মিখায়েল হানেকের সাক্ষাৎকার – প্রথম অংশ

মিখায়েল হানেকের মা অস্ট্রিয়ান বাবা জার্মান। তিনি জন্মেছিলেন ১৯৪২ সালে। এই খ্যাতিমান নির্মাতা, লেখক এবং মোটকথা আর্টিস্টের স্বাক্ষাতকারটি নিয়েছেন লুইসা জিলিন্সকি। স্বাক্ষাতকারটি অস্ট্রিয়ান থেকে জার্মান এবং জার্মান থেকে ইংরেজিতে রুপান্তরিত হয়ে প্রকাশিত হয় প্যারিস রিভিউতে (আর্ট অফ স্ক্রিনরাইটিং-৫)। সেখান থেকে এর এক অংশের অনুবাদ বাংলায় রূপান্তরিত করে এখানে প্রকাশ করলাম। বাকী অংশ আরো দুই পর্বে দেবার ইচ্ছা আছে।

মিখায়েল হানেকের চিন্তাভাবনা পরিচালক, স্ক্রিন রাইটার, লেখক বা অন্য যে কোন ধরনের শিল্পীদের কাজে আসতে পারে। এখানে তিনি কথা বলেছেন তার লেখালেখি,  তার ফিল্মের বিষয়বস্তু ইত্যাদি বিবিধ বিষয় নিয়ে।

Haneke-CodeInconnu_BW

 

আপনি তখন যুবক ছিলেন, বলা যাক যখন টিনেজার ছিলেন তখন কখনো কী ভেবেছিলেন চলচ্চিত্র নির্মানের কথা?

অন্য সবার মতোই বয়ঃসন্ধির কালে আমি কবিতা লিখতে শুরু করি। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে আমি অভিনেতা হওয়ার জন্য লেখাপড়া ছেড়ে দিতে চেয়েছিলাম। আমার পরিবার হচ্ছে অভিনেতা-অভিনেত্রীদের পরিবার। মা একজন অভিনেত্রী ছিলেন। বাবা অভিনেতা এবং পরিচালক। একদিন তো স্কুল ফাঁকি দিয়ে ভিয়েনার উইনার নুস্টাডে ম্যাক্স রেইনহার্ড সেমিনারে অডিশন দেবার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম। ওখানকার সবাই আমার মাকে চিনতেন। আর আমি তো নিজেকে মনে করতাম দারুণ প্রতিভাবান। তাই কখনোই মনে হয় নি ওরা আমাকে নিবে না। কিন্তু সেটাই হল। রেগে লাল হয়ে গিয়েছিলাম। যাইহোক, শেষপর্যন্ত আমাকে হাই স্কুল ডিপ্লোমা নিতে হল। তারপর, যখন ছাত্র ছিলাম, তখন লেখালেখির ব্যাপারে মনোযোগী হয়ে উঠলাম। একটি রেডিওতে কাজ করেছিলাম তখন এবং বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় সমালোচক হিসেবে লিখতাম। সাহিত্য, চলচ্চিত্র এসব নিয়ে পর্যালোচনা টাইপ লেখা যদিও বিষয়গুলো সম্পর্কে আমি খুব একটা জানতাম না।

একই সময়ে আমি ছোটগল্প লেখা শুরু করি। যখন আমার ছেলে জন্ম নিল তখন আমার বাবা মা সিদ্ধান্ত নিলেন আমাকে বের করে দিবেন। আমি টাকা উপার্জনে বাধ্য হলাম। প্রকাশনা জগতে একটা কাজ খুঁজে নেবার চেষ্টা করতে লাগলাম। এবং শেষ পর্যন্ত আমার লেখা কিছু গল্প পাঠিয়ে দিলাম নামকরা কিছু প্রকাশনীতে। তারা প্রায় সাথে সাথেই আরো লেখা পাঠাতে বলল। কিন্তু আমার আসলে দরকার ছিল একটা সম্পাদকের চাকরী! কিন্তু সেটা ছিল না। একটা সময় এজন্য বিষন্ন বোধ করতাম কিন্তু তবুও লেখা চালিয়ে যাচ্ছিলাম।

 

আপনার সাহিত্য নায়কেরা কারা ছিলেন?

