ইরানে অনেক মানুষেরা বিক্ষোভ করছেন তাদের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নের জন্য। বিক্ষোভ শুরু হয়েছে গত বৃহস্পতিবার থেকে উত্তর-পশ্চিমের মাশাদ শহরে। এরপর তা ছড়িয়ে পড়েছে অন্যান্য জায়গায়। শুক্রবারে অনেক শহরে লোকেরা জমায়েত হন। শনিবারে তেহরানে প্রথমে জড়ো হয়েছিলেন কিছু লোক বিক্ষোভে, পরে তা কয়েক হাজার মানুষের বিক্ষোভে রূপ নেয়। ছাত্রদের সাথে পুলিশের সংঘর্ষ হয়, কিছু কিছু জায়গায় বিক্ষোভ ভায়োলেন্স বা হিংসাত্মক কর্মকান্ডের দিকে চলে যায়।
এই বিক্ষোভ কেন ও কাদের বিরুদ্ধে তা নিয়ে একেক পক্ষ একেক মত দিচ্ছেন। মূলত দুইভাগে একে ভাগ করা যায়।
প্রথম পক্ষ মডারেট। তারা বর্তমানে সরকারে আছেন। তারা পরিবর্তনপন্থী বলে পরিচিত। এরা বলছেন এই বিক্ষোভ হয়েছে অতি-প্রতিক্রিয়াশীলদের কারণে। অতি-প্রতিক্রিয়াশীলেরা জনগণের মনকে বিষিয়ে তুলেছেন।
আর অতি-প্রতিক্রিয়াশীল বা হার্ড লাইনারদের মত হলো, এ বিক্ষোভ সরকারের বিরুদ্ধে। কারণ সরকার ম্যানেজমেন্টে ব্যর্থ হয়েছে। অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি করতে পারে নি। জনগনকে চাকরি দিতে পারে নি। তাই জনগন সরকারের দুর্নীতি ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছে। এ বিক্ষোভ ইসলামিক রিপাবলিক অব ইরান বা সুপ্রিম লিডার আয়াতুল্লাহ রুহুল্লা খোমেনির বিরুদ্ধে নয়।
পরিবর্তনপন্থী এবং অতি-প্রতিক্রিয়াশীল এই দুই দলের আবার একটা জায়গায় মিল আছে। তারা উভয় দলই বর্তমান ইসলামিক রিপাবলিকের টিকে থাকার পক্ষে। পরিবর্তনপন্থীরা কেবল এর ভিতরে থেকেই পরিবর্তন করতে চান।
ইরান-আমেরিকা নিউক্লিয়ার ডিল বা পারমানবিক চুক্তির পরে ধারণা করা হয়েছিল ইরানের অবস্থার উন্নতি হবে। জনগণ মনে করেছিল যেহেতু বাইরের বিশ্বের সাথে ব্যবসা ও আমেরিকা প্রভাবিত দেশ-প্রতিষ্ঠান থেকে এখন ইনভেস্ট ও ডোনেশন আসবে, তাই অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি হবে। তাদের মধ্যে আশার জন্ম হয়েছিল ভালো জীবনযাত্রার, চাকরির।
কিন্তু বাস্তবে তা হয় নি। যদিও জিডিপি বেড়েছে কিন্তু এর সুফল জনগন পায় নি। এমনকী সরকারের উপর জনগণের আস্থাও প্রচুর কমেছে।
গত নভেম্বরে (২০১৭) ইরানে বেশ বড় একটি ভূমিকম্প হয়। ভূমিকম্প মাপার স্কেলে এর মাত্রা ছিল ৭ দশমিক তিন। পশ্চিমের কারমানশাহ প্রদেশ ক্ষতিগ্রস্থ হয় সবচাইতে বেশী। প্রায় ৪০০ মানুষ নিহত হন, আহত হন প্রায় ১০,০০০ এর উপরে। প্রচুর ঘর বাড়ি ভেঙে যায়। মানুষজন দিন কাটাচ্ছিলেন খোলা আকাশের নিচে।
এই দুর্যোগে মানুষেরা ব্যগ্রভাবে এগিয়ে আসেন দুর্দশাগ্রস্তদের সাহায্যের জন্য। মানবিক তাড়নার চাইতেও আরেক বোধ তাদের মধ্যে বেশী কাজ করেছে। সেটি হলো সরকার এইসব মানুষদের জন্য বেশী কিছু করতে পারবে না।
