কাজুও ইশিগুরো’র এ ফ্যামিলি সাপার গল্পে পিতা এবং পুত্রের দীর্ঘদিন পরে দেখা হয়, কিন্তু তাদের মধ্যে যেন যোগাযোগ ঠিক হয় না। ছেলে পশ্চিমা সংস্কৃতির আর বাপ জাপানি ঐতিহ্য-সংস্কৃতির ধারক, তাদের যোগাযোগে গোলযোগের হেতু এই। এই গল্পটিতে পিতার ব্যথা আমরা বুঝতে পারি। পিতা পরোক্ষ ভাবে পুত্রকে থেকে যেতে বলেন বাড়িতে, সরাসরি বলতে পারেন না।
এই পিতা পুত্রের যোগাযোগ সমস্যায় পুত্রেরও ব্যথা আছে, এবং গল্পটির আরেকটি রূপ যেন আমরা দেখি মাসুদ খানের মধু ও বিষাদের ঐকতানে। সেখানেও বহুদিন পরে পিতা পুত্রের দেখা হয়। সেখানেও পিতা পুত্রের কথা হয়, কিন্তু যোগাযোগ আর হয় না।
ইশিগুরোর গল্পে সংস্কৃতিগত রূপক দিকটাই বেশী প্রাধান্য পেয়েছে এবং সংস্কৃতিগত এই পার্থক্যই পিতা-পুত্রের মাঝখানে দেয়াল হয়ে দাঁড়ায়।
কিন্তু মাসুদ খানের গল্পটিতে পিতা পুত্রের যোগাযোগহীনতা জনিত ব্যথাই মূল বিষয়। সেখানে সংস্কৃতিগত কোন বিষয় নেই, বিষয় হলো দীর্ঘদিনের সময় ব্যবধান। খুব ছোটবেলায় ছাত্তার ও তার বউ তাদের ছেলে মোস্তফাকে তুলে দিয়েছিল এক এনজিওকর্মী জর্মন মহিলার হাতে। মহিলাটি মোস্তফাকে নিয়ে চলে যায় জর্মন দেশে। ছেলে বড় হয়, নাম হয় তার ডেভিড। একসময় সে শেকড়ের সন্ধানে চলে আসে দেশে, এবং তখনই বাপ ছাত্তারের সাথে পুত্র ডেভিড বা মোস্তফার পুনরায় স্বাক্ষাৎ।
ইশিগুরোর গল্পে ছেলেটির মা মারা গিয়েছিলেন মূলত পুত্রশোকে, হতাশ হয়ে। মা বাবা চেয়েছিলেন পুত্র তাদের সাথে থাকুক কিন্তু পুত্র থাকে নি। তিনি বিষাক্ত ফুগু মাছ খেয়ে আত্মহত্যা করেন বলে পুত্রের বাবা মনে করেন।
মাসুদ খানের গল্পে ছেলেকে জর্মন মহিলার হাতে তুলে দিয়ে ছাত্তার এবং তার বউ বুঝতে পারে তারা বড় ভুল করেছে। ছেলের অবুঝ মুখ তাদের সামনে ভেসে উঠে, মায়ার টানে তারা ছুটে যায় জাহাজঘাটে। কিন্তু ততক্ষণে ছেলে জর্মন দেশের পথে।
নিজেদের ভুলেই তারা ছেলেটিকে হারায়। এজন্য শোকে দুঃখে মারা যায় ছেলের মা।
দুইটি গল্পেই মা মারা গেছেন, এবং মূল দ্বন্দ্ব হলো পিতা এবং পুত্রের মধ্যে। মাসুদ খানের গল্পটিতে যদিও কালচারাল দিকটি দেখানো হয় নি, তথাপি এদিকটাও ভেবে দেখা যেতে পারে। মোস্তফা বড় হয়েছে জর্মনীতে, ফলে তার বেড়ে উঠা এবং শিক্ষা ভিন্ন সাংস্কৃতিক আবহে। তার বাপ হাইস্কুল পাশ ছাত্তার। বাপ তাই প্রথম কথাবার্তা বলার সময় সমীহভাব বজায় রাখে, প্রমিত বাংলায় কথা বলতে যায়।
ফলে ব্যক্তিদ্বয়ের বেড়ে উঠার সংস্কৃতিগত পার্থক্যও যে তাদের যোগাযোগ সমস্যাকে গভীর করেছে তা অবশ্যই বলা যায়।