আমার পুত্রের নাম ডেভিড। কেনো? কারণ তৎকালীন সময়ে আমার সাহিত্য ঈশ্বর ছিলেন ডেভিড হারবার্ট লরেন্স নামের একজন লেখক। এটা অবশ্য জার্মান বলা একটা দেশের জন্য অনেক অস্বাভাবিক একটা ব্যাপার। আমি মনে করতাম লরেন্স এক দারুণ প্রতিভা। তিনি যা লিখেছেন তার সবই গ্রোগ্রাসে গিলেছি। আমার ছেলে যখন জন্ম নিল তার প্রায় কাছাকাছি সময়ে প্রথম উপন্যাসের কাজ শুরু করি। সম্প্রতি গ্রামের বাড়ির চিলেকোঠায় এক পুরনো স্যুটকেসের মধ্যে সেই পান্ডুলিপি খুঁজে পাই। কয়েক সপ্তাহ আগে পুনরায় পড়ার আগে আমি মনে করতে পারছিলাম না উপন্যাসটা আসলে কি নিয়ে। অবশ্যই আমার মনে ছিল আমি একটা উপন্যাস লিখেছিলাম, এজন্য না ভিয়েনার একটি ছোট থিয়েটারে এটা থেকে পড়ার সুযোগ হয়েছিল। ঐ ঘটনা আমার জন্য দারুন গুরুত্বপূর্ন ছিল। এমনকী আমার বাবা মা উপস্থিত ছিলেন ওখানে। কয়েক সপ্তাহ আগে যখন আবার পান্ডুলিপি পড়লাম তখন অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। এটা আসলে একেবারে বাজে নয়! এটি লরেন্স পড়ার অভিজ্ঞতা থেকে উদ্ভুত একটি উপন্যাস। অবিশ্বাস্যভাবে সংবেদনশীল- যৌনভাবাপন্নও। এখন এটা পড়ে বিশ্বাসই করতে পারি না এটা আমি লিখেছিলাম।

আপনার প্রথম ফিচার ফিল্মের কিছু পূর্বে আপনার বয়স ছিল ৪৬। কীভাবে আপনি এই শিল্প বিষয়ে শিখতে গেলেন?

তরুণ বয়সে আমি সপ্তাহে তিনবার সিনেমা দেখতে যেতাম। বর্তমানের চেয়ে অনেক ব্যতিক্রমই বলা যায়, তখন আমি আসলেই একজন সিনেমাখোর ছিলাম। সিনেমা সম্পর্কে আমি যা জানি তার সবটুকুই শিখেছি ওই দীর্ঘদিনের সতর্ক সিনেমা দেখার মাধ্যমে। এখন আপনি সহজেই একটি ডিভিডি কিনে নিতে পারবেন এবং দৃশ্যগুলো একের পর এক (শট বাই শট) পর্যবেক্ষণ করতে পারবেন। আমি যখন তরুণ ছিলাম, তখন এটি সম্ভব ছিল না। কোন দৃশ্য যদি তখন একবার বুঝা না যেত বা কোন দৃশ্যক্রম বুঝতে অসুবিধা হত তাহলে দশবার হলে একই সিনেমা দেখতে যেতে হত। এখন আপনি বাড়িতে বসে আরামে সব পর্যবেক্ষণ করতে পারবেন। যাইহোক, তরুণ বয়সে আমি প্রকৃতই সিনেমাখোর ছিলাম।

