ভারতের উগ্র হিন্দুরা “লাভ জিহাদ” নামে যাকে আখ্যায়িত করে, এবং যে কারণ দেখিয়ে তার বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ন হয় সেই কারণের কিছু বাস্তবতা আছে। কারণটা যেটা তারা বলে থাকে তা হলো, মুসলিম ছেলেরা হিন্দু মেয়েদের বা মুসলিম মেয়েরা হিন্দু ছেলের প্রেমের ফাঁদে ফেলে ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত করছে। এভাবে হতে থাকলে ভারতে ইসলাম ধর্মানুসারীদের সংখ্যা বেড়ে যাবে বলে তারা আশঙ্কা করে। পত্র পত্রিকা দেখে যা বুঝা যায় তাতে মনে হয় ভারতে এই ধরণের অতি উগ্র বিশ্বাসের লোকেরা সংখ্যায় মোট জনসংখ্যার তুলনায় কম।
প্রগ্রতিশীল অবস্থান থেকে এমন চিন্তা মূর্খামি ও ব্যক্তির ব্যক্তি স্বাধীনতার বিরুদ্ধে যায়, তাই অবশ্যই পরিত্যাজ্য।
কিন্তু তাদের আশঙ্কাটির বাস্তবতা ইতিহাসের বিচারে অল্প বিস্তর আছে দেখা যায়।
ইসলামের আইন হলো যে কোন লোক যদি মুসলমান লোককে বিয়ে করতে চায় তাহলে তাকে মুসলমান হতে হবে। এবং মুসলমান হয়ে কেউ অন্য ধর্মে যেতে পারবে না বা ধর্ম ছাড়তে পারবে না, এর শাস্তি মৃত্যুদন্ড। এবং কোন সন্তানের মা বাবার যেকোন একজন মুসলমান হলে সন্তানটি মুসলমান বলে গণ্য হবে।
নিয়ার ইস্টে এইসব নিয়মই ইসলামকে বিস্তৃত হতে সাহায্য করেছে। শাসকেরা জোর করে ঐ অঞ্চলের খ্রিস্টানদের মুসলিম বানায় নি। খুব অল্প হারের ইন্টার-ফেইথ বিয়েই দীর্ঘ সময়ে প্রচুর মুসলিম কনভার্ট তৈরী করতে সক্ষম।
জুদাইজম এইভাবে বিস্তৃত হয় নি, কারণ জুদাইজমের ক্ষেত্রে মা এর ইহুদি হওয়া প্রয়োজন হয় সন্তানের ইহুদি হবার জন্য। নস্টিক (ধ্রুজ, এজিদি, ম্যানদিয়ানস) ধর্মগুলি আরো হারিয়ে গেছে কারণ সেসব ধর্মে আইন অনুসারে মা বাবা দুজনকে ঐ ধর্মের হতে হতো সন্তানকে ঐ ধর্মের হতে হলে।
লেবানন, গ্যালিলি, নর্দার্ন সিরিয়া ইত্যাদি পর্বতাকীর্ন এলাকায় খ্রিস্টান ও সুন্নি মুসলিমরা আলাদাভাবে থাকতো তাই ইন্টারফেইথ বিয়ে হয় নি। কিন্তু সমতল মিশর এলাকায় বিভিন্ন ধর্মের লোকেরা মিশেই বসবাস করতো, এবং এখানে তাই ইসলামের প্রসার হয়েছে।
মিশরে অনেক লোক ইসলামিক শাসনের সময় সুবিধা লাভের জন্য মুসলমান হয়। (এটা ভারতীয় উপমহাদেশেও হয়েছে।) মুসলমান হতে তাদের তেমন সমস্যা ছিল না কারণ অর্থোডক্স খ্রিস্টানিটির সাথে ইসলামের মিল ছিল। কিন্তু পরে তারা আর ধর্ম ত্যাগ করতে পারে নি কারণ ইসলামের আইনে এটি ভয়াবহ অপরাধ। এভাবে কয়েক প্রজন্মের মধ্যে তারা তাদের পূর্বপুরুষের ধর্ম থেকে সহজেই দূরে সরে যায়।
এখানে ইসলাম যা করেছে, তা হলো খ্রিস্টানিটির চাইতে বেশী একগুয়ে বা জেদী আচরণ। সে তার নীতি ও আইন থেকে নড়বে না, কখনোই নড়বে না।
এই জেদ তার প্রসারে সাহায্য করেছে।
খ্রিস্টান ধর্ম নিজেই এইরকম জেদী আচরণের মাধ্যমে রোমান প্যাগান ধর্মকে হারিয়েছিল। রোমান সাম্রাজ্যে, রোমানরা খ্রিস্টান ধর্মের প্রতি মোটামোটি উদার ছিল ও তারা তাদের সংস্কৃতি অনুযায়ী দেবতা ভাগাভাগি করে নিতে চাইল। কিন্তু দেখলো যে খ্রিস্টানরা তাদের যিশুকে ভাগাভাগি করতে এবং এর বিনিময়ে স্থানীয় দেবতা নিতে রাজী না। তারা তাদের অবস্থানে একগুয়ে ও জেদী। রোমান প্যাগানিজমের বিরুদ্ধে খ্রিস্টানরা ছিল ইনটলারেন্ট।
