এই পর্যন্ত যা শিখলাম – ২০১৯

এই লেখাটি হচ্ছে আমার জীবনের শিক্ষা নিয়ে। এ পর্যন্ত যেসব জিনিস আমি শিখেছি বা বুঝতে পেরেছি। এটি কখনো জীবনের মিনিং নিয়ে, কখনো কেরিয়ার বিষয়ক, আর কখনো আমাদের তথা মানুষদের বিষয়ে। শেখার মাধ্যম ছিল অভিজ্ঞতা, যেটি মানুষের সাথে চলাফেরা থেকে শুরু করে পড়া ও দেখা নিয়ে ঘটিত। আমার এইসব জীবন বুঝের তালিকা প্রতি বছর একটি করে প্রকাশ করব ইচ্ছা আছে। অনেক জীবন বুঝ আবার পরিবর্তিত বা পরিবর্ধিতও হতে পারে পরবর্তী কোন অভিজ্ঞতায়। সেই সম্ভাবনাকে জারি রেখেই লেখাটি শুরু করা যাক।

১। দুনিয়া একটি কমপ্লেক্স বা জটিল সিস্টেম। এখানে এক তরফা সহজ সমাধান বা এমন কোন মতাদর্শ নেই যা সকল সমস্যার সমাধান দিতে পারবে বা সকল কিছুর ব্যাখ্যা দিতে পারে। এই অবস্থায় সবচাইতে ভালো পন্থা হলো, সকল সময় ওপেন থাকা।

২। সকল কথার বিরুদ্ধেই বিরুদ্ধ যুক্তি দেয়া যায়। গর্দভেরা সব ক্ষেত্রে বিরুদ্ধ যুক্তি দিয়ে জিততে চায়। কিন্তু ভালো পন্থা হলো, নিজের বা সমাজের উন্নতির কাজে লাগানো গেলে তা করা।

যেমন, ধরা যাক একজন বলল, প্রতিদিন চল্লিশ মিনিট হাঁটা বা ব্যায়াম করা ভালো। এর বিরুদ্ধে একশোটা কথা বলা যায়। কিন্তু তাতে আপনার লাভ কী? অনলাইনে স্মার্ট বুঝানো নিজেকে? না, নিজেকে স্মার্ট বুঝানো নয় স্মার্ট হয়ে উঠা গুরুত্বপূর্ণ। এর জন্য পরামর্শটি থেকে আপনার লাভ হলে সেটা করাই যায়।

তর্কে জেতার, আর জেতা দুই জিনিস এক নয়। তর্কে জেতার ট্র্যাপে পড়া যাবে না।

৩। ক্রিটিক্যাল থিংকিং বাড়ানোর জন্য প্রথমে দরকার এর জন্য তীব্র আকাঙ্খা। দুই, লেখা। তিন, ক্রিটিক্যাল থিংকিং রিলেটেড বই বা আর্টিকেল পড়া।

৪। পরামর্শ নেয়ার ক্ষেত্রে উইন উইন সিচুয়েশন দেখা ভালো। সবাই পরামর্শ দিচ্ছে। প্রতিটা স্ট্যাটাসে ম্যানিপুলেট করতে চাচ্ছে, প্রভাবিত করতে চাচ্ছে।

পরামর্শ নেয়ার ক্ষেত্রে যেটা নিয়ে কাজ করলে লাভ হবে বেশি, কিন্তু লস হলে হবে অল্প সেটাই করা উচিত।

কারণ, যে পরামর্শ দিচ্ছে সে অনলাইনের চরিত্র। দুই তিন অক্ষরের নাম, কিছু ছবি, কিছু ক্রেডেনশিয়াল। আপনি জানেন না বাস্তব জীবনে সে কেমন। কর্পোরেট বড় চাকরি করে হয়ত আপনাকে দিচ্ছে না খেয়ে থাকার, ভুখা থাকার মতাদর্শের পরামর্শ।

তার স্কিন খেলায় আছে কি না আপনি জানেন না। তথ্যের দুই দিক নাই আপনার কাছে।

এমন অবস্থায় এই রিস্ক নিতে পারেন না যেখানে পরামর্শ মত কাজ করে লস হলে মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়বেন আপনি।

৫। দুনিয়া আপনার স্কিল দেখবে। আপনি কী দিতে পারছেন তা দেখবে। আপনার মনে কী আছে, কতো ভালো মানুষ মনে মনে আপনি, এগুলি মূল্যহীন।

৬। লাইফ কখনো সারভাইভাল অব দি ফিটেস্ট না। কেবল চরম ফিটরাই টিকে থাকে এমন না। শুধুমাত্র চরম আনফিটরাই টিকে থাকে না।

এখন, যেভাবে সবাই ফেসবুকে নিজেকে আনফিট বা মিসফিট বলে এমন কি আসলেই বাস্তবে হয়?