যখন প্রকশনা সংস্থা আমাকে নিল না তখন বাদেন-বাদেনে একটি টিভি চ্যানেলে ইন্টার্নী করেছিলাম। তারা অনেকদিন ধরে একজন নতুন নাট্য সম্পাদক খুঁজছিল এবং শেষ পর্যন্ত আমাকেই নিয়ে নিল। দৃশ্যত সেটাই ছিল আমার সামনে একমাত্র সুযোগ। আমি জার্মানীর সবচেয়ে কম বয়েসী টিভি নাট্য সম্পাদক হতে গেলাম এবং ফিল্মের প্রতি পেশাদার আগ্রহও তৈরী হতে লাগল। তিন বছরের মধ্যে ক্রিপ্ট রাইটিং এর ব্যাপারে যা যা জানা দরকার তার সবই শিখে নিলাম। যা আমাকে শিখতে সাহায্য করেছিল সবচেয়ে বেশি তা হল জঘন্য সব স্ক্রিপ্ট। সেই তিন বছরের দু’ বছর টিভি চ্যানেলে পাঠানো নাটকের পান্ডুলিপিগুলোর স্তূপ আমার জন্য প্রতিদিন অপেক্ষা করে থাকত। খারাপগুলো থেকেই শেখা যেত বেশী। প্রথমেই আপনি দেখতে পাবেন কিছু একটা ঠিকভাবে কাজ করছে না, তখন আপনি নিজেকে জিজ্ঞেস করবেন কেন সেটা কাজ করছে না। জঘন্য স্ক্রিপ্টগুলো দারুণ সব কৌশল শিখিয়ে দেয়। ভালোগুলো আপনাকে নিয়ে যাবে একটা সমীহজাগানীয়া অবস্থায়, আপনি এতোই মুগ্ধ হবেন যে সেটা কেন ভালো তা লক্ষ করতে ভুলে যাবেন। কেউ যদি এখন আমাকে বলেন আমার স্ক্রিপ্টগুলো খুব পেশাদার, তাহলে আমি বলব তা হচ্ছে ওই বছরগুলোতে আমার কাজের ফল। এটা আমাকে অনেক সাহায্য করেছে যদিও কোন তৃপ্তি দেয় নি। আসলে ঐ ধরনের আবর্জনার স্তুপ নিয়ে সারাদিন বসে থাকা ভয়ানক বিরক্তিকর।

আমার বাদেন-বাদেনের দিনগুলোতে আমি যে আরেকটা জিনিস শিখেছিলাম সেটা হলো পরিচালনা। আমার প্রথম কাজ ছিল একটা স্থানীয় থিয়েটারে। সেখানে কর্মরত একজন অভিনেত্রীর সাথে আমার সম্পর্ক ছিল। আপনাকে এটা মনে রাখতে হবে বাদেন-বাদেন একেবারে পিছিয়ে পড়া ছিল। অভিনেতারা ছিল সর্বোচ্চ মাঝারি মানের, তাই আমার প্রচুর সময় লেগেছিল তাদের তৈরী করে নিতে। পরিচালনা এবং মানুষের সাথে কাজ করা একটা অভিজ্ঞতার ব্যাপার। সেটা আমি বেশ ভালোভাবেই শিখেছিলাম সেই পিছিয়ে পড়ে থাকা শহর থেকে। আমেরিকায় লেখালেখি এবং পরিচালনা শেখানোর প্রতিষ্ঠান পর্যন্ত আছে। এবং সে বিষয়ে হাজার হাজার বই তো আছেই। কিন্তু এতে আসলে কাজ হয় না। আপনি লেখা শিখবেন লিখতে লিখতে, পরিচালনা শিখবেন পরিচালনা করতে করতে। ধূর্ত বইগুলো আপনাকে কীভাবে লিখতে হয় বা কীভাবে পরিচালনা করতে হয় তা শেখায় না। আমাকে ভুল বুঝবেন না – ধূর্ত বইগুলো ভালো, কিন্তু সব শিল্পের জন্যই অনুশীলন দরকার।

 

আপনি লেখালেখি নিয়ে অনেক কথা বলেছেন। আমার মনে হয় ফিল্মমেকার হওয়া স্বত্ত্বেও আপনি এখনো লিখিত শব্দের প্রতি বেশী আসক্ত।

হ্যা, আমি সাধারণত নিজেকে একজন লেখক মনে করি। ফ্রেঞ্চ ভাষায় সুন্দর শব্দ আছে অঁতেয়া। অর্থ হল ফিল্মমেকার যিনি তার ফিল্মের বিষয়বস্তুর সাথে জড়িত। আমি কখনো অন্য লোকের কাজ পরিচালনায় আগ্রহ বোধ করিনি।

 

জেলিনেকের উপন্যাস দ্য পিয়ানো টিচার আপনি ২০০১ সালে সিনেমা বানিয়েছেন। এটাকে তাহলে কী বলবেন?

