বই নিয়ে আমাদের মৌলিক বিভ্রান্তিদের একটা হলো নতুন বই পড়তে হবে। এটা নিছকই ট্রেন্ড। যেমন নতুন পণ্য সংগ্রহ করার কনজিউমারিজম। ফলত, বইমেলাকে নতুন বইয়ের বিক্রি হিসাবে ধরলে, আপনি এর একটা কনজিউমারিস্ট চরিত্র দেখতে পাবেন।
এর ক্ষতি বেশি। এখানে বই পড়ার প্রকৃত উদ্দেশ্য ব্যাহত হয়। প্রকৃত উদ্দেশ্য বলতে মহৎ ও সেরা বই পড়া এবং সেগুলিকে নিজের বুঝ ও জীবনে কাজে লাগানো বুঝাচ্ছি। এই উদ্দেশ্য আপনার না হলে, দুঃখিত, আপনি ভুল সাইটে এসেছেন, এই লেখা আপনার জন্য নয়। আপনার জন্য প্রযোজ্যও নয়।
এই যে বছর বছর বই বের হয় এগুলা পড়তেই হবে এমন কোন কারণ আমি দেখি না।
অনেক সেরা সেরা পুরনো বই আছে। যেগুলি অনেককাল আগে প্রকাশ হয়েছে। হয়ত খুবই কম পাঠক পড়েছেন, কিন্তু এগুলি খুবই মূল্যবান। যেই পড়ার উদ্দেশ্যের কথা উপরে বললাম তার জন্য এগুলা কার্যকরী।
আজকে বৈষ্ণব পদাবলী বিষয়ে দীনেশচন্দ্র সেনের একটি লেখা পড়ছিলাম উইকিসোর্সে। এই উইকিসোর্স পুরাতন অনেক মূল্যবান লেখা প্রাপ্তির জায়গা। ব্রাউজ করতে গিয়ে স্টোয়িক দার্শনিক ও রোমান সম্রাট মার্কাস ঔরেলিয়াসের আত্মচিন্তা বা মেডিটেশনের বাংলা অনুবাদ সেখানে পেলাম, যেটা করেছেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর।
স্টোয়িক দার্শনিক বা যেকোন দার্শনিকদের কাজে এই জিনিস হয়, যে তারা পূর্বেকার দার্শনিকদের কথা বা লেখাকে ব্যাখ্যা করেন।
ঔরেলিয়াসের আত্মচিন্তা বাংলায় পড়তে গিয়ে তার একটি চিন্তা বর্তমান কালের সাথে মিলিয়ে ব্যাখ্যা করলাম আমি। আর আরো কয়েকটি যুক্ত করলাম বই থেকে। কোট মার্কের ভেতরের কথাগুলি ঔরেলিয়াসের, এবং জ্যোতিরিন্দ্রনাথের বাংলায় অনুবাদ।
১।
“অন্যের সহিত যেখানে তোমার স্বার্থ সমান সেই স্থল ছাড়া আর কোন স্থলেই অন্যের বিষয় লইয়া তোমার মনকে ব্যাপৃত রাখিবে না। পরচর্চ্চায় মন দিলে—অর্থাৎ অপরে কি কথা বলিতেছে, কি ভাবিতেছে, কি ফন্দি করিতেছে, কি মৎলবে কি কাজ করিতেছে—এই সমস্ত বিষয় ভাবিতে গেলে, আপনাকে ভুলিয়া যাইতে হয়,—আপনার জীবনের ধ্রুব লক্ষ্য হইতে পরিভ্রষ্ট হইতে হয়। অতএব নিরর্থক কোন বিষয়ে আপনার মনকে ব্যাপৃত রাখিবে না, কিংবা তোমার চিন্তার প্রবাহের মধ্যে আর কোন অপ্রাসঙ্গিক কথা অনিয়া ফেলিবে না। বিশেষতঃ এইরূপ অনুসন্ধানে অযথা কৌতুহল ও দ্বেষহিংসা বর্জ্জন করিবে।“
ফেসবুক সোশ্যাল মিডিয়া হিসেবে চলে পরচর্চার উপর ভিত্তি করে। যেমন, কোন সেলিব্রেটি কাকে ডিভোর্স দিয়েছে, কাকে বিয়ে করছে, এরকম আরো অনেক বিষয় নিয়ে স্ট্যাটাস, মতামত, ট্রল, পালটা ট্রল। কিন্তু এগুলির কোন দরকার আছে কি?