এরপরে দেখা যায় ছাত্তার ছেলেকে তার ছোটকালের নানা কথা বলে, এবং কথা জমাতে চায়; কিন্তু কথাবার্তা আর ঠিক জমে উঠে না। কারণ সম্পর্কের সূতা কেটে গেছে।
ঠিক যেমন ইশিগুরোর গল্পে বাপ ও ছেলের কথাবার্তায়, বাপের পরোক্ষ থেকে যাবার অনুরোধে ছেলের নির্লিপ্ত জবাবে বুঝা যায় তাদের সম্পর্কের সূতাও কেটে গেছে।
এই দুই গল্পে পিতা-পুত্রের সম্পর্কের ক্ষেত্রে দীর্ঘদিনের ফিজিক্যাল দূরত্ব এক বিশ্যাল ফ্যাক্টর, যেমন হোমারের ইলিয়াড এবং অডিসিতে পিতা-পুত্রদের সম্পর্কের ভেতর ছিল।
ইলিয়াডে প্রিয়াম এবং হেক্টর পরস্পরের থেকে দূরে থেকেছে, এবং হেক্টরের মৃত্যুর পরেই প্রিয়ামের সন্তান প্রীতির প্রথম দেখা মিলে।
ওডিসিতে ওডিসাস ও টেলেমাকাস এর ভেতরেও দীর্ঘ দূরত্ব ছিল কিন্তু তাদের মধ্যে মিলিত হবার তাড়না সব সময় দেখা যায়।
দুই সম্পর্কেই দূরত্ব ফ্যাক্টর হলেও সম্পর্কের ধরনে ব্যতিক্রম লক্ষণীয়। মাসুদ খানের গল্পের পিতা-পুত্র ওডিসির পিতা-পুত্রের মত। তারা পরস্পরের সাথে মিলিত হবার আকাঙ্খা অনুভব করত। তাই তো অনেকদিন পরে শেকড়ের খুঁজে মোস্তফা এসেছিল দেশে। মোস্তফা যখন বলে, আব্বা আমার সাথে এইভাবে কথা বলছেন কেন, তখন বাপের প্রতি তার শ্রদ্ধা ও মমতার প্রকাশ দেখা যায়।
পক্ষান্তরে, ইশিগুরোর গল্পের পিতা-পুত্রের সম্পর্কটিতে মমতার প্রাবল্য বা প্রকাশ সরাসরি দেখা যায় না। যেমন প্রিয়াম এবং হেক্টরের ক্ষেত্রে দেখা যায় নি। সরাসরি প্রকাশ না হলেও পিতার কথাবার্তায় বুঝা যায় তার ভেতরে পুত্রের জন্য মমতা আছে। আবার পুত্র যখন এতদিন পরে ফিরে এসেছে পিতাকে দেখতে, তথাপি মমতা তার ভেতরে নেই, তা বলা যায় না। কিন্তু প্রকাশটা সরাসরি হয় না।
ইশিগুরোর গল্প এমন অবস্থায় শেষ হয়েছে যে, যেন একটি ট্র্যাজেডির মুখে। গল্পের পরবর্তীতে কী হবে ভাবলে মনে হয়, যেহেতু সন্তানেরা থাকবে না তার সাথে, তাই হয়ত স্ত্রীর মতো তিনিও ফুগু মাছ খেয়ে আত্মহত্যা করবেন। ছেলেকে যখন তিনি বলেন তার মা আত্মহত্যা করেছেন পুত্র শোকে বা হতাশায় বলে তিনি বিশ্বাস করেন, তখন এই কথাটিকে এমনভাবে ধরে নেয়া যায় যে, তিনিও একই পথ ধরার কথা ভাবছেন। এখানে আরো উল্লেখ্য যে তার বন্ধুর আত্মহত্যার খবর তিনি গর্বভরে ছেলেকে বলছিলেন। ফলে, যদি ট্রাজেডিটা হত, যেমন ইলিয়াডে হেক্টরের মৃত্যু হয়েছিল তেমন যদি ইশিগুরোর গল্পে পিতা বা পুত্রের কেউ একজন মারা যেত, তখন হয়ত অন্যজনের মমতার, ভালোবাসার তীব্র প্রকাশ দেখা যেত।