না।

ফেইসবুকে মানুষ তার যে চরিত্র শো করে, বাস্তবে সে এটি নাও হতে পারে।

চরম ব্যক্তিত্বওয়ালা ফেইসবুক এক পরামর্শদাতাকে আমি চোখের সামনে মুখ কাচুমাচু করে তার বসকে ‘স্লামালিকুম ভাই’ বলতে দেখেছি, কেবল সিস্টেমের সাথে মিলিয়ে চলতে।

৭।  খুব কম মানুষই লেখা পড়বে, এবং এটি কোন সমস্যা না।

৮।  আন-হেলদি নার্সিসিজম লেখক চিন্তক বা ক্রিয়েটিভ লোকদের জন্য আত্মঘাতি রোগসম। ফেইসবুক এতে ফুয়েল জোগায়।

৯।  সব সময় সেরাদের লেখা পড়া ও তাদের সাথে যোগাযোগ রাখা আপনাকেও সেরা বানাতে পারে। যেমন, একটি শিম্পাঞ্জির আচার বুঝা যায় কোন পাঁচ শিম্পের সাথে সে চলে তাদের দেখে।

মানুষের সাথে সম্পর্ক ও সামাজিকতায় সে কেমন মানুষ সেটা গুরুত্বপূর্ণ, তার মতাদর্শ কী তা পরের বিষয়। সমমতাদর্শী হলেও লোকটি যদি ছোটলোক হয়, আর আপনি ছোটলোক না হন, তাহলে তার সাথে চলতে পারবেন না।

অনেকে মতাদর্শ বা সমমনাত্ব দেখে প্রথমে সামাজিকতার ক্ষেত্রে, আমি দেখি মানুষ কেমন।

১০।  জিমে তারা কখনো ভালো বডি বানাতে পারে না যারা অন্যের ভালো বডি দেখে এর বিউটি ধরতে পারে না। একই কথা অন্যসব ক্ষেত্রেও সত্য। বিউটি বিলং করবে তাদের কাছে, যারা এপ্রিশয়েট করতে পারে তাকে। এটা ইন্টেলেকচুয়াল বিউটি বা যে ধরনেরই হোক না কেন।

১১। হিংসুক ও ঈর্ষক হওয়া এবং এদের সাথে থাকা দুইটাই সমান খারাপ নিজের জন্য।

১২। ইন্টারনেট ব্যবহার করে এবং প্রয়োজনে মেন্টরিং এর সাহায্যে প্রায় যেকোন স্কিল একজন ডেভলাপ করতে পারেন। ভবিষ্যতে তারাই লাভবান হবেন যারা এখন থেকে এটি করবেন। কারণ বিদ্যমান শিক্ষাব্যবস্থা অকেজো হতে থাকবে দিন দিন। ল্যাম্বডা স্কুলেদের যুগে প্রবেশ করেছে শিক্ষাব্যবস্থা।

১৩। ক্রিটিক্যাল থিংকিং এর জন্য বিবর্তন, বিবর্তনীয় সাইকোলজি দরকারী।

১৪। লেখা ৫০০ বা ৫০০০ শব্দে হোক, এর পয়েন্ট থাকতে হবে। স্পষ্টভাবে লেখার ক্ষমতা সবার থাকে না।

১৫। প্রযুক্তিগত চেইঞ্জে কিছু মানুষ ইউজ করে, কিছু মানুষ ইউজড হয়। একজন সচেতন ব্যক্তি সাধারণত নিজে ঠিক করতে পারেন তিনি কোন দলে থাকবেন।

১৬। ইন্টারনেটের যুগে কেবল তথ্য (লেখা, ভিডিও, ফিল্ম, বই) গিলতে থাকা ব্যক্তিকে প্যাসিভ কনজিউমারে পরিণত করবে। এটি হতাশা বাড়াবে। ক্রিয়েটিভিটির জন্য এবং লাইফের হ্যাপিনেসের জন্য এটি খারাপ।

১৭। হ্যাপিনেসের জন্য ক্রিয়েট করা দরকার। গল্প, কবিতা, গান, ভিডিও বা সৃষ্টিশীল যেকোন কিছু।

১৮।  কারো শিল্প সাহিত্যের বুঝ খুব বেশি পরিবর্তন করা যায় না। এগুলি নির্ভর করে ২৫ বছর পর্যন্ত কোন সোশ্যাল ক্লাসে সে বেড়ে উঠেছে, কার কার সাথে মিশেছে, কার কার প্রভাব পড়েছে ইত্যাদির উপরে।

১৯। বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, ইনোভেশন, সাইকোলজি, এথিক্স গুরুত্বপূর্ণ।

২০। মানবিক সম্পর্ক ব্যতিত বাকী সব সম্পর্ক ভুয়া, থাকা না থাকা একই।

২১। একজন ভিলেনও হয়ত কারো কারো কাছে হিরো।

২২। কোন সাফল্যে খুবই উৎফুল্ল বা কোন ব্যর্থতায় খুবই মলিন হবার কিছু নেই।  কারণ ওই নির্দিষ্ট সময়ে আমরা আসলে বুঝতে পারব না পুরা লাইফের সাপেক্ষে ঘটনাটি আসলে ভালো না খারাপ ছিল। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় আমি দেখেছি যা ব্যর্থতা বলে মনে হয় এক সময়, অনেক পরে আবার এটাকেই আশীর্বাদ মনে হয়।