খ্রিস্টানদের উপর যে নির্যাতন হয়েছে, তার যেসব ইতিহাস আছে, তা খ্রিস্টান দিক থেকেই লিখিত। এবং মূলত এই নির্যাতন হয়েছিল তাদের রোমান দেবতা না নেয়ার জন্য, একগুয়ে আচরণের জন্য। খ্রিস্টানরা রোমানদের মতো উদার হলে যিশুকে তারা দিয়ে দিত এবং অন্য আরো দেবতা নিজেদের জন্য নিয়ে নিত। ফলে আলাদা খ্রিস্টানিটির অস্তিত্ব থাকতো না।
ভারতের ইসলামে একই জিনিস দেখতে পাওয়া যাবে। হিন্দুদের পূজায় মুসলিমরা যেতে পারে, কিন্তু মুসলিমদের উৎসবে হিন্দুদের প্রবেশাধিকার নেই। এক্ষেত্রে হিন্দু ব্রাহ্মণ্যবাদ অনেকাংশে দায়ী থাকতে পারে, কিন্তু মূল কারণটা হলো মুসলিমরা জেদী এবং তাদের নীতি থেকে তারা কখনোই সরতে চায় না। এই নীতি থেকে সরলে তার ধর্ম থেকেই সরে যাওয়া হয়ে যায়।
কোন দলের এই না সরে আসার মানসিকতা তাদের বিস্তারে সাহায্য করে।
যেমন, হালাল খাবারের ক্ষেত্রে হয়ে থাকে। যুক্তরাজ্যে ৩ থেকে ৪ শতাংশ মুসলিমের বাস, কিন্তু নিউজিল্যান্ড থেকে আমদানী হওয়া প্রায় ৭০ ভাগ মেষমাংস হালাল। প্রায় ১০ ভাগ সাবওয়ে স্টোরগুলি কেবল হালাল মাংস বিক্রি করে। দক্ষিণ আফ্রিকায় প্রায় একই সংখ্যক মুসলিমের বাস কিন্তু বিশাল অংশ মুরগীর মাংস হালাল সার্টিফায়েড। একইভাবে যুক্তরাষ্ট্রে ইহুদি তিন থেকে চার পার্সেন্ট হলেও প্রায় সব পানীয় কোশার বা ইহুদি বিধিমত হালাল সার্টিফায়েড। এখানে সূত্রটা হলোঃ
কোশার বা হালাল খাদ্যের গ্রাহক কখনো হারাম বা অ-কোশার খাবার খাবে না, কিন্তু অন্যেরা হালাল বা কোশার খাবার খাবে। সুতরাং, সব হালাল বা কোশার করলেই উৎপাদনকারীর লাভ।
একই ভাবে ভারতে বিজেপি’র জনপ্রিয়তাকে মাইনরিটি রুল দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায়। তারাও একগুয়ে ও জেদী। নিজেদের অবস্থান থেকে নড়বে না। এই অবস্থানের কারণেই তাদের জনপ্রিয়তা বেড়েছে, বাড়ছে এবং এখন তারা ভারতের ক্ষমতায়।
এই ধরণের একগুয়ে ও জেদী মাইনরিটি কখনো কখনো বাকস্বাধীনতা এবং গণতন্ত্রের জন্যই হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। তখন প্রশ্ন আসে যে, টলারেন্ট কোন মতাদর্শ কি ইন-টলারেন্স প্রমোট করা কোন দলকে টলারেট করবে, উদারতার যুক্তিতে?
২৫% মানুষ লাগে পরিবর্তনেঃ
কোন একটা সিস্টেমে বড় পরিবর্তন আনতে এর ঠিক কতো পার্সেন্ট লোকের পরিবর্তনের পক্ষে থাকতে হয় এ নিয়ে অনেক রিসার্চ হয়েছে। সম্প্রতি সবচাইতে বড় রিসার্চটি বলে এর উত্তর হলো ২৫%। অর্থাৎ, কোন সমাজে পঁচিশ পার্সেন্ট মানুষ কোন একটা নিয়মের পক্ষে দৃঢ়ভাবে সরব থাকলে পুরো সমাজটি তা মেনে নিতে বাধ্য হয়।
দুর্নীতি দূর করতে বা অন্য কোন সমাজের বাজে ধারণা বা জিনিস দূর করতে লাগে এর বিরুদ্ধে ২৫% মানুষ। এই ২৫% মানুষ দৃঢ়ভাবে এর পক্ষে থাকলে যে পুরা সমাজই বদলে যায়, এটাও মাইনরিটি রুলের কারণে হয়। ২৫% তো মাইনরিটিই।
রেফারেন্সঃ
১। নাসিম নিকোলাস তালেবের বই স্কিন ইন দ্য গেইমঃ দ্য হিডেন এসিমেট্রিজ ইন ডেইলি লাইফ । বইয়ের বুক-৩ দ্য গ্রেইটেস্ট এসিমেট্রি অংশে মাইনরিটি রুল বিষয়ক ইতিহাস, ব্যাখ্যা ইত্যাদি পাওয়া যাবে।
২। Experimental evidence for tipping points in social convention http://science.sciencemag.org/content/360/6393/1116.editor-summary