তবুও ওটার স্ক্রিপ্ট আমি লিখেছিলাম। এটা আমার নীতি আমি কখনো অন্যের স্ক্রিপ্ট পরিচালনা করি না। যখন টিভিতে ছিলাম তখনো করি নি। কিছু ক্ষেত্রে স্ক্রিপ্ট লেখকেরা আমাকে উপকরণ দিয়েছেন, কিন্তু সেটাকে বদলে দিয়ে আমি প্রায় পুরোটাই অন্য জিনিসে পরিণত করেছি। স্বাভাবিকভাবেই লেখকেরা এতে খুশি হন নি। কিন্তু পরিচালক হিসেবে আমার সেই এখতিয়ার আছে। এছাড়া আমি এটাও লক্ষ করেছি কয়েকজন মিলে কাজ করার ব্যাপারটাও আমার জন্য নয়। অনেক মানুষ আছে যারা স্ক্রিপ্টে একসাথে কাজ করতে পারে- উদাহরন হিসেবে বলা যায় কোয়েন ব্রাদারস। কিন্তু আমার কাছে কীভাবে তারা করেন তা আপাদমস্তক এক রহস্য।

 

সাহিত্যকর্মের ফিল্মে রূপান্তর বা ফিল্মায়ন সম্পর্কে আরো কিছু বলুন। আপনি শুধু দ্য পিয়ানো টিচারই করেন নি, টিভির জন্য কাফকার দ্য ক্যাসলও রূপান্তর করেছেন। দ্বিতীয়্টার ব্যাপারে যে জিনিসটা আমার মনযোগ আকর্ষন করেছে তা হল এটি মূল উপন্যাসের প্রতি দারুণভাবে বিশ্বস্ত।

একমাত্র দ্য পিয়ানো টিচারের ক্ষেত্রে আমি উপন্যাসকে সিনেমায় রূপান্তরিত করেছি। এবং সেটাও ছিল কাকতালীয়ভাবে। স্ক্রিপ্ট আমি নিজের জন্য লিখি নি, লিখেছিলাম আমার এক বন্ধুর জন্য। স্বত্ত্ব ছিল তারই। আমার বন্ধু ফিল্মের বাজেট সংগ্রহের জন্য দশ বছর চেষ্টা করেছে কিন্তু পারে নি। শেষপর্যন্ত আমি ফিল্মটি পরিচালনা করতে রাজী হই, যদিও সেটা কখনোই আমার মূল ইচ্ছা ছিল না। আমি এক শর্তে রাজী হই যে ইসাবেল হুপার্ট প্রধান চরিত্রে অভিনয় করবেন। এবং তিনি সেটা করেছেন।

যে কোন ক্ষেত্রে সাহিত্যকর্মের সিনেমার জন্য ফিল্মায়ন এবং টিভির জন্য ফিল্মায়নের মধ্যে বড় পার্থক্য রয়েছে। গোড়াতে দুইটা প্রক্রিয়াই একই রকম। আপনাকে বইটা পড়তে হবে, বিশ্লেষণ করতে হবে। পরবর্তীতে ফিল্মায়নের জন্য আপনার ইচ্ছানুযায়ী পুনর্বিণ্যস্ত করতে আলাদা প্লট লাইনগুলো ভালো করে বুঝতে হবে। গঠনগত দিক থেকে আমার ফিল্ম দ্য পিয়ানো টিচার মূল উপন্যাসের চাইতে অনেক আলাদা। কারণ এটা আমি সিনেমার জন্য রুপান্তর করেছি। কিন্তু যখন আমি সাহিত্যকর্ম টিভির জন্য রূপান্তর করেছি তখন মূলকে মারাত্মকভাবে অনুসরন করেছিলাম। দ্য ক্যাসলে এমন কোন লাইন হয়ত পাওয়া যাবে না যা মূল উপন্যাস থেকে আক্ষরিকভাবে উঠে আসে নি। এক্ষেত্রে জার্মানীর রাষ্ট্রীয় অর্থাধীন টিভির ‘শিক্ষামূলক অধ্যাদেশ’ মূল ধন্যবাদের যোগ্য। টিভি পরিচালকের কাজের মধ্যে থাকে দর্শকদের উপন্যাসটি পড়তে আগ্রহী করে তোলা। সিনেমার ক্ষেত্রে এটি ভিন্ন। সিনেমার ক্ষেত্রে বইটি হয়ে যায় পরিচালকের বুদ্ধিভিত্তিক খেলার ক্ষেত্র, যেখানে উপন্যাস এবং তার লেখক অনেকটাই পিছনে চলে যান।

 

লেখা আপনার কাছে প্রক্রিয়ার শেষটা হলে শুরুটা কী? আইডিয়া আসে কোথা থেকে?