মানে, ঐ সেলিব্রেটি কি আমার লাইফের অংশ? তার বিয়া বা বিচ্ছেদ বা লিভ টুগেদার বা গাঞ্জা খাওয়া বা নাচানাচি বা এনিথিং, আমার কি কোন ক্ষতি করতেছে?
মানুষ বাঁচেই কয়বছর শাউয়া! মে বি ১০০ বছর। ৩০/৪০ চলে যায় ফিগার আউট করতে করতে যে আমি আসলে কই বা কী করব। তাও নানা রোগ শোক অনাকাঙ্খিত বিপদ আপদ তো আছেই। এর মাঝে মানুষ লাইফরে উপভোগ করতে চায়। তার মতো সে আমার কোন ক্ষতি না করে হ্যাপি থাকতে পারলে থাক। অন্যের লাইফ বিষয়ে মতামত দেয়া, অযথা কৌতুহল, জাজমেন্টাল হওয়া – এগুলা খুবই বেসিক লেভেলের সিরিয়াস প্রবলেম।
এবং এসব ওই ব্যক্তির ক্ষতি করার চাইতে আপনার বেশি ক্ষতি করবে। ঐ ব্যক্তির ক্ষতি করতে পারবে না, ঐ ব্যক্তি যদি ভাবে যে অন্যের মতামতে কিছু যায় আসে না, আমার নিজের বিচারই মূখ্য। ইনার মেট্রিক। আপনি নিজে জানেন আপনি চোর, আর সারা দুনিয়ার লোক আপনারে সাধু বলে, এতে নিজের কাছে তো আপনি চোরই থাকেন। আর উলটাটাও, আপনি সাধু হইলে, দুনিয়ার লোক চোর বললে কি যায় আসে!
ফেইসবুক এন্টারটেইনমেন্টের বেশিরভাগ চলে অন্যের প্রতি বিদ্বেষ ও হিংসা থেকে।
অনেকে ভাবতে পারেন টেকনোলজি মানুষকে খারাপ করে দিয়েছে।
আসলে এটি ঠিক না পুরোপুরি।
মানুষের প্রকৃতির ভেতরে এটা ছিল। ফেইসবুকের মত প্রযুক্তি তা প্রকাশ করার জায়গা দিয়েছে মাত্র।
কেন মানুষের প্রকৃতির ভেতরে এগুলি? কারণ সত্যিটা হলো, কৃষিভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থা শুরু হয়েছে খুবই অল্পদিন। আমাদের পূর্বপুরুষেরা (গাঠনিকভাবে মর্ডার্ণ ম্যান,যারা আছে ২০০ হাজার বছর ধরে) ৯৫ ভাগ সময়েই ছিল হান্টার-গেদারার। প্রায় বারো হাজার বছর আগে থেকে কৃষিপ্রযুক্তিগ্রহণ শুরু হয় মানুষের।
এবং শিল্পবিপ্লবের পরের যে আধুনিকতা, তা আরো আরো অল্প সময়ের।
তাই মানুষের ভেতরে জিনগত কারণেই অযৌক্তিক আবেগ, হিংসা, দ্বেষ এগুলি রয়েছে। মানুষ আত্ম সচেতন না হয়ে, এগুলি যদি নিয়ন্ত্রণ না করে, তাহলে সে এগুলি দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত হবে। আর সাধারণ মানুষের সেই বুঝ কই আত্ম সচেতনতার!
