নকচারনাল এনিম্যালস

নকচারনাল এনিম্যালস

স্পয়লার বিদ্যমান। যারা এই ফিল্ম দেখেন নাই, দেখবেন ভাবছেন তারা না পড়তে পারেন। ফিল্ম দেখার পরে পড়লে ভালো হয়।

রেটিংঃ ৩.৫/৫

নকচারনাল এনিম্যালস একটি ইন্টারেস্টিং ফিল্ম। এখানে মূল কাহিনীর দ্বন্দ্ব যা দেখা যায় তা হচ্ছে, একজন লেখকের সাথে প্রেম করেন একজন আর্ট হিস্টরীর ছাত্রী, তাদের বিয়ে হয়। একসময় তিনি লেখকরে ছেড়ে একজন ধনী ব্যবসায়ীরে বিয়ে করেন। অনেক দিন পরে সেই লেখক একটা বইয়ের পান্ডুলিপি পাঠান তার সেই প্রাক্তন বউরে।

গল্প দুইভাবে আগায়। এক, লেখকের বইয়ের গল্প। দুই, লেখকের প্রাক্তন স্ত্রীর স্মৃতিচারনা।

দৃশ্যত এই গল্পের বাইরেও আরেক গল্প আছে এই ফিল্মের। এখানে সমস্ত কাহিনীটাই আসলে একজন লেখকের অন্তর্গত দ্বন্দ্ব। লেখকের শিল্প সাধনা এবং বস্তুগত পৃথিবীর দ্বন্ধ। একজন লেখক, সত্যিকার লেখক বা আর্টিস্ট যুবক বয়সে শিল্পের প্রতি আকৃষ্ট হন। তার মনে হতে থাকে তার জীবন মহান কিছু শিল্প তৈরীর জন্য। কিন্তু একসময় তিনি বস্তুগত পৃথিবীর চাপে পড়েন। যেই পৃথিবী একজন শিল্পীকে দূর্বল মনে করে। কারণ শিল্পী প্রচুর টাকার মালিক হইতে পারেন না। ফলে সমাজের বিচারে তিনি অসফল। এমনকী শিল্প পরিমন্ডলে স্বীকৃতিও পাওয়া সহজ না।

ফলে ঐ তরুণ লেখক হয়ত একসময় বস্তুগত পৃথিবীর দিকে ঝুঁকতে বাধ্য হন। নকচারনাল এনিম্যালস এ স্ত্রীর ভূমিকায় যিনি আছেন, তিনি বস্তুগত পৃথিবীর প্রতি ঝুঁকে যাওয়া শিল্পীর অংশ। মূলত তার প্রেক্ষাপট থেকেই দেখানো হয়েছে গল্প। আমরা দেখতে পাই তিনি দুখী। তিনি রাতে ঘুমাতে পারেন না। তার ধনী এবং ব্যবসায়ী স্বামীও তারে সময় দেয় না। তিনি বার বার মনে করতে থাকেন তার ফেলে আসা আগের লেখক স্বামীরে।

নকচারনাল এনিম্যালস
পোস্টারে দেখা যাচ্ছে, তাই সত্য। এই দুইজন আসলে এক মানুষই। এক মানুষেরই দ্বন্দ্ব। যে মুখটা আছে সেটা দুখী, আর ভিতরের ছায়া ছায়া লোকটা বিধ্বস্ত, বিষন্ন এবং প্রায় অস্তিত্বহীন।

লেখক স্বামী তারে যে পান্ডুলিপি পাঠায় তার গল্পও বস্তুগত পৃথিবী কীভাবে তার স্বত্তা তার কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছে এর গল্প। সেই গল্পে দেখা যায় একজন লোক রাতে হাইওয়ে দিয়ে তার স্ত্রী ও কন্যাকে সাথে নিয়ে যাচ্ছিল। পথে কিছু বদমাইশ তাদের আটকে ফেলে। তার স্ত্রী এবং কন্যাকে ধরে নিয়ে যায়। রেপ এবং খুন করে।

আবার মূল গল্পে লেখকের স্ত্রী যখন লেখককে ছেড়ে আসেন তখন তিনি এবরশন করান। অর্থাৎ, লেখকের যে বাচ্চা তার পেটে ছিল, তা হত্যা করেন।

লেখকের গল্পের বদমাইশগুলা হচ্ছে এই ম্যাটেরিয়ালিস্ট তথা বস্তুগত পৃথিবীর নিষ্ঠুরতা। যা মহান লেখক হইতে থাকা একজনের কাছ থেকে শিল্পচেতনা ছিনাইয়া নিয়া তারে সাধারণ জব, বা ব্যবসা করতে নামায়। টাকা রোজগারে নামায়।