এটা বলা কঠিন। আমার প্রতিটি ফিল্মের অনুপ্রেরণা ভিন্ন ভিন্ন ছিল- আমার আইডিয়া সৃষ্টির নির্দিষ্ট কোন উৎস নেই। যেমন হোয়াইট রিবন যে আইডিয়া থেকে অঙ্কুরিত হয়েছে তা আমার কাছে এসেছিল পঁচিশ বছরেরও আগে। উত্তর জার্মান সমতলে বসবাসকারী সোনালী চুলের শিশুদের নিয়ে একটি ফিল্ম বানাতে চেয়েছিলাম। সেটাই। আমার মাথায় একটা মাত্র দারুণ দৃশ্য বা ছবি ছিল।

 

এবং আপনি এই দীর্ঘদিন মাথায় আইডিয়াটা রেখে দিলেন? কীভাবে এই পঁচিশ বছরের দীর্ঘ সময় ধরে এই আইডিয়া পরিচর্যা করে গেলেন?

যেসব আইডিয়া আমি লিখে রেখেছিলাম সেগুলো বার বার দেখা এবং তা নিয়ে চিন্তা করা জারি রেখেছিলাম সবসময়। কিন্তু শুরুতে তা ছিল মাত্র একটা ছবি মাত্র। অনেক পরে আমি জায়গা, রাজনৈতিক চিন্তা এগুলো ঠিক করি, কারন প্রাথমিকভাবে এসব চিন্তা আমার ছিল না। নবম শতাব্দির জার্মানীর জীবন নিয়ে অগনন বই পড়া শুরু করি। ঐসব নন-ফিকশন বইয়ে জার্মান গ্রামের জীবন এবং বাবা-মা’র সন্তান প্রতিপালন নিয়ে যেসব বর্ননা ছিল সেগুলো থেকে ফিল্মের অনেক অসাধারণ সব আইডিয়া পেয়েছি। শিশুদের হোয়াইট রিবন পড়ানোর আইডিয়াও আমার ছিল না। এটা আমি আঠার শতকের একটি সন্তান প্রতিপালন নির্দেশিকা থেকে নিয়েছিলাম। আমার মনে হয়েছিল এই আইডিয়াটা অসাধারণ এবং আমার এটি ব্যবহার করতে হবে। তাই আমি এর সম্পর্কে পর্যাপ্ত তথ্য সংগ্রহ শুরু করে দেই। আমার অন্য ফিল্মদের ক্ষেত্রেও একই কথা, যখন মনে করি যথেষ্ট তথ্য সংগ্রহ সম্পন্ন হয়েছে তখনই আইডিয়াগুলো ক্রমানুসারে সাজাতে বসি। এটি গতানুগতিক প্রক্রিয়া কিন্তু আমি সব সময় বলি, আপনি যে গল্প বলতে চান সে সম্পর্কে আপনাকে জানতে হবে এবং জানতে হবে কীভাবে ফিল্মের ঐ নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে আপনি গল্পটি উপস্থাপন করবেন। একমাত্র এই পদ্বতিতেই আপনি একটি আপাদমস্তক মনোমুগ্ধকর ফিল্ম বানাতে পারবেন।

 

ক্যাশ এর ক্ষেত্রে কী বলবেন? হোয়াইট রিবনের মত এই ফিল্মও রাজনৈতিকভাবে দেখা হয় – ভুল না শুদ্ধ সে আলোচনায় যাচ্ছি না। আপনি কী ফ্রেঞ্চ-আলজেরিয়ান দ্বন্ধ দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন না অনুপ্রেরনা এসেছিল অন্য কোনখান থেকে?

