লিয়ার ওয়ারহেড সম্পন্ন দেশ।

পকিস্তানের কোন নির্দিষ্ট নিউক্লিয়ার ডক্ট্রিন নাই, যদিও তারা দায়িত্বজ্ঞান এবং বিরত থাকাকে তাদের নিউক্লিয়ার প্রোগ্রামের স্তম্ভ হিসেবে ঘোষনা দিয়েছে। তারা নো ফার্স্ট ইউজ নীতিতে বিশ্বাসী নয়। পাকিস্তানের নিরাপত্তা এবং ভারত যাতে তাদের উপর নিউক ব্যবহার না করতে পারে এটাই তাদের নিউক্লিয়ার প্রোগ্রামের প্রথম উদ্দেশ্য। আর দ্বিতীয় উদ্দেশ্য ভারতের বিশাল সামরিক শক্তির সমকক্ষতা অর্জন নিউকের মাধ্যমে।

পাকিস্তানের নিউক প্রোগ্রামের বেশ কিছু নিরাপত্তা আশংকা তৈরী করে, এদের মধ্যে একটি সৌদি আরবে গোপনে নিউক্লিয়ার অস্ত্র বিক্রি অন্যতম। এছাড়াও মিলিট্যান্ট গ্রুপদের তৎপরতার জন্য পাকিস্তানের স্ট্যাবিলিটি প্রশ্নের মুখে পড়লে, সমগ্র বিশ্বের নিরাপত্তাই শংকায় পড়ে যাবে। যদিও পাকিস্তান বার বার বলে আসছে তাদের নিউক প্রোগ্রাম নিরাপদেই আছে, এবং কোন মিলিট্যান্ট গ্রুপের হাতে যাবার আশংকা নেই।

 

চীন ও ভারত হালকা যুদ্ধ হতে পারে কী?

ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চীনের “ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড” প্রকল্পের মাধ্যমে প্রাধান্য বিস্তারের চেষ্টা থ্রেট হিসেবে দেখে আসছে ভারত। কিন্তু চীন মনে করছে তার উন্নতি অব্যাহত রাখতে এ প্রকল্প অপরিহার্য।

সম্প্রতি হিমালয়ান ডোকলাম প্লাটু অঞ্চলে চীন-ভুটান অমীমাংসিত সীমান্তে  চীন এবং ভারতের পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। ২০১৭ সালের জুন মাসে ভারতের মিত্র ভুটান দেখতে পায় ভুটান-চীন অমীমাংসীত হিমালয়ান সীমান্তে একটি রাস্তা দীর্ঘ করার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে চীন মিলিটারী এঞ্জিনিয়ারেরা। ভুটান ও ভারত মনে করছে এই রাস্তা দীর্ঘ করার মাধ্যমে চীন ডোকলাম প্লাটুর বিরোধপূর্ন জায়গায় নিজের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে চায়। এই প্লাটুর সর্বদক্ষিনে আছে ভারতের শিলিগুড়ি করিডোর বা চিকেন নেক। এই  ২৭ কিলোমিটার করিডোরের মাধ্যমে ভারত উত্তরপূর্ব রাজ্যগুলোর সাথে যুক্ত। ভারত মনে করে চীন রাস্তা নির্মান করে ডোকলাম প্লাটু দিয়ে এগিয়ে এলে যেকোন উত্তপ্ত পরিস্থিতে তারা শিলিগুড়ি করিডোরের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ভারতের প্রায় যুক্তরাজ্যের সমান বিশাল এলাকাকে বিচ্ছিন্ন করতে পারবে সহজেই।

তাই ভুটানের ভিতরে গিয়ে অস্ত্র ও সেনা পাঠিয়ে ভারত চীনকে কাজ বন্ধ করতে বলছে। ভুটানের ভিতরে গিয়ে ভারতের এই তৎপরতা আন্তর্জাতিক আইনে অবৈধ নয় কারণ ভারত-ভুটানের পরস্পরের স্বার্থ রক্ষার নিমিত্তে বন্ধুত্বের চুক্তি আছে।

অন্যদিকে চীন রাগান্বিতভাবে তা প্রত্যাখান করে সেনা মোতায়েন করে ভারতকে বলছে সরে যেতে। সাউথইস্টার্ন নিউক্লিয়ার শক্তিধর এই দুই বড় শক্তির সেনারা মাত্র কয়েকশত ফিট দূরে অস্ত্রসজ্জিত হয়ে অবস্থান করছে এখন।

প্রশ্ন হলো, যুদ্ধ হবে কী?

প্রথমত নেগোসিয়েশনের মাধ্যমে সমাধানের চেষ্টা চলবে। বড় যুদ্ধ হবে না। কারণ চীন বা ভারত কেউই চায় না নিজেদের অর্থনৈতিক উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত করতে যুদ্ধে জড়িয়ে। কিন্তু হালকা যুদ্ধ হতে পারে যেহেতু এতে বড় নিউক্লিয়ার যুদ্ধের আশংকা নেই, কারণ উভয় দেশই নিশ্চিত যে প্রথমে অন্যদেশ নিউক্লিয়ার অস্ত্র ব্যবহার করবে না।