২৩। বই পড়া থিওরি কপচানো নয়, এতে কোন লাভ নেই। বরং জীবন ও বাস্তবতার সাথে কানেক্ট করতে হবে ও ব্যাখ্যা দিতে হবে। এটাই নতুন আইডিয়া, ইনোভেশন।

২৪। আমি দেখেছি মানুষ কেরিয়ারে বাইরে একরকম ও ভিতরে একরকম আচরণ করে যায়। বা নির্বিবাদী নিরামিষ হয়ে থাকে। এতে হয়ত তারা সফল হয়।

কিন্তু আমার মনে হয় যার প্রতিভা আছে ভালো, সে এরকম করবে না। যদিও এটি না করার পরামর্শ আমি কাউকে দেই না, বা করার কথাও বলি না, যেহেতু এটি ব্যক্তির চাকরির ইস্যু, ও পরিস্থিতি কী আমি জানি না।

আমার এখনো এটি করতে হয় নি। শান্তির জন্য আমার কাছে এরকম না হওয়াটা আমার জন্য আমার কাছে বেটার।

২৫। মহাবিশ্বের বিশালতা সম্পর্কে, ও দুনিয়ার বৈচিত্র, বয়স ও ইতিহাস সম্পর্কে ধারণা থাকা দরকারী, কারণ এতে নিজের অস্তিত্বকে অন্য সবের সাপেক্ষে দেখা যায়। ভালো বিনয় যেটি সেটি তখন আসে।

২৬। নৈতিক থাকা শর্ট টার্মে লাভজনক না, বরং রিস্কি। মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ। সহজ হলে সবাই নৈতিক ও ন্যায়পরায়ণ হয়ে থাকতো।  অর্থাৎ, নৈতিক থাকতে হলে শর্ট টার্মে ক্ষতি স্বাভাবিক।

২৭। কেউ কোন কিছু জানে না। কারো কাছে সমাধান নেই। তারা সাহায্য করতে পারে। কিন্তু যখন বিগার প্রশ্নগুলিতে যাওয়া যাবে জীবন বা অস্তিত্বের, কেউই কিছু জানে না আসলে।

২৮। কিওরিওসিটি বা কিওরিয়াস মানুষই বুদ্ধিমান মানুষ।

২৯। অলয়েজ লার্নিং এ থাকার মত অপেননেস, নিজের স্বক্ষমতার সীমার ভেতরে থাকা, ঘুম থেকে উঠার সময় যে স্মার্টনেস বা জানাশোনা ছিল রাতে ঘুমানোর সময় এর চাইতে বাড়িয়ে ঘুমানো প্রতিদিন, কম্পাউন্ড ইন্টারেস্ট চক্রে নলেজ বাড়ানো, এবং বুদ্ধিমান হবার চাইতে বোকা না হবার চেষ্টা করাই বেটার – চার্লি মাঙ্গারের এই পরামর্শগুলি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

৩০। কোন কিছুতে বেট না ধরার সিদ্ধান্ত নিজেই একটা বেট।

৩১। লাইফ অনিশ্চিত, তথ্য খুবই কম থাকে, এবং রহস্যজনক ভাবে ভাগ্যের প্রভাব রয়ে যায় প্রতিটি সিদ্ধান্তের আউটকামে। মানুষ সিদ্ধান্ত ভালো হলে নিজের সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতায় গর্বিত হয়ে ভুলে যায় কতটুকু অনিশ্চিত ছিল এটি বা আসলেই দুনিয়ায় অনিশ্চয়তা কতো প্রবল। অনিশ্চয়তা সম্পর্কে এই বোধ যার থাকবে সে নলেজ হাংরি থাকবে ধরা যায়।

৩২। বাইরের স্কোরকার্ড আর ভিতরের স্কোরকার্ডের পার্থক্য বুঝতে হবে, এবং এর মধ্য থেকে ভেতরের স্কোরকার্ডকে গুরুত্ব দিতে হবে।

ভেতরের স্কোরকার্ড হলো নিজের কাছে নিজের বিচার।

একজন যদি দুনিয়ার কাছে সেরা লাভার বলে পরিচিত হন, কিন্তু আসলে হোন খারাপ লাভার ব্যক্তি জীবনে, তাহলে এই জীবন খারাপ।

পক্ষান্তরে, দুনিয়ার কাছে খারাপ লাভার বলে পরিচিত কেউ যদি ব্যক্তি জীবনে সেরা লাভার হয়ে থাকেন, তাহলে তার জীবন সুখেরই হবে।

একইকথা বিয়ে, কেরিয়ার বা যা যা আছে, প্রায় সব ক্ষেত্রেই ধরা যায়।

প্রায় প্রত্যেক ক্ষেত্রে এমন ভিতরের স্কোরকার্ডকে গুরুত্ব দিতে হবে।

৩৩। মানুষ যুক্তিবিচারে চলে না। এটাই বাস্তবতা।