বিখ্যাত খেলোয়াড়েরা এগিয়ে আসেন। কিনাউশ রোস্তামি, ২০১৬ সালের রিও অলিম্পিকে ওয়েট লিফটিং বা ভারোত্তলন প্রতিযোগীতায় স্বর্ন পদক জিতেছিলেন। তিনি মানুষদের সাহায্যের জন্য তার পদক নিলামে তুলেন। টাকা সংগ্রহে এগিয়ে আসেন প্রাক্তন জাতীয় দলের অধিনায়ক ও সবচেয়ে বেশী আন্তর্জাতিক গোলের মালিক আলি দায়িই। এছাড়াও প্যারা অলিম্পিক মহিলা শ্যুটিং এ স্বর্ন পদক জেতা জয়ী সারেহ জাভানমারদিও তার পদক নিলামে তুলেন।
এইসব ঘটনা একদিক থেকে দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার কারণে সরকারের উপরে জনগণের আস্থাহীনতাকেও প্রকাশ করে।
সরকার পক্ষ বলছেন তারা নিউক্লিয়ার চুক্তির শর্ত মেনে চললেও আমেরিকা মানেনি। ফলে অবস্থার উন্নতি হয় নি। কিন্তু সরকারের বিরোধীরা বলছেন, সরকারের ম্যানেজমেন্টে দূর্বলতা ও কর্তাদের দুর্নীতির কারণেই চক্তির সুফল জনগন পায় নি। কেবল বড় ব্যবসায়ীরা পেয়েছে। তাদের কথা হলো, সরকারকে নির্বাচিত করার সময় এই ব্যবসায়ীরা অঢেল টাকা ঢেলেছে, তাই সরকার এদের সুবিধা দিচ্ছে। সাধারণ লোকের ব্যাপারে সরকারের কোন মাথাব্যথা নেই।
এদিকে সরকার পক্ষের আরো যুক্তি আছে খারাপ অর্থনৈতিক অবস্থা বিষয়ে, তারা বলছে ইরানের ইসলামিক রেভোলুশনারি গার্ডই অর্থনৈতিক অনেক কিছু নিয়ন্ত্রণ করে। এখানে সরকারের নিয়ন্ত্রণ খুবই কম।
ইরানের ইসলামিক রেভোলুশনারি গার্ড প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৭৯ সালে ইসলামিক বিপ্লবের পরে। দেশের ইসলামিক ব্যবস্থাকে সমুন্নত রাখাই ছিল এর উদ্দেশ্য। এরপর তা ইরানের অর্থনৈতিক, রাজনৈতি ও মিলিটারী ব্যবস্থায় বড় শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়। তার সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনী রয়েছে। বাসিজ রেজিস্ট্যান্স ফোর্স নামে দশ হাজার লোকের একটি ভলান্টারী মিলিশিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করে। মাঝে মাঝে সংস্থাটি পুলিশের সাথেও কাজ করে থাকে।
বর্তমান সরকার বিরোধী বিক্ষোভ চলতে থাকলে শক্তহাতে দমন করা হবে বলে জানিয়েছে আইজি আর সি।
ইরানে বেকারত্বের হার খুবই বেশী। ২০১৬ এর শেষদিক থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত তা প্রায় সর্বোচ্চ। প্রায় ১২.৫ পার্সেন্ট। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে যে হার ৪.১ পার্সেন্ট। এই অবস্থাতেই আমরা বলে থাকি আমাদের সমাজে বেকারত্বের হার বেশী, ইরানের অবস্থা আমাদের চাইতে চারগুণ বেশী খারাপ।
এদিকে মূল্যস্ফীতির কারণে দ্রব্যমূল্যের দাম খুব বাড়ছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ডিমের দাম ৪০% বেড়েছে ছয়মাসে। ইরানে প্রায় অর্ধেক মানুষ দারিদ্র সীমায় বাস করে।
কিন্তু এই ইরানই সিরিয়ায় বাশার আল আসাদ সরকারকে ক্ষমতায় রাখার জন্য রাশার পক্ষ হয়ে কাজ করছে। এই যুদ্ধে মিলিটারী সহযোগীতার মূল অংশ ইরান থেকে যায়।
