১০ আগস্ট ২০১৭ তারিখে বণিক বার্তার সম্পাদকীয়তে একটি প্রবন্ধ প্রকাশ হয় “পরিবারে ভাঙন ও সামাজিক বিপর্যয়ের সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ” শিরোনামে, লিখেছেন একজন গবেষক ডক্টর হাসান মাহমুদ।
বাংলাদেশে বিবাহ বিচ্ছেদ বৃদ্ধি প্রসঙ্গে সমাজবিজ্ঞানীদের উদ্ধৃত করে নারী ক্ষমতায়ন বৃদ্ধিকেই এই বিবাহ বিচ্ছেদ বাড়ার কারণ হিসেবে মিডিয়ায় উল্লেখ করা হচ্ছে, এর সমালোচনা তিনি করেছেন। তিনি রোমান্টিক ভালোবাসা ভিত্তিক বিয়ের বিরুদ্ধে তীব্র অবস্থান নিয়েছেন এবং বিবাহ বিচ্ছেদের কারণ হিসেবে একেই দায়ী করেছেন। তার মতে যেখানেই রোমান্টিক ভালোবাসা ভিত্তিক বিয়ে মেনে নেয়া হচ্ছে সেখানেই বিবাহ বিচ্ছেদের মহামারী লেগে গেছে। তিনি বলেছেন, একক পরিবারে স্বামী স্ত্রী এর উপর অধিক চাপ পড়ে এবং এর ফলেই বিবাহ ভাঙ্গার ক্ষেত্র তৈরী হয়। খুব সাধারণভাবে বললে এভাবেই তিনি তার মত উপস্থাপন করেছেন।
কিন্তু এখানে খুবই লক্ষণীয় ব্যাপার হলো গবেষক ডক্টর হাসান ব্যক্তির সুখ বা পার্সোনাল ওয়েল বিং এর ব্যাপারটি সরাসরি এড়িয়ে গেছেন। তিনি সামাজিক ব্যবস্থার অনু হিসেবে পরিবারকে দেখে তার ব্যাপারেই ভেবেছেন, অনুর গাঠনিক উপাদান পরমাণু অর্থাৎ ব্যক্তির সুখ শান্তি নিয়ে ভাবেন নি।
আমাদের ডাটা খুবই অপর্যাপ্ত। এখানে পশ্চিমা দেশগুলির মত রিসার্চও হয় না। বৈবাহিক অবস্থা বা ম্যারিটাল কোয়ালিটি কেমন আমাদের সমাজে তা আমরা জানতে পারলে বুঝতে পারতাম যেসব বিবাহ টিকে আছে তারা কোন অবস্থায় টিকে আছে। আমেরিকার ক্ষেত্রে গবেষকেরা দেখছেন যে যদিও বিবাহ বিচ্ছেদের হার বেড়েছে তথাপি যেসব বিয়ে টিকেছে তারা ভালোভাবেই টিকে আছে, যা আগের টিকে থাকা বিবাহগুলির চাইতে অনেক ভালো। [১]
সমাজ যখন পরিবর্তিত হয় তখন সমাজে বিবাহও পরিবর্তিত হবে স্বাভাবিক, সমাজের মানুষের চাহিদার পরিবর্তনের সাথে সাথে। আমেরিকার ক্ষেত্রে বিবাহগুলি কিভাবে পরিবর্তিত হয়েছে তা সমাজবিজ্ঞানী এন্ড্রু চার্লিন এবং ইতিহাসবিদ স্টিফানি কুন্টজ এভাবে দেখেনঃ
১। প্রাতিষ্ঠানিক বিবাহ
১৮৮৫ এর আগ পর্যন্ত এই অবস্থা চলমান ছিল কৃষিভিত্তিক সমাজে। বিয়ের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল খাদ্য উৎপাদন, আশ্রয়, নিরাপত্তা ইত্যাদি।
২। ভালোবাসা ভিত্তিক বিবাহ
১৮৫০ থেকে ১৯৬৫ এর সময়কাল। এ সময় বিয়ের উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়ায় ভালোবাসা দেয়া, পাওয়া এবং দারুণ যৌনজীবন। তখন আমেরিকান সমাজ গ্রামীন থেকে শহুরে হচ্ছে, দেশের সম্পদ বাড়ছে। মানুষের তখন ভালোবাসার আকাঙ্খা তৈরী হয়।
৩। আত্ম-প্রকাশমূলক বিবাহ
১৯৬৫ এর পর থেকে আমেরিকান সমাজে এই ধরনের বিবাহ বিদ্যমান। এখানে বিবাহের উদ্দেশ্য আত্মোউন্নয়ন, নিজেকে আবিষ্কার করা, আত্মসম্মান বা সেল ইস্টিম ইত্যাদি। ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদ হোক, কনজিউমারিজমের বিস্তার হোক বা সামাজিক অন্য কোন পরিবর্তনের জন্যই হোক না কেন, মানুষ বিয়েকে ব্যক্তিগত উন্নয়নের মাধ্যম হিসেবেই দেখছে।
