মুস্তফা আক্কাদের লায়ন অব দি ডেজার্ট ১৯৮১ সালের ফিল্ম। এই ফিল্মে ৩৫ মিলিয়ন ডলার ইনভেস্ট করছিলেন লিবিয়ার নেতা মুয়াম্মার গাদ্দাফি। ফিল্মের কাহিনী হইল, ফ্যাসিস্ট বেনিতো মুসোলিনির টাইমে লিবিয়ায় দখলদার ইতালিয়ান মিলিটারীদের বিরুদ্ধে লিবিয়ার বেদুইন নেতা ওমর মুখতারের বিদ্রোহ ও বীরত্বপূর্ণ ফাইট।
এইটা একটা যুদ্ধের এপিক ফিল্ম, যেইখানে ইতিহাসভিত্তিকভাবেই গল্পটা দেখানো হইছে বলে ফিল্মের আগে আগে বলা হয়। যে এইগুলা হিস্টরিক্যাল ফ্যাক্ট, মিছা না। কিন্তু তাও ফিল্মটা মুক্তির পরে সমালোচিত হয় পশ্চিমে, বিশেষত মুয়াম্মার গাদ্দাফির টাকা নেয়ায়। আর ইতালিতে হয় নিষিদ্ধ।
দখলদার ইতালিয়ান ও লিবিয়ান স্বাধীনতাকামী বিদ্রোহীদের মাঝের যুদ্ধটা স্থায়ী হইছিল ১৯২৩ থেকে ১৯৩২ পর্যন্ত। প্রায় বিশ বছর এই যুদ্ধের নেতৃত্ব দেন ওমর মুখতার। যারে নাম দেয়া হইছিল মরুভূমির সিংহ, লায়ন অব দি ডেজার্ট।
ফিল্মে তার কাহিনী, বা তার কাহিনী ইতিহাসে পড়লে সেই নাম দেয়াটা ন্যায্যই মনে হয়।
এই ফিল্মে কয়েকটা ক্রিটিক্যাল বিষয় আছে, যেইগুলা নিয়া আলোচনা করা যায়। এমনিতে এপিক ফিল্ম হিসাবে এই ফিল্ম ভালো, এর মেকিং এবং স্টোরি লাইন খারাপ না। শুধু শেষদিকে কিছুটা লম্বা মনে হইতে পারে।
মুসোলিনি জেনারেল রুদোলফো গ্রাজিয়ানিরে গভর্নর কইরা লিবিয়ায় পাঠানির মাধ্যমেই ফিল্মের শুরু। এই জায়গাটা ইন্টারেস্টিং। অথরিটি চরিত্র হিসাবে আমরা, একটা সাইকোপ্যাথিক ম্যানিয়াক টাইপের চরিত্র হিসাবে মুসোলিনিরে পাই।
গ্র্যাজিয়ানিরে মুসোলিনি পাঠায় লিবিয়ায়। ওমর মুখতাররে সাইজ করতে।
সেইখানে গিয়া গ্র্যাজিয়ানি মারাত্মক কিছু স্টেপ নেন। তিনি সাধারন মানুষের উপর নির্যাতন বাড়াইয়া দেন। তাদের ধইরা কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে নিয়া আসেন।
বাট তাও যুইথ করতে পারতেছিলেন না। কারণ ওমর মুখতার ও তার বেদুঈন বিদ্রোহী যোদ্ধারা গেরিলা পদ্বতিতে আক্রমণ করতেছিলেন। কখনো এমবুশ কইরা, কখনো এটাক কইরাই দৌড়।
গ্র্যাজিয়ানি নতুন গিয়া যখন সেনা অফিসারদের কঠিন কঠিন স্টেপ নিতে আদশ দেন, তখন দেখা যায় কোন কোন অফিসার একটা কিছু বলতে গেছিলেন। গ্র্যাজিয়ানি এইখানে অথরিটি ফিগার, কিছুই শুনেন নাই। পরে আবার দেখা যায় এই সেনা অফিসাররাই ভিলেনের মত নির্যাতন চালাইয়া যাইতেছেন কোন ধরণের গিল্ট ছাড়াই।
গ্র্যাজিয়ানির নিজের ক্ষেত্রেও একই দশা। মুসোলিনি তারে যখন নির্দেশ দিতেছিল ফিল্মের শুরুতে, তখন মুসোলিনিরে মনে হইতেছিল ভিলেন আর গ্র্যাজিয়ানিরে ঐরকম কিছু না। কিন্তু যখন গ্র্যাজিয়ানি লিবিয়ায় গেলেন, তখন তিনিই হইয়া উঠলেন ভিলেন।
এইটা অথরিটিরে অন্ধভাবে মাইনা যাওয়ার ফল। হানা আরেন্ট যেমন বলছিলেন এরা তো খারাপ লোক না, নর্মাল লোকই, কিন্তু এদের খারাপ কইরা তোলার মেকানিজমটাই হইল অন্ধ আনুগত্য।
