মুরাদুল ইসলাম » বই রিভিউ » সবচাইতে সেরা খান

সবচাইতে সেরা খান

জ্যাক ওয়েদারফোর্ড তার বই চেংগিশ খানঃ দ্য মেকিং অব দ্য মর্ডার্ন ওয়ার্ল্ডে তিনি একটা ইতিহাস দেখাতে চেয়েছেন যেটি চেংগিশ খান যে অসভ্য, বর্বর, হিংস্র আক্রমণকারী হিসেবে পরিচিত, তার চাইতে ভিন্ন। চেংগিশ খানের কিছু বৈশিষ্ট্য, টেকনিকস ও স্ট্র্যাটেজির পরিচয় মিলে এই বইতে। যে ফাউন্ডেশনাল ভ্যালু ও স্ট্র্যাটেজি খান ব্যবহার করেছেন তা যেকোন আধুনিক মানুষের জন্য দরকারী।

প্রথমত এখানে স্ট্র্যাটেজি, প্রিন্সিপল ও টেকটিকস সম্পর্কে ধারণা দরকার।

প্রিন্সিপল হচ্ছে মূলনীতি বা ফাউন্ডেশনাল ভ্যালু। যেগুলি আপনি ধারণ করেন আপনার লাইফের জন্য ও যা আপনাকে মিনিং দেয়।

ট্যাকটিকস হলো আলাদা আলাদা একশন বা কার্য, যা আপনি করে থাকেন।

আর স্ট্র্যাটেজি হচ্ছে কীভাবে ট্যাকটিকস আপনার প্রিন্সিপলের সাথে মিল রেখে চলবে, সেই ব্যাপারে পরিকল্পণা।

স্ট্র্যাটেজি গুরুত্বপূর্ণ লং টার্ম গেইমে খুবই দরকারী। আমার স্ট্র্যাটেজির একটা উদাহরণ নলেজের মাল্টিডিসিপ্লিনারি এপ্রোচ। ট্যাকটিকস হলো এর জন্য আমি যা করি বিভিন্ন সময়ে। আর এই দুটি সমন্বিত থাকে প্রিন্সিপলের সাথে।

এরকম, কিছু স্ট্র্যাটেজি দরকার মানুষের লাইফে, লং টার্ম লক্ষ্য থাকলে।

যেমন, ইনভেস্টিং এর একটা স্ট্র্যাটেজি হতে পারে এভয়েড রুইনস। মানে এমন কোন ঝুঁকি আপনি নিবেন না যাতে সর্বস্ব হারানোর ঝুঁকি থাকে। বিশেষত মার্কেট অনিশ্চিত, লাইফ অনিশ্চয়তা দিয়ে ঘেরা, এমন জায়গায় এভয়েড রুইন স্ট্র্যাটেজি হলো এন্টিফ্রাজাইল।

চেংগিশ খান মোংগল ট্রাইবদের সম্মিলিত করে মোংগল জাতি প্রতিষ্ঠিত করেন। রোমানরা ৪০০ বছরে যত জায়গা জয় করেছে এর চাইতে বেশি অঞ্চল জয় করেছিলেন চেংগিশ খান মাত্র ২৫ বছরে।

খান কোন শহরে জন্ম নেন নি। সেই সময়ের আধুনিক জ্ঞানের সাথেও তার পরিচয় ছিল না। তাহলে কীভাবে খান যুদ্ধসহ নানা বিষয়ের ইনসাইট পেলেন ও কার্যকর স্ট্র্যাটেজি বের করলেন এবং ঠিকভাবে প্রয়োগ করলেন?

খালি মিলিটারি স্ট্র্যাটেজি নয়। এর চাইতে কঠিন জিনিসের মুখোমুখি হতে হয় সম্রাটদের। যেমন, সেনাপতিদের বিদ্রোহ। প্রায় সব জায়গাতেই এটা দেখা যায়। খান যে ছয় দশক শাসন করেছেন, এর মধ্যে কোন সেনাপতি বিদ্রোহ করেন নি। এমন একটা ঘটনাও ঘটে নি। তার একজনকেও শাস্তি দিতে হয় নি।

খানের একটা সেরা স্ট্র্যাটেজি ছিল, বিজিত লোকদের তিনি সম মর্যাদায় নিজের ট্রাইবে নিয়ে নিতেন। অর্থাৎ দ্বিতীয় সারির নাগরিক তাদের হতে হতো না। এটি সাম্রাজ্যের মধ্যে একতা নিয়ে আসে।

যুদ্ধে যখন লুট হতো, তখন যেসব সৈন্য মারা যেত তাদের স্ত্রী সন্তানদের জন্য অংশ রাখার বিধান তিনি করেছিলেন। যাতে সেনার মাথায় এটা থাকে যে, সে মারা গেলেও লাভের অংশ তার পরিবার পাবে।

মোংগল ট্রাইবদের তিনি একত্র করেন। আগে তারা বিচ্ছিন্নভাবে ছিল। যেকোন মংগলকে দাস হিসেবে রাখা নিষিদ্ধ করেন। অবৈধ সন্তান বলে কিছু নাই এমন বিধান করেন। অর্থাৎ, যেভাবেই হোক সন্তান জন্ম নিয়েছে মানে সে অন্য সবার সমান একজন মানুষ। আধুনিক এই মানবিক চিন্তা তার ছিল, যেটি এই ২০২৯ সালের বাংলাদেশের সমাজও মানতে পারবে না।

মহিলাদের বিয়েতে বিক্রি করা নিষিদ্ধ করেন। এডাল্টারি অর্থাৎ বিবাহিত লোকের অন্যদের সাথে যৌনতা নিষিদ্ধ করেন। পশু চুরিকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ ঘোষনা করেন। প্রজননকালীন সময়ে প্রাণী হত্যা অবৈধ করেন। এবং শতভাগ ধর্মীয় স্বাধীনতার বিধান করেন।