সৌদি এবং তার মিত্ররা ইয়েমেনে হুথি বিদ্রোহীদের সাথে যুদ্ধ করছে, যে যুদ্ধ ইয়েমেনে এক বড় মানবিক বিপর্জয় ডেকে এনেছে। এখানে হুথি বিদ্রোহীদের অস্ত্র দিয়ে সহযোগীতা করে যাচ্ছে ইরান। যদিও এটি ইরান অস্বীকার করে। এছাড়াও, লেবাননে হেজবুল্লাহ এবং শিয়া গোষ্ঠীকে নিয়মিত সহযোগীতা করে থাকে ইরান।
মাশাদে বিক্ষোভে আসা লোকেরা স্লোগান দিচ্ছেন, “গাজা নয়, লেবানন নয়, আমার জীবন ইরানের জন্য।”
তাদের এই স্লোগান মূলত ইরানের ফরেন পলিসির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। বহির্বিশ্বে বিশেষত মধ্যপ্রাচ্যে নিজেদের ক্ষমতা প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে নেমেছে ইরান সৌদির বিপক্ষে। কিন্তু নিজ দেশের মানুষের জীবনযাত্রার মান নিম্ন। বিক্ষোভ এই বার্তাই দিচ্ছে।
এদিকে আবার অনেকে বলছেন, আমাদের এটা করতে হচ্ছে। আমরা যদি সিরিয়ায় দায়েশ আলকায়দার সাথে না লড়ি তাহলে এই এখানে, এই রাজধানী তেহরানে ওদের সাথে লড়তে হবে।
ইরানের বর্তমান বিক্ষোভের জন্য এখন পর্যন্ত বিভিন্ন গোষ্ঠী পরস্পরকে দোষারূপ করে চলেছে। অতি প্রতিক্রিয়াশীলেরা একে বহির্বিশ্বের ষড়যন্ত্র হিসেবেও দেখছে। তারা বলছে পশ্চিমা মিডিয়া ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে নিউজ করছে বিক্ষোভ নিয়ে। যদিও মূল সমস্যা ইরানের বেকারত্ব, মূল্যস্ফীতি, দুর্নীতি ও অর্থনৈতিক দূরাবস্থা। এর সাথে সাথে রয়েছে বাজে বৈদেশিক নীতির প্রভাব। ইরান এসব দিকে দৃষ্টি না দিলে আরো বাজে অবস্থার মধ্যে পড়তে থাকবে।
মধ্য জানুয়ারীতে ট্রাম্প সরকার নিউক্লিয়ার ডিল পুনর্মূল্যায়ণ করবে শোনা যাচ্ছে। এই পুনর্মূল্যায়নে যদি চুক্তি ভেস্তে যাওয়ার মতো পরিস্থিতিতে যায় তাহলে ইরানের অর্থনৈতিক অবস্থা হয়ে উঠবে আরো করুণ।
বিক্ষোভ সম্পর্কে বিবিসির বরাতে যা জানা গিয়েছিল ৩১ ডিসেম্বর, ২০১৭ তেঃ
১। দরুদ শহরে গুলি লেগেছে দুজন মানুষের গায়ে, তারা মারা গেছেন।
২। আভার শহরে সুপ্রিম লিডার আয়াতুল্লাহ ছবিসহ বড় পোস্টার পুড়িয়েছেন বিক্ষোভকারীরা।
৩। আরাক শহরে বাজিসের হেডকোয়ার্টারে আগুন দিয়েছেন প্রতিবাদী লোকজন।
৪। মাশাদ শহরে মোটরসাইকেল পুড়ানোর মত ঘটনা ঘটেছে।
৫। মেসেজিং এপ টেলিগ্রামের সিইও জানিয়েছেন একজন লোকের আইডি ব্যান করা হয়েছে। সে ইরানের বিক্ষোভে পুলিশকে আক্রমণের ব্যাপারে প্রচারনা চালাচ্ছিলো।
৬। বিভিন্ন জায়গায় লোকজন ইন্টারনেট ব্যবহার করতে পারছেন না। সরকার ইন্টারনেট বন্ধ করে দিয়েছে এমন খবর পাওয়া যাচ্ছে।
শেষ খবর (২ জান্য, ২০১৮) পাওয়া পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা প্রায় বাইশ। সুপ্রিম লিডার আয়াতুল্লাহ খোমেনি বিক্ষোভের জন্য দায়ী করছেন “ইরানের শত্রুদের”।