একটা অফিসার এইরকম আনুগত্য দেখাইতে চায় না ফিল্মে। অন্যায় হইতেছে সে বুঝতে পারে। পুরা ইতালিয়ান ফোর্সের মধ্যে অন্য সব অফিসাররে আপনে দেখবেন রোবট হিসাবে, যারা মাইনা যাইতেছে উপরের অর্ডার। কিন্তু যেই অফিসার মানতে চায় নাই, তারে বলা হইছিল এক মেয়েরে ফাঁসির আদেশ দিতে, সে বলছিল আমি আর্মিতে যোগ দেই নাই মেয়েদের ফাঁসি দিতে, তারেই দেখবেন মানুষ হিসাবে।
অর্থাৎ অন্ধ আনুগত্য একটা অমানুষিক রোবট ভিলেনে পরিণত কইরা তোলে মানুষরে।
এই অফিসাররে গ্রাজিয়ানি সরাসরিই বলেন, তোমার বিবেক বুদ্ধির এইগুলা দিয়া বিচার করতে যাইও না। দেশের প্রয়োজন দেখো।
সিস্টেমের রোবটিক মেকানিজম ডেঞ্জারাস। এক যুদ্ধের মাঝখানে ইতালিয়ান এক অফিসারই এই মানবিক যেই অফিসার ছিল তারে গুল্লি কইরা মাইরা ফেলে। এমন লোকরে তারা রাখতে নাহি চায়।
হানা আরেন্ট যেইটা বলছিলেন জেনারেল আইখম্যানের ক্ষেত্রে, যে সেতো তার ব্যক্তিগত প্রফেশনাল উন্নতি ছাড়া আর কিছুই চায় নাই তেমন, সে কী করতেছে ইভেন তাও বুঝে নাই, সমগ্র প্রক্রিয়াটাই ছিল থটলেস, আর সে যে ভয়ানক ভিলেন না, বরং নর্মাল, এইটাই আমাদের জন্য ডেঞ্জারাস বিষয়। কারণ তখন আমাদের ভাবতে হয় ঐ মেকানিজম নিয়া, আনুগত্য ও চিন্তাহীনতা নিয়া, যেইটা একজন নর্মাল লোকরে দুনিয়ার সবচাইতে বড় ক্রাইমগুলা করাইয়া ফেলে।
গ্র্যাজিয়ানির ক্ষেত্রে তার পার্সোনাল উচ্চাকাঙ্খা ছিল মিলিটারি ইতিহাসে তার নাম থাকবে এই যুদ্ধের ফলে। এর জন্য উনি যা দরকার তাই কইরা গেছেন। একের পর এক স্ট্র্যাটেজি নিছেন ওমর মুখতাররে ধরাসায়ী করতে। তার মিলিটারী একাডেমীতে পড়া জ্ঞান ও অহংকার মিশানো একেকটা স্টেপ যখন মুখতার ধইরা ধইরা প্রতিউত্তর দিতেছিলেন, উন্নত সামরিক ট্যাংকের বিপরীতে ঘোড়ায় চরা বাহিনী নিয়া, তখন এক পর্যায়ে গ্র্যাজিয়ানি বুইঝা যান যে, মিলিটারি জ্ঞানে মুখতার অনেক আগাইয়া থাকা একজন।
মুখতাররে যখন ধরা হয় তখন, ফিল্মে দেখা যায়, গ্র্যাজিয়ানির একটা শ্রদ্ধা ছিল তার প্রতি।
যখন লিবিয়ায় ইতালিয়ান একটা কোর্টে নিয়া বিচার হয় বিদ্রোহের জন্য, সেই সাজানো বিচারে আরেকজন ইতালিয়ান অফিসার মুখতারের বিদ্রোহের পক্ষে দুই একটা কথা বলেন। তিনি বলেন যে, উনি উনার দেশ বাঁচাইতে লড়তেছেন, আর উনি এই বিশ বছরে আমাদের কাছে নত হন নাই আর আমরা তারে কিনতেও পারি নাই টাকা দিয়া।
উপস্থিত জনতা হই হই কইরা উঠে চিৎকারে। কারণ তাদের কাছে মুখতার ভিলেন। তাদের এই চিৎকার চেঁচামেচি দেখায় পপুলিজমের বিপদ। হানা আরেন্টের আরেকটা কথা এইখানে বলা যায়। তিনি বলছিলেন, দুঃখজনক সত্যটা হইল বেশিরভাগ ইভিলই করে ঐসব লোক যারা ঠিক করতে পারে না তারা ভালো না খারাপ হবে।
আরেন্ট এই থটলেসনেস, বা চিন্তাহীনতারে ভয়ানক মনে করেন। এইটাই ইভিল।
কোর্টের লোকজনের ঐ চিৎকারে, মুসোলিনির বক্তৃতার পরে উল্লসিত লোকদের চিৎকারে, দেশে দেশে বর্তমানে পপুলিজমের বিস্তারে আমরা এইটাই দেখতে পাই। এইটাই ইভিল। এইখানেই ইভিলের জন্মগৃহ।
ওমর মুখতাররে ফাঁসি দেয়া হয় ১৬ সেপ্টেম্বর ১৯৩১ সালে।