এটা বলা কঠিন কী আমাকে অনুপ্রাণিত করেছিল। সত্যি বলতে কী, আমার প্রতিটি ফিল্মই মানুষের অপরাধবোধ এবং সে কীভাবে তার অপরাধবোধের সাথে সমঝোতা করে নেয় এই থিমের সাথে যুক্ত। আমি একটি ফিল্ম বানাতে চেয়েছিলাম যেখানে একজন লোক তার ছোটবেলা থেকে বয়ে নিয়ে আসা এক অপরাধবোধের মুখোমুখি হয়। ফিল্মটিতে প্রধান চরিত্র তার ছেলেবেলার বন্ধুর সাথে এক রকম বিশ্বাসঘাতকতা করে এবং এটি তার বন্ধুর জীবনে মারাত্মক পরিণতি নিয়ে আসে। কিন্তু এটি ফিল্মের আসল সমস্যা নয়।

এটা যেমন শিশুরা হয় আর কী – স্বার্থপর, নিজের কাজ সম্পর্কে তাদের তেমন ভাবনা চিন্তা থাকে না। সেটা নিয়েও কোন সমস্যা নয়। এটা স্বাভাবিক শিশুরা আত্মকেন্দ্রিক হয় এবং হাসিমুখে অন্যকে নেকড়ের মুখের সামনে ঠেলে দিতে পারে। কিন্তু আমার কাছে আগ্রহ উদ্দীপক প্রশ্ন ছিল, একজন কীভাবে সে অপরাধবোধের সাথে সমঝোতা করবে যখন বড় বয়েসে তা ফিরে আসবে তার কাছে।

যখন আমি গল্পটি নিয়ে কাজ করছিলাম তখন ১৯৬১ সালের প্যারিস গণহত্যা নিয়ে একটি প্রামাণ্যচিত্র দেখি। এটা আমার উপর দারুণ ছাঁপ রেখে যায়। যখন আমি চরিত্রটি লিখছিলাম, দানিয়েল অঁউতিউইলের বয়স দারুণভাবে সেইসময়ের সাথে মিলানো সম্ভব হয়। দুইটি লোকের ঘটনার বাইরেও ফিল্মটি যে রাজনৈতিক একটি প্রাসঙ্গিকতা পায় তা এক প্রকার সৌভাগ্যের কারণেই বলা যায়। এবং এটাও সত্যি যেকোন দেশ বা সংস্কৃতিতে এরকম অন্ধকার জায়গা আপনি পাবেন। আমাকে আমেরিকায় একই ফিল্ম পুনরায় নির্মানের অফার দেয়া হয়েছিল, কিন্তু আমি তা নেই নি। আমি নিশ্চিত সেখানেও এমন কিছু পাওয়া যাবে যা দিয়ে এই গল্প পুননির্মান করা সম্ভব। কিন্তু সেটা আমার উদ্দেশ্য ছিল না।

আমি ভুল বুঝে না থাকলে, আপনি বলতে চাচ্ছেন আপনার মূল চিন্তার বিষয় হচ্ছে চরিত্রের নিজস্ব মনস্তত্ত্ব?

একেবারে ঠিক, এবং সেটাই একমাত্র জিনিস যা সম্পর্কে আমি জানি। আমি কখনোই একটি রাজনৈতিক ফিল্ম বানাতে বসব না। আমি আশা করি আমার ফিল্ম একটা প্রতিবিম্ব দেখায় এবং কিছু আলো ফেলার ক্ষমতাসম্পন্ন, এবং তাতে অবশ্যই রাজনৈতিক প্রভাব থাকতে পারে।

কিন্তু যেসব ফিল্মের রাজনৈতিক এজেন্ডা আছে তাদের প্রতি আমার অবজ্ঞা আছে। তাদের উদ্দেশ্য থাকে ম্যানিপুলেট করা, দর্শকদের বুঝানো তাদের মতাদর্শই ঠিক। মতাদর্শগুলা শৈল্পিকভাবে নীরস। আমি সব সময় বলি কোন কিছু যদি একটি পরিষ্কার ধারনায় প্রকাশ করা যায় তাহলে সেটি শৈল্পিকভাবে মৃত। যদি কোন একটি ধারনা কোন কিছু ধরে রাখে, তাহলে তো সব সমাধানই হয়ে গেল, অন্তত তাই মনে হয়। হয়ত এই কারণেই আমি সিনোপসিস লেখি না। আমি এটা পারি না। আমি যদি তিন বাক্যে ফিল্মের সারমর্ম লিখে ফেলতে পারতাম তাহলে আমার ফিল্ম বানানোর দরকার পড়ত না। তাহলে আমি একজন সাংবাদিক হতাম। তিন বাক্যের সারমর্ম লিখে দিতাম এবং পাঠকেরা বুঝে নিত এতে কি আছে। কিন্তু তাতে আমি কোন আগ্রহ পাই না।

