মানুষ কখনো “একা” না 

আধুনিক সমাজের আবিষ্কৃত ধারণা “একাকীত্ব” “লোনলিনেস” বা “নিঃসঙ্গতা”, ব্যক্তি এক “আমি”র উপর ভিত্তি করে। কিন্তু যেহেতু ব্যক্তির এক আমি বলতে কিছু নাই তাই, নিঃসঙ্গতা বলতেও কিছু থাকতে পারে না। 

ব্যক্তি সবসময়েই তার চিন্তায় আরেক ব্যক্তি, যার সাথে তার কথোপকথন চলে। যে নানা মত দেয়, সমালোচনা করে। যেখানেই ব্যক্তি অবস্থান করুক, এটাই তার বাস্তবতা। 

স্কিজোফ্রেনিক অবস্থায়, এই চিন্তার আমি বেশি স্পষ্ট হয়ে যায়, এবং ব্যক্তি ওই চিন্তার আমিকে সরাসরি আলাদা করে অনুভব করতে পারে অনেক সময়। এইসময় তার সাইকোসিস হয়, সে ভয়েজ ইত্যাদি শুনে। বাইকামেরাল মাইন্ড হাইপোথিসিস অনুযায়ী প্রাচীনকালে মানুষের অবস্থা স্বাভাবিক অবস্থাতেও ওইরকম ছিল। 

এছাড়া ব্যক্তি আরও অনেক অবস্থান তৈরি করতে পারে। যেমন ডেভিড লিঞ্চের টুইন পিকসে এজেন্ট কুপার টেপ রেকর্ডারে তার কথা রেকর্ড করে, ডায়ান নামক একজনের সাথে কথাবার্তা বলে গেছে। এই কথোপকথন সে চালিয়ে যেতে পেরেছে যেকোন সময়ে। এন্ডি ওয়ারহল এইরকম করতেন, তাই বলেছিলেন তিনি তার টেপ রেকর্ডারকে বিয়ে করে ফেলেছেন।  

এখন প্রযুক্তিগত উন্নয়নের কারণে এমন রেকর্ডিং ডিভাইস আরও সহজ হয়েছে। 

মানুষ এখন ফেসবুক ইত্যাদি সোশ্যাল মিডিয়ায় নিজের আরেক অবস্থান তৈরি করতে পারে। যেখানে ব্যক্তি সে, এবং তার ডিজিটাল অস্তিত্ব, দুইজন। তারা দুইজন একসাথে যেহেতু আছে, তথাপি ফেসবুকে তার কোন ফ্রেন্ড না থাকলেও সে একা না। 

একজন ব্যক্তি যখন বই পড়েন, জ্ঞান শুনেন, ফিল্ম দেখেন তখন তিনি একা না। ওইসব মিডিয়ায় উপস্থাপিত ঘটনার তার যোগাযোগ হয়। 

সে সব সময়েই দোকা। 

এখন বিভিন্ন ধরণের দোকা আছে। যেমন বন্ধুদের সাথে আড্ডা, আত্মীয়দের অনুষ্ঠানে যাওয়া, কোন সেমিনারে যাওয়া ইত্যাদি একেকটা একেকরকম দোকা হওয়া। 

কেউ একটারে প্রেফার করতে পারে অন্যটার চাইতে কোন সময়ে। 

একাকীত্ব বলতে যে জিনিশ আধুনিক সমাজ পুশ করে তা হচ্ছে, একজন ব্যক্তি যখন নিজে “দোকা” আছে, ওইটারে খারাপ হিশাবে দেখানো, এবং অন্য “দোকা” অবস্থারে প্রমোট করা। এখানে তার ব্যবসায়িক স্বার্থ থাকতে পারে, সে স্বাস্থ্যগত কারণ দেখাতে পারে, ইত্যাদি ইত্যাদি। 

কিন্তু সে অন্তোলজিক্যাল ভুল একটা ধারণা পুশ করে। 

ব্যক্তি যদি সেই ধারণা বিশ্বাস করে, তাহলে তার চিন্তার আমি তারে সমালোচনা করতে থাকে। বলতে থাকে যে সে একা আছে, হতাশ আছে। এবং সে ফিল করতে থাকে খারাপ অবস্থা। 

যেমন, আপনি আত্মীয়দের অনুষ্ঠানে গিয়ে ‘দোকা” আছেন। তখন আপনার কিছু বিশ্বস্থ আত্মীয় কানের কাছে এসে শুধু বলতে লাগল এই “দোকা” আসলে দোকা না, একা। এর চাইতে বন্ধুদের আড্ডা, বেড়াতে যাওয়া ইত্যাদি প্রকৃত দোকা। ওইখানে আপনি যে যেতে পারেন নাই সেইজন্য অনবরত আপনাকে গিল্ট ফিল দিতে থাকল। একপ্রকার গ্যাসলাইটিং। 

ব্যক্তি এসব বিশ্বাস করে ফেললে তার খারাপ লাগবে, সে ডিপ্রেশনে পড়ে যাবে এই ভেবে যে সে একা আছে, এবং এই ফিলটার নাম দেয়া হয়েছে একাকীত্ব, নিঃসঙ্গতা। 

ফলে, নিঃসঙ্গতা হচ্ছে আধুনিক সমাজের পুশ করে দেয়া ওই ফিলিং যে, আপনাকে সবাই বাদ দিয়ে দিয়েছে, কেউ মিশতে চায় না, আপনার কোন বন্ধু নেই, আপনে একা ইত্যাদি। নিঃসঙ্গতা সবসময় আপনি এক্সক্লুড হইছেন মানুষের সমাজ থেকে এমন ফিলিং। 

যদি বাস্তবে কেউ একা নয়, নিজেই সে দোকা। টেকনোলজির কারণে অনেক। কান্ধের দুই ফরিশতা হিশাবে ধরলে আরও দুইজন যোগ হইলেন।