২।
“অনিচ্ছুক হইয়া, স্বার্থপর হইয়া, পরামর্শ না করিয়া, কিংবা মনের আকস্মিক আবেগে কোন কাজ করিবে না। অদ্ভুত ধরণধারণ কিংবা রসিকতা প্রকাশ করিবারও চেষ্টা করিবে না। যতটা আবশ্যক তাহা অপেক্ষা বেশী কথা কহিবে না, অন্যের বিষয়ে হস্তক্ষেপ করিবে না। তোমার যে অন্তর্দেবতা তোমার ভার গ্রহণ করিয়াছেন, সাবধান তুমি যেন তাঁহার বিশ্বাস না হারাও। তুমি যদি পুরুষ হও তো ঠিক পুরুষের মতন যদি স্ত্রীলোক হও তো ঠিক স্ত্রীলোকের মতন, তোমার যে বয়সই হউক ঠিক সেই বয়সের মতন আচরণ করিবে। পূৰ্ব্ব হইতেই এমন ভাবে লোকের নিকট তোমার বিশ্বাস ও পসার বজায় রাখিবে যে, হিসাব নিকাশের ছাড়পত্র চাহিবার সময়ে যেন তোমার শপথ করিতে না হয়—খরচের স্বাক্ষর-নিদর্শন দেখাইতে না হয়।“
৩। “আর যত চিন্তা আলোচনা, সমস্তই তোমার মস্তিষ্ক হইতে দূর করিয়া দেও; কেবল উপরিউক্ত দুই চারিটি উপদেশ মনে রাখিও; আর মনে রাখিও, প্রতি মনুষ্যের জীবন বৰ্ত্তমানেই অবস্থিত,—যে বর্ত্তমানকাল কালের একটি বিন্দুমাত্র; কেননা, যাহা অতীত, তাহা অতিবাহিত হইয়াছে এবং ভবিষ্যৎকাল অনিশ্চিত। জীবনের গতি সঙ্কীর্ণ পরিসরের মধ্যে বদ্ধ; এবং মানুষ যেখানে অবস্থিতি করে, তাহাও জগতের একটি ক্ষুদ্র কোণ মাত্র। যে যশ খুব দীর্ঘস্থায়ী, তাহাই বা কতদিনের জন্য? হায়! যে সব ক্ষণস্থায়ী দীন মর্ত্ত্য মানব পৃথিবীতে একটু যশ রাখিয়া যায়, তাহারা আপনাদের সম্বন্ধে অল্পই জানে; এবং তাহাদের সম্বন্ধেও আরও কম জানে, যাহারা তাহাদের বহুপূৰ্ব্বে কালগ্রাসে পতিত হইয়াছে।“
৪। “যাহাতে মনুষ্যত্বের হীনতা হয়, তাহাতেই মানুষের প্রকৃত হীনতা। তা ছাড়া,—কি বাহিরে, কি অন্তরে,—মানুষের আর কোন অনিষ্টের কারণ নাই।“
৫। “যে ব্যক্তি পরছিদ্রানুসন্ধান না করিয়া, পরচর্চ্চা না করিয়া, কিসে আপনি ভাল হইবে, সৎ হইবে, সেই উদ্দেশে আপনার প্রতিই তাহার সমস্ত অন্তর্দৃষ্টি নিয়োগ করে, সে ব্যক্তি কতটা সময় হাতে পায়, তাহার কাজ কত সহজ হইয়া পড়ে।“
৬। “আমি মরিয়া গেলে, আমার কথা লইয়া সকলেই বলাবলি করিবে,—এই মনে করিয়া যাহারা আপনার স্মৃতির জন্য অত্যন্ত ব্যগ্র হয়, তাহারা ভাবে না, তাহার পরিচিত লোক সকলেই চলিয়া যাইবে। বংশপরম্পরাক্রমে তাহার যশ ক্রমেই ক্ষীণ হইতে থাকিবে; পর পর বংশ, যাহারা নিজেই যশের প্রার্থী, তাহার পূৰ্ব্ববংশীয় লোকের যশকে লাঘব করিবে, এইরূপে সেই যশ একেবারেই বিলুপ্ত হইবে। আচ্ছা, মানিলাম তোমার স্মৃতি অমর, তোমার ভক্ত লোকেরা অমর কিন্তু তাহাদের প্রশংসায় তোমার কি লাভ? তোমার মৃত্যুর উত্তর-কালের কথা বলিতেছি না, মনে কর—তুমি বাঁচিয়া থাকিতে থাকিতেই যদি খুব প্রশংসা পাও, সে প্রশংসায় যদি সাধারণের কোন হিত না হয়, তাহা হইলে সে প্রশংসার মূল্য কি?”
৭। “যাহা কিছু ভাল, তাহা স্বতই ভাল; সে ভাল গুণ সে নিজের স্বরূপ হইতেই পাইয়াছে; লোকের প্রশংসা তাহার কোন অংশ নহে। অতএব শুধু প্রশংসিত হইয়াছে বলিয়া কোন জিনিস ভালও নহে, মন্দও নহে। ন্যায়, সত্য, সুশীলতা, সংযম—এই সমস্ত জিনিস কোন প্রশংসার অপেক্ষা রাখে না। মানুষ যদি মাণিকের গুণ কীর্ত্তন না করিয়া নীরব থাকে, তাহাতে মাণিকের উজ্জ্বলতার কি কিছু মাত্র লাঘব হয়?”
