মাইন্ডওয়াক(১৯৯১) কথোপকথন নির্ভর ফিল্ম। তিনজন ভিন্ন চিন্তার লোকের পৃথিবীর সমস্যা দেখার ভঙ্গি, তার সমাধানের ভিন্ন চিন্তা এই ফিল্মের বিষয়বস্তু। অন্যতম একটি দার্শনিক ফিল্ম হিসেবে এর খ্যাতি আছে। তবে কথোপকথন ছাড়া এই ফিল্মে আর কিছুই নেই ফলে বেশিরভাগ দর্শকের জন্য এতে উপভোগের কিছু আছে বলে মনে হয় না।
একজন আমেরিকান পলিটিশিয়ান জ্যাক এডওয়ার্ড, যিনি আমেরিকার প্রেসিডেন্ট পদপার্থী ছিলেন, প্রাইমারীতে হেরে হতাশা কাটানোর জন্য তার কবি বন্ধু থমাস হ্যারিম্যানের কাছে যান ফ্রান্সে। থমাস হ্যারিম্যান একজন কবি এবং দীর্ঘদিন ধরে ফ্রান্সে বসবাস করছেন। নিউ ইয়র্ক থেকে একরকম স্বেচ্ছানির্বাসন নিয়ে।
সেইন্ট মিখায়েলের মাউন্টে ঘোরাঘোরির সময় তাদের সাথে সোনিয়া হফম্যানের পরিচয় হয়। ভদ্রমহিলা একজন পদার্থবিজ্ঞানী। তিনি আমেরিকায় লেজারের উপর কাজ করতেন। বড় আবিষ্কারও আছে তার। কিন্তু তিনি তার কাজ অন্যভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে দেখে সব ছেড়েছুড়ে এখানে এসে নতুন ভাবে পৃথিবী এবং তার সমস্যাবলী দেখার প্রয়াস নিয়েছেন।
সোনিয়া হফম্যান জ্ঞানী। তিনি কোয়ান্টাম পদার্থবিদ্যা থেকে দেকার্তে, জনসংখ্যা সমস্যা থেকে ফ্রান্সিস বেকন, বিজ্ঞানীদের নৈতিকতা থেকে নিউটনের সমস্যা সব নিয়েই তার দৃঢ় মতামত ব্যক্ত করেন। যার অনেকটাই সিস্টেম থেকে পালিয়ে আসা কবি থমাস হারিম্যানের কাছে ঠিক মনে হয়। কিন্তু মৃদু তর্ক জুড়ে দেন রাজনীতিবিদ জ্যাক। জ্যাক এবং সোনিয়ার তর্কের মধ্য দিয়েই আমাদের এবং এই মহাবিশ্বের অস্তিত্ব, পৃথিবীর সমস্যা, বিজ্ঞানীদের এথিক্স, হিরোসিমা-নাগাসাকির বিভীষিকা ইত্যাদি নানাবিদ বিষয় উঠে আসে।
ফিল্মের এই তিন প্রধান চরিত্রই ব্যক্তিগত জীবনে সমস্যাগ্রস্ত। মিডলাইফ ক্রাইসিসে আক্রান্ত। সোনিয়া হফম্যান এই কারণে নারীবাদি। তার মতে পৃথিবীতে দুইটা ফোর্স। এক পুরুষের ভায়োলেন্স, আর দুই নারীর মায়া মমতা ইত্যাদি। এর আবার তীব্র বিরোধী কবি হ্যারিম্যান। তিনি স্বীকারও করে নেন, তার বিবাহ ঘটিত সমস্যার কারণে এই ধরণের মত তার অসহ্য লাগে। বলা যায় তাদের নিজেদের জীবনের সমস্যা থেকেই তাদের এই দুই ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গী।
এই ফিল্মকে ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গীর ফিল্মও বলা যেতে পারে। সোনিয়া হফম্যান এবং রাজনীতিবিদ জ্যাকের দৃষ্টিভঙ্গীর পার্থক্য সব সময় স্পষ্ট হয়ে ধরা দেয়। দেকার্তে মানুষকে মেশিনের সাথে তুলনা করেছিলেন। ঘড়ির মতো। সোনিয়ার মতে দেকার্তের এই ধারণা এখন ক্ষতিকর। এখন পৃথিবীকে আমাদের দেখতে হবে সমস্ত সিস্টেম হিসেবে। সমস্যাগুলো একে অন্যের সাথে সম্পর্কিত। সিস্টেম হিসেবে দেখলে সামান্য পরিবর্তনের মাধ্যমেই আমরা সমস্যা প্রতিরোধ করতে পারব, প্রতিকারের চাইতে প্রতিরোধ উত্তম। মূলত এই ফিল্মটি সিস্টেম থিওরীর ভূমিকামূলক একটি ফিল্ম। এটি সিস্টেম থিওরীর একজন গুরুত্বপুর্ন বিজ্ঞানী ফিজিসিস্ট ফ্রিটজফ কাপ্রা’র বই দ্য টার্নিং পয়েন্টের উপর ভিত্তি করে লেখা। গল্প লিখেছেন এবং ফিল্ম পরিচালনা করেছেন ফ্রিটজফ কাপ্রার ভাই বেরন্ট কাপ্রা।
ফিল্মের নির্মান খুব ফিল্মি নয়, নাটকীয়তা নেই বললেই চলে। সাদামাটা বাতচিত। এবং কথোপকথন নির্ভর ফিল্মে যে ধরনের অভিনয় এবং দৃশ্যায়নের প্রয়োজন হয় দর্শক ধরে রাখার জন্য তারও অভাব রয়েছে। ফলে যারা কথোপকথনের বিষয়বস্তু নিয়ে আগ্রহ অনুভব করবেন কেবল তাদেরই ভালো লাগবে বলে মনে হচ্ছে।
একটা পর্যায়ে সোনিয়া হফম্যান পার্টিকল ফিজিক্সের অনু পরমানুর গঠন, তার ভিতরের শুণ্যতা, অস্তিত্বের সম্ভাব্যতা ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা করেছেন। কোয়ান্টাম ফিজিক্সে আগ্রহ থাকলে এই অংশ চমৎকার লাগার কথা।
ফিল্মের শেষদিকে কবি হ্যারিম্যান পাবলো নেরুদার এনিগমাজ কবিতাটি আবৃত্তি করেন। এই কবিতার মাধ্যমে পুরো ফিল্মের সব কথোপকথনের এক সারমর্ম যেন উপস্থাপিত হয়। ঘোষিত হয়, কবিতারও শক্তি।
ফেসবুকে ফিল্মের রেটিং দেই দেখার পরে। এটাকে পাঁচে পাঁচই দিয়েছি।