পিতা-পুত্রের দীর্ঘ সেপারেশন এর পরে দেখা হওয়ার ভেতরে যে যোগাযোগহীনতার সমস্যা, তা কখনো কখনো ভয়াবহ রূপ নিতে পারে; তা দেখা যায় যুবক ওডিপাস এবং তার পিতা লাইউসের সাক্ষাতের সময়ে। পিতা পুত্র তখন পুরুষ হিসেবে প্রথম নিজেদের সামনা সামনি দাঁড়িয়ে। ওডিপাস এবং তার পিতা পরস্পরকে চিনতে পারে না, তাদের ভেতরেও যোগাযোগহীনতা ছিল। এবং তাদের এই পুরুষ হিসেবে প্রথম সাক্ষাৎ খুব সুখকর হয় নি। পুত্রের হাতে পিতা খুন হন। একে রূপক হিসেবে ধরে নিলে ইশুগুরুর বা মাসুদ খানের পিতা-পুত্রের যোগাযোগহীনতা, এবং এর তীব্রতার আরেক দিক অনুভব করা যায়।
ওডিপাসের পিতা লাইউস ভবিষ্যতবানীতে জেনেছিল তার ছেলে তাকে খুন করবে, তার স্ত্রীকে বিয়ে করবে। এজন্য সে শিশু ওডিপাসকে জল্লাদের হাতে তুলে দেয়। কিন্তু জল্লাদ হত্যা করে নি শিশুটিকে। এই গল্পে লাইউসের তার নিজের পুত্রের সাথে প্রতিযোগীতাটা লক্ষণীয়। নিজের ছেলের পুরুষস্বত্তার কাছে স্ত্রী ও রাজ্য হারানোর ভয় ছিল তার। এজন্যই সে শিশুপুত্রকে হত্যা করতে চেয়েছিল।
ইশিগুরোর গল্পে গুরুগম্ভীর বাবার তার নিজের ছেলের সাথে একটি প্রতিযোগীতা ছিল। তিনি চাইতেন তার ছেলে জাপানী ঐতিহ্য গ্রহণ করুক এবং তাদের সাথে থাকুক। তিনি চাইতেন না যে সে পশ্চিমা সংস্কৃতিতে চলে যাক। নিজের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, সামুরাই বংশ গৌরব ছেলের হাতে হারানোর ভয় করতেন বাবা।
লাইউসের মত এই বাবাও নিষ্ঠুর ছিলেন নিজের অবস্থান ধরে রাখতে। ফলে ওডিপাসের মত তার সন্তানও দূরে সরে যায়। অনেকদিন পরে ওডিপাসের সাথে লাইউসের দেখা হয়, এবং পরস্পর অপরিচিত থাকায় লাইউস সন্তানের হাতে খুন হন।
ভালোভাবে লক্ষ করলে দেখা যায়, ইশিগুরোর গল্পেও বাবা সন্তানের হাতে খুনই হয়েছেন যখন সন্তান তার দেশে থেকে যাবার পরোক্ষ আহবানে সাড়া দেয় নি, নিরুত্তাপ থেকেছে। এই বাবা আত্মহত্যা যদি করেন তাহলে লাইউস-ওডিপাসের গল্পটির মতই হবে ব্যাপারটা।
অন্যদিকে ওডিসাস এবং টেলেমাকাস যখন মিলিত হয় বহুদিন পরে, অশ্রুসিক্ত ভাবে একজন আরেকজনকে জড়িয়ে ধরে। দীর্ঘক্ষণ তারা কাঁদে। পিতাপুত্রের এমন একটা মিলনের পূর্বাভাস মাসুদ খানের গল্পটিতে আছে, ছাত্তার ও তার পুত্র মোস্তফার মাঝে। যদিও দীর্ঘদিন দূরে থাকার জন্য তাদের মধ্যে যোগাযোগহীনতা আছে, তথাপি মনে হয় যেহেতু তাদের ভেতরে পরস্পরের জন্য ভালোবাসা রয়েছে, তার প্রকাশ হচ্ছে, তখন তারা ছেড়া সুতাটি মেরামতে স্বক্ষম হবে। এবং ওডিসাস-টেলেমাকাসের মত পিতা-পুত্রের মমতা মিলন হবে ছাত্তার ও মোস্তফার মধ্যে।
*ছবি স্বত্ব যারা একেছেন তাদের।