জেরুজালেমের গুরুত্ব ও রিডলি স্কটের কিংডম অব হেভেন

রিডলি স্কটের ঐতিহাসিক এপিক কিংডম অব হেভেন (২০০৫) এর সময়কাল বারো শতকের জেরুজালেম। জেরুজালেম নিয়ে ক্রুসেড বা খ্রিস্টান ও মুসলিমদের যুদ্ধই এর বিষয়বস্তু। কিন্তু পরিচালক এখানে ইতিহাসের ঘটনাকেই ভিত্তি করে ছবি বানান নি। তিনি ইতিহাসের ঐ ঘটনাগুলি কেন ঘটলো সেইদিকেই বরং ইঙ্গিত করতে চেয়েছেন। ফলে চরিত্রগুলির ব্যক্তিগত ক্ষোভ আক্রোশ প্রতিরোধ ইগো ইত্যাদিই ছবিটিতে প্রধান হয়ে উঠেছে। ধর্ম বা ধর্মের প্রতি আবেগ ইত্যাদি প্রাধান্য পায় নি। বরং, মূল নায়ক চরিত্রটি বেলিয়েন নিজেই ধর্ম নিয়ে সন্দিহান এমন দেখা গেছে।

স্কটের এই ফিল্মটি মুলসমান ও খ্রিস্টান উভয় পক্ষের দ্বারাই সমালোচিত হয়েছে। তাদের কথা হলো তিনি ইতিহাস ভূলভাবে উপস্থাপন করেছেন, বিকৃত করেছেন। কিন্তু নিরপেক্ষ একজন দর্শকের কাছে ফিল্মটি খারাপ মনে হবে না। বরং অন্তঃসারশূন্য যুদ্ধ বিরোধী অবস্থানের জন্য ভালোও লাগতে পারে।

একটি ইন্টারেস্টিং কথোপকথন আছে ফিল্মে, যাকে আমার মনে হয়েছে ফিল্মটির মূল ভিত্তি। নায়ক বেলিয়েন বীর সালাহউদ্দিনের সাথে চুক্তি করে জেরুজালেমকে যখন রক্ষা করেন, তখন তিনি সালাহউদ্দিনকে প্রশ্ন করেনঃ

এই জেরুজালেম আসলে কি, যার জন্য এতো কিছু, এত হত্যা খুন?

সালাহউদ্দিন জবাব দেন, কিছুই না।

কয়েক পা গিয়ে আবার হাসিমুখে জবাব দেন, সবকিছুই।

ছবিঃ সিরিয়ান অভিনেতা ঘাসান মাসঊদ সালাদিন চরিত্রে অভিনয় করেছেন।

এই কথাটি হুট করে হয়ত বুঝা যাবে না। এর গুরুত্ব ইতিহাসে নিহিত। যখন আরব মুসলমানেরা খ্রিস্টানদের এলাকা জয় করতে শুরু করলো (৭ম শতকে), যখন কেবল বাহ্যিক নয় দার্শনিক এক সমস্যায় পড়ে যায় খ্রিস্টান দুনিয়া। খ্রিস্টান দুনিয়ার ভিত্তি ছিল যে ঈশ্বর তাদের সাথে আছেন, এবং ঈশ্বরের আনুকূল্যেই তাদের শক্তি বৃদ্ধি হয়েছে। অপরদিকে মুসলমানরা শুরু থেকেই বলে আসছে ইহুদি ও খ্রিস্টানরা ভ্রান্ত পথে চলে গেছে এবং ইসলামই আসল সত্য পথ। এখন এই মুসলমানরা যখন খ্রিস্টান এলাকা জয় করতে থাকলো, বিশেষ করে জেরুজালেম (৬৩৮ সালে), তখন খ্রিস্টানদের মনে এই ভয় ঢুকে গেল যে ঈশ্বর কি সত্যি তাদের সাথে নেই? ঈশ্বর কি সত্যিই ওদের সাথে?