৮। “জীবন ক্ষণস্থায়ী; অতএব ন্যায়পরায়ণ হও, দূরদর্শী হও, জীবনের সদ্ব্যবহার কর, আত্মবিনোদনের সময় সতর্ক থাকিও ৷”
৯। “এক জায়গা হইতে আলোচনা আরম্ভ কর: Vespatianএর আমলে জগৎ কিরূপ চলিতেছিল একবার ভাবিয়া দেখ;—দেখিবে এখনও যেমন তখনও তেমনি। কেহ বিবাহ করিতেছে, কেহ বা শিক্ষায় ব্যাপৃত, কেহ বা রোগগ্ৰস্ত, কাহারও বা মৃত্যু আসন্ন, কেহ বা যুদ্ধ করিতেছে, কেহ বা ভোজন করিতেছে; কেহ বা হলকর্ষণ করিতেছে, কেহ বা কেনা-বেচা করিতেছে; কেহ বিনয়ী, কেহ বা গৰ্ব্বিত; কেহ বা ঈর্ষ্যাপরায়ণ, কেহ বা শঠ; কেহ বা বন্ধুগণের মৃত্যু কামুনা করিতেছে, কেহ বা রাজকাৰ্য্যে অসন্তুষ্ট হইয়া বিদ্রোহীসভার সভ্য হইতেছে; কেহ প্রেমিক, কেহ বা কৃপণ, কেহ বা প্রদেশের, কেহ বা রাজ্যের শাসনদণ্ড ধারণ করিতেছে। কিন্তু সে সময়কার সমস্ত ব্যাপার বহুকাল শেষ হইয়া গিয়াছে। তাহার পর, Trojan-এর আমলে আইস। এস্থলেও তাই, তাহারাও সব চলিয়া গিয়াছে। এইরূপ আলোচনা করিয়া দেখ, অন্য কালে এবং অন্য দেশে তোমার চিন্তাকে লইয়া যাও,—সেখানেও দেখিবে কত লোক কত বিচিত্র কার্য্যে ব্যাপৃত হইয়া অবশেষে পঞ্চভূতে বিলীন হইয়া গিয়াছে। বিশেষতঃ তোমার পরিচিত লোকদিগকে স্মরণ করিয়া দেখ, কত বৃথা কার্য্যে, তাহারা ধাবমান হইয়াছে; আত্মার মর্য্যাদা তাহারা উপেক্ষা করিয়াছে, স্বকীয় অন্তঃপ্রকৃতিকে তাহারা অবহেলা করিয়াছে, তাহাকে লইয়া তাহারা সন্তুষ্ট হয় নাই—তাহাতেই তাহারা দৃঢ়রূপে আসক্ত হয় নাই।“
এই একই চক্র এখনো চলছে।
১০। “উপকার করিয়া কেহ কেহ প্রতিদানস্বরূপ তোমার নিকট হইতে কৃতজ্ঞতা চাহিয়া থাকে; কেহ কেহ ইহা অপেক্ষা বিনীত; তাহারা তোমার যে উপকার করে, তাহা মনে করিয়া রাখে, এবং তুমি যে তাহার নিকট ঋণী কতকটা সেই ভাবে তোমাকে দেখে। আর এক প্রকৃতির লোক আছে, তাহারা উপকার করে অথচ জানে না তাহারা উপকার করিতেছে। উহারা কতকটা দ্রাক্ষালতার মত; দ্রাক্ষালতা ফল ধারণ করিয়াই সন্তুষ্ট; গুচ্ছ গুচ্ছ আঙ্গুর ধারণ করে অথচ তাহার জন্য ধন্যবাদ প্রত্যাশা করে না। একটা শীকারী কুকুর যখন ভাল করিয়া তাহার কাজ করে কিংবা যখন কোন মৌমাছি একটু মধু সঞ্চয় করে তখন তাহারা কোন সোর-সরাবৎ করে না। যাহার উপকার করিয়া সে কথা কিছু মনে করে না, তাহাদিগেরই আচরণ আমাদের অনুকরণ করা কর্ত্তব্য।“
১১। “মনে রাখিবে, বিশ্বব্ৰহ্মাণ্ডের তুলনায় তুমি একটি পরমাণু অপেক্ষাও ক্ষুদ্র; তোমার ভাগ্যে যে কালাংশ পড়িয়াছে তাহারও কি অপরিমেয় স্বল্পতা, এবং অদৃষ্টরাজ্যের মধ্যেও তুমি কি নগণ্য!”
১২। “শুধু তোমার কর্ত্তব্য করিয়া যাও, আর কিছুর জন্য উদ্বিগ্ন হইও না। শীত হউক, গ্রীষ্ম হউক, লোকে তোমায় ভাল বলুক, মন্দ বলুক, কিছুরই জন্য চিন্তা করিও না; এমন কি মৃত্যুকেও ভয় করিও না। জানিবে, জীবনকে ত্যাগ করাও জীবনের একটা কাজ; বর্ত্তমান কালের সদ্ব্যবহার করিতে পারিলেই যথেষ্ট।“