প্রশংসা ও নিন্দা বিষয়ে আমরা কী করব?

আমি আজ স্ট্যাটাস দিলাম ইয়ার এন্ড রিভিউ চাইয়া। এই বছরে যারা ফেসবুকে আমার লেখা পড়ছেন তাদের ফিডব্যাক আহবান, কী ভালো হইছে, কী ভালো হয় নাই, কোনটা চালাইয়া যাওয়া উচিত, কোনটা বন করা উচিত, ইত্যাদি বিষয়ে তাদের মতামত। এই ধরণের পোস্ট বেশিরভাগেই এড়াইয়া যাবেন স্বাভাবিক। কারণ মানুষ ফিডব্যাক দিতে চায় না। প্রশংসা করতে তার প্রাণে চায় না, আর নিন্দা মনে রেখে দেয়, করতে চায় না প্রকাশ্যে।

পাবলিক একটিভিটি আছে যাদের, তাদের নিন্দা ও প্রশংসা দুইটাই হবে। এই দুই খাম্বারে নিয়া ক্যামনে ডিল করা যায়?

প্রথমে বলে রাখি, ভালো ফিডব্যাক থেকে আসলে কী পাওয়া যায়।

ফিডব্যাক থেকে বুঝা যায় অন্য ব্যক্তি বা ব্যক্তিরা আপনারে ও আপনার কাজরে কীভাবে দেখতেছেন। তাদের দেখা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সঠিক হবে না। কারণ আপনার ও আপনার কাজ সম্পর্কে একমাত্র যে ব্যক্তি মোটামোটি রকমের সঠিক ধারণা রাখেন সেটা আপনিই। অন্য কেউ যেহেতু আপনি না অতএব তাদের পক্ষে আপনারে বুঝা সম্ভব না। তারা বিভিন্ন অনুমান করতে পারে।

ভালো ফিডব্যাক রেয়ার। অধিকাংশ লোক বিভিন্ন জাজমেন্ট দিবে ফিডব্যাকে। আপনার কী করা উচিত অনুচিত এর মধ্য দিয়াই আটকে থাকবে ও সে আপনারে দিয়া যা করাইতে চায়, সেটা বলবে। অন্যদিকে, ভালো ফিডব্যাকে থাকে, এমন কোন জিনিশ, যেটা হয়ত আপনার চোখ এড়াইয়া গেছিল।

ভালো ফিডব্যাক প্রশংসা না, নিন্দাও না।

কিন্তু প্রশংসা ও নিন্দা বেশি কমন। এইগুলা করা সহজ ভালো ফিডব্যাক দেবার চাইতে।

নিন্দা বিষয়ে আমাদের গার্ড যেইরকম শক্ত থাকে, পাছে লোকে কিছু বলে, লোকে তো বলবেই ইত্যাদির মারফতে, একইরকম গার্ড প্রশংসা বা স্তুতির বেলায় থাকে না। প্রশংসায় আমরা অফ গার্ড হইয়া যাই, এবং বেশিরভাগেই প্রশংসারে বিশ্বাস করে ফেলি।

হাততালিতে যে অভ্যস্ত হইয়া যায়, হাততালি না হইলে সে গোল দেবার আগ্রহ হারাইয়া ফেলবে।

তার কাছে তখন খেলা ও গোল দেবার উদ্দেশ্য মূল থাকবে না, মূল হবে হাততালি পাওয়া।

আবার ধরা যাক একজন ব্যক্তি দুনিয়ার সবার স্তুতি পায়, কিন্তু সে নিজে নিজেরে ঐ স্তুতি দিতে পারে না কারণ সে জানে সে ওইটা না। এইটা ওই লেখকের মত, যে একটা পাণ্ডুলিপি পাইছিল, সেইটা নিজের নামে ছাপাইয়া বিখ্যাত লেখক হইল। দুনিয়ায় খ্যাতি পাইল। কিন্তু সে নিজে জানে ওই বইয়ের লেখক সে না।

ধরা যাক, আমার লাইফের কিছু লক্ষ্য আছে। আমি এইটা করব, ওইটা করব। এইগুলা করলে, বা করতে থাকলে আমি হ্যাপি বোধ করব। কিন্তু দেখা গেল, লোকে চায় আমি ক্লাউন হইয়া নাচি তাহলে তারা হাততালি দিবে, বা লোকে নিন্দা করতেছে লেখা গল্পের। এই দুইখানে আমার কী করার থাকতে পারে? প্রশংসা যদি আসে, সেইটা আবার সত্যি কোন ভালো কাজের জন্য, উপরি পাওনা হিশাবে থাকলো। না আসলে নাই। আর নিন্দা, সেইটা তো ধর্তব্যই না, যেহেতু আমার গোল নিন্দা বা প্রশংসায় ছিল না।