এই সন্দেহ খ্রিস্টান দুনিয়ার ভিত্তি নাড়িয়ে দিতে এবং ধ্বংস করতে সক্ষম ছিল। ফলে খ্রিস্টানরা একই সাথে বাহ্যিক ও দার্শনিক হুমকির মুখে পড়ে। যদিও উত্তর ইতালি, ফ্রান্সের অধিকাংশ, জর্মনী, ইংল্যান্ড ইত্যাদি ইউরোপের মূল জায়গাগুলি কখনো মুসলিমদের অধিকারে যায় নি। নিরাপদ ছিল।

কিন্তু জেরুজালেম ছিল ধর্মীয় দিক থেকে গুরুত্বপূর্ন। কারণ জেরুজালেম পবিত্র ভূমি। কিংডম অব হ্যাভেন।

জেরুজালেম মুসলিমদের হাতে চলে যাওয়া মানে পুরো খ্রিস্টান দুনিয়ার ঈশ্বরই চলে যাওয়া যেন।

এজন্য ক্রুসেডে বাইজেন্টাইন অংশ পুনরোদ্ধারের জন্য আনাতোলিয়ায় ক্রুসেডাররা যুদ্ধ শুরু করে নি, তারা গিয়েছে জেরুজালেম রক্ষা করতে।

এখানেই জেরুজালেমের বিশেষত্ব। এটার অধিকার থাকা মানে সব কিছুই যেন অধিকারে থাকে, নিজেদের দলে ঈশ্বরকে পাওয়া। স্কটের ফিল্মে সালাহউদ্দিন বা ইউরোপে যাকে সালাদিন বলা হয় তিনি এজন্যই বলেছেন, জেরুজালেম এমনিতে কিছুই না, কিন্তু আসলে সবকিছুই।

রিডলি স্কট এইসব ধর্মীয় বা মেটাফিজিক্যাল গুরুত্ব দেখান নি, কিন্তু এটাই মূলত জেরুজালেমের ঐতিহাসিক গুরুত্ব তৈরী হবার পেছনে রয়েছে। স্কট যে দেখিয়েছেন ব্যক্তিগত ইগো কেন্দ্রিক যুদ্ধ যা দীর্ঘ সময় ধরে অশান্ত করে রেখেছে জেরুজালেমকে, ঝরাচ্ছে রক্ত অবিরত সেইসব ইগোর গভীরে খুজলে এই মেটাফিজিক্যাল গুরুত্বের চিহ্নরেখাই মিলবে।

কেউ এখানে কাউকে ছাড় দিয়ে কথা বলে না। যুদ্ধ হয়।

রিডলি স্কট বলতে চেয়েছেন এই যুদ্ধটা হয় দুই পক্ষেরই উগ্রপন্থীদের কারণে, যারা পুরো জেরুজালেমের উপর নিয়ন্ত্রণ নিতে চায়। তিনি বুঝাতে চান, মুসলিম খ্রিস্টান ও ইহুদি একসাথে মিলেমিশে থাকতে পারে জেরুজালেমে। এটা হয়ত সত্যি, এবং এটাই হয়ত সমাধান জেরুজালেম সমস্যার। আন্তর্জাতিক তত্ত্বাবধানে জেরুজালেমকে নেয়া।  কারণ ইতিহাসের দিক থেকে এখানে মুসলিম খ্রিস্টান ও ইহুদিদের অধিকার রয়েছে, এবং কোন এক বা দুই দল নিয়ন্ত্রণ নিলে এখানে সমস্যা রয়েই যাবে। যদিও আধুনিক কালে জায়গাটির মেটাফিজিক্যাল গুরুত্ব আগের মতো নেই, অনেকাংশে কমেছে, কিন্তু ইগো কমে নি, বরং বেড়েছে। ফলে কেউই ছাড় এখনো দেবে না জেরুজালেম বিষয়ে।