চেংগিশ খানের এটিচিউড ছিল, সকল সময় ওপেন থাকা।বিভিন্ন কালচার থেকে তিনি আইডিয়া ও পদ্বতি গ্রহণ করেছেন। শিখতে থাকা, পরীক্ষা করা, এডাপ্ট করা। এবং সেখান থেকে অর্জিত জ্ঞান নিয়ে অবস্থান পরিবর্তন করতে হলে করা। এজন্য খান একই যুদ্ধ দুইবার করেন নি।

যুদ্ধের স্ট্র্যাটেজির মধ্যে তার ছিল প্রতিপক্ষকে ভীত করে তোলা,  চমকে দেয়া, খুবই দ্রুত ট্রাভেল করা। এটি পরবর্তীকালে অনেক সম্রাট ব্যবহার করেছেন, যেমন আকবর। খান দ্রুততার সাথে ভ্রমণ করতে ঘোড়সওয়ার সৈন্যদের নিয়ে অগ্রসর হতেন। যাতে খাবার দাবার বেশি নিতে না হয় এজন্য শীতের সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করতেন যখন পর্যাপ্ত ঘাস থাকে। সাথে ইঞ্জিনিয়ারিং টিম নিয়ে যেতেন যাতে কোন কিছু বানানোর দরকার পড়লে তারা বানিয়ে নিতে পারে, ফলে বিশাল যন্ত্রবহর নিয়ে চলতে হতো না।

খানের সৈন্যরা পিছু হটতো। প্রতিপক্ষ মনে করতো যে তারা পরাজিত হয়ে পিছনে যাচ্ছে। অতি আত্মবিশ্বাস জন্মাত প্রতিপক্ষের। তারা ভুল করতো, এগুতে এগুতে তারা ক্লান্ত হয়ে পড়লে খানের সৈন্যরা আক্রমণ ভয়ানক আক্রমণ করতো।

এই স্ট্র্যাটেজি দেখা যায় জিনিয়াস, গ্রেট মোহাম্মদ আলীর ১৯৭৪ সালের রাম্বল ইন দি জাংগল ফাইটে। সেই ফাইটে হার্ড হিটিং জর্জ ফোরম্যান ছিলেন ফেভারিট। আর আলী ছিলেন আন্ডারডগ। সমস্ত মিডিয়া বলছিল আলী পারবেন না, কারণ তিনি সাড়ে তিন বছর বক্সিং এর বাইরে থেকে ফিরতে চেষ্টা করছেন, অন্যদিকে ফোরম্যান তখন অপরাজিত হেভিওয়েট চ্যাম্পিয়ন। এটি একটি চমৎকার ফাইট। ইউটিউবে দেখতে পারবেন। বেশি শক্তিশালী প্রতিপক্ষের বিপক্ষে ভালো স্ট্র্যাটেজি আর মেন্টাল টাফনেসের মাধ্যমে জিতে গিয়েছিলেন আলী। আলীই সম্ভবত দুনিয়ার সবচাইতে বড় ক্রীড়াবিদ।

রাম্বল ইন দ্য জাঙ্গলের একটা এনালাইস নিচের ভিডিওতে আছে। সবচাইতে অসাধারণ একটা ব্যাপার, ফোরম্যান যখন মাটিতে পড়ে যাচ্ছিলেন আলী তখন তাকে আর পাঞ্চ করেন নি। ইন্টারভিউতে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল এ নিয়ে। আলী উত্তর দেন, এমনিতেই তার যথেষ্ট হয়েছিল তাই তার পাঞ্চ করি নি। এই এটিচিউড গ্রেট আলীর পক্ষেই সম্ভব হয়, যিনি ঐ দীর্ঘ ফাইটের শেষপর্যায়েও এতো স্থিতধী ছিলেন।

খান সম্ভ্রান্তবাদী ধারণায় বিশ্বাস করতেন না। বিজিত অঞ্চলের সম্ভ্রান্তদের প্রথমেই কচুকাটা করা হতো। তারা জন্ম হয়েছে সম্ভ্রান্ত পরিবারে তাই বেশি সুবিধা পাবে এমন কিছু অস্তিত্ব না থাকে, ও ভবিষ্যত বিদ্রোহের সম্ভাবনা না থাকে। খান গুরুত্ব দিতেন ব্যক্তিগত প্রতিভা, লয়ালটি, এবং অর্জনকে। এজন্য তিনি তার চারপাশে জ্ঞানী ব্যক্তিদের রাখতেন, জাত পাত বিবেচনা না করে।

খানের সমাজ যেহেতু ট্রাইব ভিত্তিক ছিল তাই তাদের নিজেদের এমন কোন মতাদর্শবাদী চিন্তা ছিল না যা অন্যদের উপর চাপিয়ে দেয়া যায়। ফলে তারা বিজিত লোকদের উপর নিজেদের ধর্ম বা মত চাপায় নি। বরং সকল মতের বা ধর্মের লোকদের ব্যাপারে ওপেন থেকেছে।

খান এইভাবে আধুনিক বিশ্বের ভিত্তি স্থাপন করে। মুক্ত ব্যবসা, শেয়ারড নলেজ, মুক্ত যোগাযোগ, ধর্মীয় সহাবস্থান, দেশের আইন ও ধর্মের পৃথকীকরন বা সেক্যুলারিজম, কূটনীতিকের নিরাপত্তা, এবং আন্তর্জাতিক আইন ইত্যাদির সূচনা তার মাধ্যমেই।

Leave a Comment

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

×
গুরুত্বপূর্ণ
Scroll to Top
বই মডেলিং