সাইকোলজিস্ট আব্রাহাম মসলোর ক্লাসিক হায়ারার্কি অব নীডস [২] এর মতো আমেরিকান সমাজে বিবাহের এই পরিবর্তন। মসলো’র তত্ত্বমতে, প্রথমে মানুষের সাইকোলজিক্যাল প্রয়োজনগুলি মেটাতে হয়, এগুলির মধ্যে আছে খাদ্য বস্ত্র আশ্রয় ইত্যাদি। এরপরে মানুষ চায় নিরাপত্তা, এরপর বন্ধুত্ব, পারিবারিক সম্পর্ক, ভালোবাসা ইত্যাদি। এরপর আত্মসম্মান বা সেলফ ইস্টিম, এবং অতঃপর সেলফ-একচুয়ালাইজেশন। এর একটি পূরণ হলে অন্যটির চাহিদা তৈরী হয়। বর্তমানে আমেরিকান সমাজে বিবাহের উদ্দেশ্য মসলোর শেষ স্তরটিতে আছে, আগেরগুলি তার এমনিতেই পূর্ন তাই। সাইকোলজির অধ্যাপক এলি ফিংকেল এমনই মনে করেন।
আমাদের সমাজে বিবাহ কেমন, ইতিহাসে কেমন ছিল এবং বর্তমানে মানুষের বিবাহ কেন্দ্রিক চাহিদা কী এ সম্পর্কে কোন গবেষণা নেই। বিবাহ বিচ্ছেদের ডাটা দেখে, পশ্চিমা সমাজের সাথে মিলিয়ে তাই হুট করে কোন সিদ্ধান্ত নিয়ে বসা ঠিক না।
গবেষনায় দেখা গেছে, আমেরিকান সমাজে স্বামী স্ত্রী’রা নিজেদেরকে একান্তে কম সময় দিচ্ছেন, এটা বিবাহ বিচ্ছেদের এক প্রধান কারণ বলে ধরেছেন সাইকোলজিস্ট এলি ফিংকেল। তার মতে এই সময় দেয়ার পরিমাণ বাড়ালে তারা দারুণ বৈবাহিক সম্পর্ক তৈরী করতে পারবেন। [৩]
আমাদের সমাজে স্বামী স্ত্রী’রা আগে নিজেদের একান্তে কীরকম সময় দিতেন, এখন কেমন দিচ্ছেন, এরকম কোন ডাটা আমাদের হাতে নেই। ডক্টর হাসান একক পরিবার বাড়ার ক্ষেত্রে স্বামী স্ত্রী’র উপর বেশী চাপ পড়ার কারণের কথা বলেছেন, এর সাথে মিলিয়ে দেখলে এটা বলা যায় এই চাপ পড়ার কারণেই তারা নিজেদের একান্তে বেশী সময় দিতে পারছেন না। এবং এটাই পরিবার ভাঙ্গার একটি প্রধান কারন।
কিন্তু এর জন্য এককভাবে প্রেম ভিত্তিক বিবাহকে দোষ দেবার কিছু নেই। ফ্লোরিডা বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যাক ম্যাকনাল্টির গবেষণা মতে, যাদের বিবাহ নিয়ে আশা বেশী থাকে এরা সুখের সময়ে দ্বিগুণ সুখী থাকে, আবার দুঃসময়ে দ্বিগুণ দুখী হয়। ফলে প্রেমভিত্তিক বিবাহ যেমন দ্বিগুন দুঃখ আনতে পারে দুঃসময়, তেমন দ্বিগুন সুখও আনে সুসময়ে। [৪] ফলে প্রেম একমাত্র ভিলেন নয়, বিয়া ভাঙ্গায়।
যদি আমাদের ক্ষেত্রেও বিয়ের অবস্থা আমেরিকার মতো প্রায় একই রকম হয়, তাহলে পর্যাপ্ত সময় ও শক্তি স্বামী-স্ত্রী’রা নিজেদের সম্পর্কে ব্যয় করেই নিজেদের সংসার সুন্দরভাবেই টিকিয়ে রাখতে পারবেন। এবং তখন তাদের সেই বৈবাহিক সম্পর্ক অপেক্ষাকৃত ভালো হবে, এবং তা তাদের নিজেদের ব্যক্তিগত সুখেও ধণাত্মক প্রভাব ফেলবে।
পরিবার টিকিয়ে রাখা যেমন সমাজের জন্য দরকারী, তেমন দরকারী সমাজের মানুষের ব্যক্তিগত সুখ বা পার্সোনাল ওয়েল বিং। এর জন্য রোমান্টিক ম্যারেজ বা সেলফ এক্সপ্রেসিভ ম্যারেজ অধিক কার্যকরী হবে বলে মনে হয় সাধারণ বিবেচনাতেই। সমাজ টিকিয়ে রাখার জন্য লোকদের যদি কৃষিভিত্তিক সমাজের প্রাতিষ্ঠানিক বিবাহতে ফিরে যেতে হয়, তাহলে তা খুব ভালো সমাধান নয়, কারণ সমাজ অর্থনৈতিক ও সামাজিক ভাবে ঐ জায়গাতে নেই। তথ্য প্রযুক্তির বিস্তার, অর্থনৈতিক পরিবর্তন ইত্যাদির কারণে সমাজ বদলেছে, সমাজের মানুষজন বদলেছে, বদলেছে তাদের বিবাহভিত্তিক চাহিদার ধরণ।
আর কার্যকর ভাবে এ সংস্লিষ্ট কোন সমস্যা চিহ্নিত করা ও সমাধানের জন্যঃ
১। ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ে বিবাহ কেমন ছিল এ সমাজে, ঐসব বিবাহের চাহিদা কী ছিল তা জানতে হবে।
২। রিলেশনশীপ সাইকোলজি বিবেচনায় নিতে হবে।
৩। ম্যারিটাল কোয়ালিটি বা বৈবাহিক অবস্থা কেমন, এবং সময়ের সাথে তার পরিবর্তন সম্পর্কে জানতে হবে।
৪। মানুষের ওয়েলবিং বিবেচনায় নিতে হবে।
৫। পরিবর্তিত সমাজ ব্যবস্থাকে বুঝতে হবে।