আর লেখকের স্ত্রীর ভ্রুণ হত্যা হল, শিল্পচেতনারে হত্যা। তিনি নতুন ব্যবসায়ী হইতে ইচ্ছুক একজনরে বিয়ে করতে গিয়েই ভ্রুণ হত্যা করেন। এই হত্যার মাধ্যমে তিনি বস্তুগত জীবনে আসীন হন, নিজের শৈল্পিক জীবন বাদ দিয়া।

এর বিশ বছর পরে তিনি যখন পান্ডুলিপি পড়েন, তার খালি বার বার মনে হয় তার আগের লাইফ হয়ত ভাল ছিল। তার অপরাধবোধ জাগ্রত হয়। তিনি তার অর্থ বিত্তের জীবনের অসারতা উপলব্ধি করতে পারেন। তাই তিনি তার আগের স্বামীরে ইমেইল দেন দেখা করার জন্য। সে ইমেইলের উত্তরে দেখা করতে রাজী হয়।

শেষ দৃশ্য খুবই ইন্টারেস্টিং। দেখা যায় ভদ্রমহিলা আয়নার দাঁড়াইয়া তার গাঢ় লিপস্টিক মুছেন। পুরা ফিল্মেই তার গাঢ় লিপস্টিক ছিল। এটা দিয়া চাকচিক্য বুঝানো হইছে, বুঝাইছে অর্থ বিত্তের জীবন। লিপস্টিক মুছা মানে তিনি এসব মুইছা দিলেন। হাতের আংটি খুইলা ফেললেন। এরপর গিয়া তিনি অপেক্ষা করতে লাগলেন হোটেলে, তার সাবেক লেখক স্বামীর জন্য। আংটি খোলার ঘটনায় বুঝা যায় তিনি হয়ত আবার ভাবছিলেন তার পুরানা স্বত্তার সাথে একটা মিলমিশের।

খুবই গুরুত্বপূর্ন এই দৃশ্য। শেষপর্যন্ত সময় যায়, তার লেখক স্বামী আর আসেন না। এটা সম্ভব নয় আর। রবার্ট ফ্রস্টের ভাবে বলা যায়, রাস্তা ভাগ হইয়া গেছে দুইদিকে দুইটা। এর একটা আমি গ্রহণ করছি, আর তাতেই তোমার আমার পার্থক্য।

অর্থাৎ, তার সেই যুবক, মহান শিল্প তৈরী করতে চাওয়া, বড় লেখক হইতে চাওয়া স্বত্তার সাথে বস্তুগত পৃথিবীর স্ত্রী হইয়া যাওয়া স্বত্তার প্রচুর তফাত এখন। তা আর দূর করা যাবে না।

নকচারনাল এনিম্যালস একটা লেখকের জীবনের গল্প, আর্টিস্টের জীবনের গল্প। যার আর্টিস্ট হবার তাড়না ছিল বা হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু দুনিয়ার চাপে পড়ে তিনি সে পথ থেকে সরে গেছেন।

এখানে প্রশ্ন উঠতে পারে, তিনি যদি লেখকই হতেন, শিল্পী হতেন, তখন তার কেমন অনুভূতি হত? এত বিত্তশালী না, সাধারণ একটা  জীবন যদি হইত তার। তখন দেখাত তিনি ঐ লেখকের স্ত্রীই আছেন। তাদের নানা টানা পোড়েনের সংসার। তখনো কী এইরকম অর্থহীনতা বোধ তার মধ্যে বিরাজ করত? তার কি মনে হইত যে, আমি তো চাইলেই এই আর্টচর্চা বাদ দিয়া বড় ধনী লোক হইতে পারতাম?

অথবা, একজন লেখক, মহান লেখক, তিনি শিল্প তৈরী করছেন, সফলই হয়েছেন যদিও টাকা করতে পারেন নি; তার দৃষ্টিকোন থেকে তার নিজের জীবনকে দেখলে, জীবনের অর্থহীনতার বোধ কি তার উপরও কাজ করবে?

 

নকচারনাল এনিম্যালস (২০১৬) পরিচালনা করেছেন টম ফোর্ড। লেখক অস্টিন রাইট এর উপন্যাস টনি এন্ড সুজান এর উপর ভিত্তি করে এর কাহিনীর নির্মান। প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেছেন এমি এডামস, জ্যাক গিলেনহ্যাল, মাইকেল শ্যানন। চমৎকার অভিনেতা জ্যাক গিলেনহ্যাল অভিনীত আরেকটি ফিল্ম এনিমি নিয়ে লেখাটি আগ্রহীরা দেখতে পারেন।