দেখুন, জীবন নিজেই একটি শিল্পের বিষয়। আপনার উপন্যাসে বা নাটকে আপনি একটি সমান্তরাল পৃথিবী তৈরী করেন। সত্যিকার মনোমুগ্ধকর সেই গল্পটি যেটি চরিত্রের মাধ্যমে তার ভাঁজ খুলে। অবশ্যই আমাদের সবারই রাজনৈতিক বিশ্বাস আছে এবং নিজেদের শৈল্পিক কাজকর্মে এগুলো যে একেবারেই প্রবেশ করবে না এমন নয়। সেলিন, একজন ডান ধারার চরমপন্থী ছিলেন। এটা তার কাজ দেখলেই বুঝা যায়। তিনি কিন্তু একেবারে বাজে লেখক ছিলেন না। ডান এবং বাম দুই পক্ষ থেকেই এমন হাজার হাজার উদাহরণ আছে। একাডেমীতে আমি আমার ছাত্রছাত্রীদের বিভিন্ন ধরনের প্রোপাগান্ডিস্টিক ফিল্ম সম্পর্কে বলি, যাতে তারা সেইসব ফিল্ম কীভাবে কাজ করে সে ব্যাপারে সংবেদনশীল হয়ে উঠে। আমার ফিল্মে রাজনীতি আসে অনেক নিবিড়ভাবে এবং কখনোই আমার ইচ্ছা থাকে না বলা, “দেখো, এই আমি বলতে চাচ্ছি, এগুলো তুমি খেয়ে ফেলো।” আমার প্রক্রিয়া মানবিক – আমার দর্শকদের সাথে এক ধরনের কথোপকথনে যাওয়া এবং তাদের চিন্তা করানো। এর চেয়ে বেশী কিছু ড্রামাটিক আর্টে অর্জন করা যায় না। এবং সত্যি বলতে কী, আমি জানি না এর চেয়ে বেশী আর কী একজন অর্জন করতে পারেন।

প্রায়ই দেখা যায় আপনি সুশীল বুর্জোয়া চরিত্রদের চিত্রায়িত করেন যাদের মধ্যে আছে শিল্পী, গায়ক, সাহিত্য সমালোচক, অর্থাৎ সেইসব লোক যারা নিজেদের সংবেদনশীল বলে দাবী করে। আপনি তাদের এমনভাবে এইসব সংবেদনশীল বুদ্ধীজিবীদের দেখান যে তারা যে বাস্তবতা বিশ্বাস করে বলে দাবী করে তাতে অন্ধ হয়ে আছে। এভাবে বুর্জোয়াদের প্রশ্নের মুখে ফেলার ক্ষেত্রে কী সমাজবিদ্যাগত কোন কারণ আছে?

এটা সত্যি, যেহেতু আমি একজন বুর্জোয়ার সন্তান। আমি শুধুমাত্র সেইসব জিনিস নিয়েই লেখি যেগুলোর সাথে আমার ভালো জানাশোনা আছে। আমি কখনোই একজন ডক শ্রমিক নিয়ে ফিল্ম বানাব না কারণ তার মনস্তত্ত্ব সম্পর্কে আমার কোন ধারণা নেই। আমার চিন্তা মানুষের কমন সমস্যাগুলো নিয়ে, যেমন অপরাধবোধ বা অদূরদর্শীতা- যেগুলো আমাদের প্রতিদিনের জীবনের সাথে জড়িত। অবশ্যই আমি সব সময়ই একটি অনুসঙ্গ তৈরী করি যা কৌতুহল বাড়িয়ে দেয়। সেটা করার যদি কোন সুযোগ থাকে, যেমন ক্যাশ বা দ্য হোয়াইট রিবনে ছিল, তাহলে কৃতজ্ঞচিত্তে তা করব। কিন্তু আমার প্রথম চিন্তা সর্বদাই মানুষ কীভাবে একে অন্যের সাথে সম্পর্কিত। এবং সেটাই আমার মূল শৈল্পিক আগ্রহ।

কিন্তু আপনি কী বলবেন নিজের অভিজ্ঞতা থেকে চিত্রায়িত করা এবং একই ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে আসা সব সময় ভালো বা প্রয়োজনীয়?