তাও, সামাজিক জীব হিশাবে প্রশংসা আমাদের ভালো লাগে। প্রশংসার মূল ফাংশন কিন্তু প্রশংসাটাই না, বরং সম্পর্ক নির্মান। এইজন্য তেলবাজি জিনিশটা আসে। তেল হইল দুর্বল প্রশংসা, যেখানে ব্যক্তি ধরতে পারেন প্রশংসাটা মিছা করা হচ্ছে। ফলে এই প্রশংসা কাজ করে না, ব্যক্তি উলটা রেগে যান।

নিন্দায় যেমন নিয়ন্ত্রণের বাসনা থাকে প্রশংসায় যে থাকে না, এমন নয়। আব্দুল করিম গানে বলেন, ভক্তের অধীন হও চিরদিন। ভক্ত প্রশংসা করে নিয়ন্ত্রণ করতেও। এইজন্য আব্রাহামিক রিলিজিয়নের গড নিজের নাম বলতেন না। কারণ এর আগের ধর্মসমূহে এই কনসেপ্ট ছিল, গডের নাম, প্রশংসা জপ করে তারে নিয়ন্ত্রণ করতো মানুষ, তারে দিয়া নানা কাজ করাইত। ওল্ড টেস্টামেন্টে নবী জ্যাকব নদীর ধার দিয়া ক্যানানে ফিরতেছিলেন এক রাতে। এক লোকের সাথে তার দেখা হয়। লোকটা কুস্তির আহবান জানায়। সকাল পর্যন্ত তার সাথে কুস্তি করেন জ্যাকব। ওই লোক জ্যাকবরে ইজরাইল নাম দেন, অর্থ যে গডের সাথে কুস্তি লড়ছিল। কিন্তু জ্যাকব নাম জিজ্ঞেস করলে উনি নিজের নাম বলেন নাই। জেনেসিসে বলা, এই লোক ছিলেন গড। এইরকম আরেকটা কাহিনী আছে মোজেসের সাথে মরুভূমিতে, যেইখানেও গড নিজের নাম বলেন নাই।

প্রশংসার রাজনীতিও আছে। প্রকাশ্য প্রশংসার মাধ্যমে ঘোষণা দেয়া হয় আমি এর কাজ বা এরে লাইক করি। এতে তারে যারা লাইক করে না তারা বিরাগভাজন হবে। এই কারণেও লোকে প্রকাশ্য প্রশংসা এড়াইয়া চলে।

এছাড়া প্রশংসা বা নিন্দা কোন জায়গায় কোন পরিস্থিতিতে করা হচ্ছে তা গুরুত্বপূর্ন। আপনে শিক্ষিত মধ্যবিত্তের সভায় হিরো আলমরে নিয়া অবলীলায় নিন্দা করতে পারবেন, কিন্তু হুমায়ূন আহমেদ নিয়া পারবেন না। আবার সেই জায়গায় হিরো আলমের প্রশংসা করা কঠিন হবে, সহজ হবে হুমায়ূনের প্রশংসা করা। সবাই করতেছে, সেই সুরে তাল মিলাইয়া প্রশংসা বা নিন্দা করা সবচেয়ে ইজি, এবং অন্যের অনুপস্থিতিতে নিন্দার মতোই ব্যাপারটা আগলি।

প্রশংসা ও নিন্দা নামক দুই দানবরে ডিল করতে, যারা নিন্দা বা প্রশংসা করতেছে সেই ব্যক্তিদের সম্পর্কে, এবং কোন কনট্যাক্সটে করতেছে ভাবলে ব্যাপারটা সহজ হয়ে যায়।

এবং ভাবলেন, আপনার নিজের যে গোল আছে, নিজেরে যেইসব হ্যাপি করবে, সেইসব করার প্রক্রিয়ায় এই নিন্দা বা প্রশংসা কী কোন পজেটিভ প্রভাব ফেলতে পারে?

যদি দেখেন ফেলতে পারে, তাহলে আমলে নেন, সে তো উপকারই করে দিলো। যদি দেখেন কোন প্রভাব ফেলবে না, তাহলে বাদ দেন। অথবা, যদি মনে হয় মার্কেটিং-এ ব্যবহার করবেন, করেন।

The great and noble are those who, like a lordly beast, listen unmoved to the barking of little dogs.  – Seneca

কথার মূলভাব ঠিক আছে, তবে সেনেকা এখানে নিন্দাকারকদের ঘেউ ঘেউ করা ছোট কুত্তা বলেছেন, আয়রনিক্যালি, এটা আন-স্টোয়িক হয়েছে। সেনেকা লাইফে ভালো স্টোয়িক হইতে পারেন নাই। কেবল এই কথার উপর ভিত্তি করে বলতেছি না, তার জীবন ইতিহাস স্বাক্ষী।

এর চাইতে তাও তে চিং বেটার কথা বলে, নিন্দা প্রশংসার উর্ধ্বে চলে যাওয়ারে গুরুত্ব দেয়,

They cannot be moved by praise or blame;
they cannot be changed by profit or loss;
they cannot be honored or humiliated. And so the wise are truly honored.