মানুষ যেসব জিনিস সরাসরি জানে না সেসব নিয়ে বলতে গিয়ে কেউ কখনো ভালো কিছু করতে পেরেছে বলে দেখিনি। তারা আফগানিস্থান নিয়ে, আফ্রিকার শিশুদের নিয়ে কথা বলবে, কিন্তু শেষপর্যন্ত তারা কিন্তু সেসব জিনিসই জানে যা তারা টিভিতে দেখেছে বা পত্রিকায় পড়েছে। এবং তারা এমন ভাব করে, এমনকী নিজের কাছেও, যেন যে বিষয়ে তারা বলছে সেসব সম্পর্কে তারা জানে। কিন্তু এসব বাজে কথা। আমি নিশ্চিত যে আমার চারপাশে যা ঘটছে, যা প্রতিদিন আমি দেখতে পাই, বুঝতে পারি এবং যা আমি আমার জীবনে অতিক্রম করেছি সেগুলো ছাড়া আর কিছু আমি জানি না। এগুলোর উপরেই আমি নির্ভর করতে পারি। এছাড়া যা কিছু আছে সব হলো গভীরতাহীন জ্ঞাণের ভান। অবশ্যই, যেভাবে আমার ক্ষেত্রে ঘটেছে হুবহু সেভাবে আমি লিখি না- কিছু ঘটেছে, কিছু ঘটেনি। নিদেনপক্ষে আমি আমি এমন গল্প তৈরী করতে চেষ্টা করি যেগুলো আমি নিজে চিনতে পারি।

আমার ছাত্রছাত্রীরা গুরুগম্ভীর সব বিষয়ে যেতে চায়। তাদের জন্য সব সময় এটা হতে হবে হলোকাস্ট। আমি সাধারণত তাদের বলি, পিছে হটো। তোমাদের কোন ধারণা নেই কি নিয়ে কথা বলছো। তোমরা সেসব জিনিসই পুনরোৎপাদন করবে যা কোথাও পড়েছ কিংবা শুনেছ। যেসব মানুষেরা ঐ সময়ে বসবাস করেছে তারা যত ভালোভাবে বলেছে সেভাবে তোমরা কখনো পারবে না। এমন কিছু তৈরী করার চেষ্টা করো যা তোমাদের নিজস্ব অভিজ্ঞতা থেকে উদ্ভুত। তাহলেই কেবল তা সত্যিকারভাবে আগ্রহউদ্দীপক হওয়ার ক্ষুদ্র সম্ভাবনা তৈরী হয়। এইকারণেই আসলে বর্তমান সময়ে আমাদের ফিল্মগুলোর চাইতে উন্নয়নশীল দেশগুলো থেকে আসা ফিল্মগুলো অনেক বেশী আগ্রহউদ্দীপক। ওই ফিল্মগুলো সত্যিকার কিছু অভিজ্ঞতার চিত্রায়ন করে, তাতে দারুন খাঁটি আবেগ থাকে এবং আমরা, দর্শকেরা এগুলো দ্বিতীয় হাত বা তৃতীয় হাত হয়ে পাই। এবং তবুও, আমরা অনুভব করতে পারি এখানে কিছু সত্য আছে, একজন দর্শক হিসেবে আমরা কোন দৃশ্যের আনন্দ বা হতাশা অনুভব করতে পারি।

নিজেদের ক্ষুদ্র নিরাপদ পৃথিবীতে আমরা এখানে অনেক বেশী অসাড় হয়ে পড়েছি কারণ সৌভাগ্যক্রমে প্রতিদিন আমাদের বিপদের মুখে পড়তে হয় না। কিন্তু এই কারণেই তথাকথিত প্রথম বিশ্বের চলচ্চিত্র শিল্প হচ্ছে চর্বিত চর্বন। আমাদের সত্যিকার অভিজ্ঞতাগুলো চিত্রায়িত করার সুযোগ নেই কারণ আমাদের অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ অল্প। এবং মোটকথা আমরা এখানে বস্তুগত বিষয়াবলী এবং যৌন চাহিদা নিয়ে বেশী চিন্তিত। আসলে আমাদের জীবনে এর চেয়ে বেশী কিছু নেই।