আমি কেন এইসব লেখালেখি করি এখানে বা অন্যত্র এটা নিয়া ভাবলাম। ভাবনার একটা পয়েন্ট আছে, ইভ্যলুশনারি সাইকোলজির পয়েন্ট অভ ভিউ থেকে দেখতে গেলে সৃষ্টিশীল কাজ এক ধরণের সিগনালিং। শেক্সপিয়রের সনেট থেকে ডেভিড লিঞ্চ বা তারকোভস্কির ফিল্ম। এক ধরণের সিগনালিং। সোশ্যাল স্ট্যাটাসের। যে বুদ্ধির দিক থেকে, জ্ঞানের দিক থেকে, ক্রিয়েটিভিটির দিক থেকে আমি সেরা।
কিন্তু এই সেরাত্বর কী দরকার আসলে? দরকার হান্টার গেদারার সোসাইটিতে ছিল। যেখানে পার্টনার আকৃষ্ট করতে ও তার যোগ্য হইতে গেলে সেরা হইতে হইত দলের মধ্যে। নিজের ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের টিকে থাকার জন্য দরকার ছিল। কিন্তু, এখানে তো সেই পয়েন্ট নাই। বা ঐ সময়ের রয়ে যাওয়া চেতনা ডিএনএতে রয়ে গেছে আমি যখন ধরতেই পারতেছি, তাইলে কেন আর এই সেরাত্বের খেলা?
ধরেন, একজন কম বুদ্ধিমান, এবং আমি বা আপনে বেশি বুদ্ধিমান, তো তাতে কী?
বা, আরেকটু ক্রিটিক্যালি গেলে বলতে হয়, যে সেরা তার আদৌ কি নিজেরে সেরা প্রমাণের কোন দরকার আছে? বা, যার নিজেকে সেরা প্রমাণের জন্য কতো কিছু করতে হয়, এই কতো কিছু করাই কি প্রমাণ করে না যে সে আসলে সেরা নয়?
এইখানে তারকোভস্কির স্টকার ফিল্মের একটা ডায়লগ স্মরণ করি। এই ফিলোসফিক্যাল ফিল্মে লেখক চরিত্রটি যে কথা বলেন, ‘একজন লেখে কারণ সে হইল যন্ত্রণাক্লিষ্ট, কারণ সে নিজেরে সন্দেহ করে। তার সব সময় নিজের ও অন্যদের কাছে যোগ্যতা প্রমাণ কইরা যাবার তাড়না। এবং, যদি আমি নিশ্চতভাবে জানিই যে আমি জিনিয়াস, তাইলে লেখার কি দরকার? ‘
একইকথা আমরা পাই স্লোভেনিয়ান দার্শনিক স্ল্যাভো জিজেকের কাছে। জিজেক বলেন,
আমার বড় ভয়টা হইতেছে, ‘যদি ধরেন কিছু সময়ের জন্য আমার কথা বলা বন্ধ হইয়া যায়… মানে বুঝতেছেন ব্যাপারটা, মানে যেই বিরাট প্রদর্শনীটা আছে তা মুহুর্তেই ভাইঙ্গা পড়বে; মানুষেরা ভাববে এইখানে কেউ নাই, কিছুই নাই। এইটাই আমার ভয়, যেন আমি কিছুই না, সব সময় ভান ধইরা আছি অন্য আরেকজনের, এবং সব সময় একটা অতি সক্রিয়তার ভিতরে আমারে থাকবে হবে… মানুষরে মুগ্ধ কইরা যাইতে যেন তারা খেয়াল না করে যে এইখানে আসলে কিছুই নাই।’
তিনি যদি কথা বলা বন্ধ করে দেন তাহলে তার যে পারসোনা আছে, তিনি সারাক্ষণ কথা বলে ও নানা কিছু করে তৈরি করছেন ও সবার সামনে উপস্থাপন করে চলেছেন, কথা বলা বন্ধ হয়ে গেলে সেই পারসোনা ধ্বসে পড়বে। এটাই তার ভয়। তিনি নিজে একটা নাথিং, কিন্তু ভাব ধরে আছেন যেন তিনি সামথিং, এবং এই ভাব ধরতে গিয়া নানা কিছু করতেছেন, ও দেখাইতেছেন। কথা বলা বন্ধ হইলে এইটা যদি লোকে ধইরা ফেলে, এবং তার দিকে তাকাইয়া যদি দেখতে পায় সেই আদি ও অকৃত্রিম নাথিংনেস । কিছুই নাই যেখানে।
এই নাথিংনেস যেটা ব্যক্তির ভিতরে অবস্থান করে। কিছুই না সে।
এই নাথিংনেস ঢাকতেই এত একটিভিটি আমাদের।
এটা কি ওই আর্নস্ট বেকারের ডিনায়াল অব ডেথ না? নিজের মৃত্যুরে ভুলে থাকা, নিজের লিটলনেসরে ভুলে থাকার জন্যই কি মানুষ মানুষের চাইতে বড় হইতে চায়? এইজন্যই তো আর্ট বানায় ও তা উপভোগ করে। ন্যাশনালিজমের গর্বে, কালচারের গর্বে মজে, আরো কতকিছুরে পবিত্র বানায় ও সে পবিত্রতা রক্ষা করতে মারে ও মরে।
এই মূল্য আরোপিত। বিভূতিভূষণের আরণ্যকের এই অংশ দেখি,
‘আপিসের বাহিরে আসিলাম। ইতিমধ্যে জওয়াহিরলাল আবার ঢিবি হইতে নামিয়া জঙ্গলের মধ্যে ঢুকিয়া পড়িয়াছে। আমি অপেরাগ্লাস আনাইয়া দেখিলাম, দূরে জঙ্গলের মধ্যে দীর্ঘ দীর্ঘ ঘাসের ও বনঝাউয়ের মধ্যে সে আসিতেছে বটে। আর আপিসের কাজে মন বসিল না। সে কি আকুল প্রতীক্ষা! যে জিনিস যত দুষ্প্রাপ্য মানুষের মনের কাছে তাহার মূল্য তত বেশি। এ কথা খুবই সত্য যে, এই মূল্য মানুষের মনগড়া একটি কৃত্রিম মূল্য, প্রার্থিত জিনিসের সত্যকার উৎকর্ষ বা অপকর্ষের সঙ্গে এর কোনো সম্বন্ধ নাই। কিন্তু জগতের অধিকাংশ জিনিসের উপরই একটা কৃত্রিম মূল্য আরোপ করিয়াই তো আমরা তাকে বড় বা ছোট করি।’
আমাদের এই মূল্যায়ন তথা মূল্য আরোপ, এবং এর সাথে নিজেদের কানেক্ট করা, নিজেদের নাথিংনেস ঢাকতেই তো?
এইখানে আবার ডিপনেসের কথা আসে। ধরেন জ্ঞানের ক্ষেত্রে, কোন বিষয়ের ক্ষেত্রে, কত ডিপেই বা আমরা যাইতে পারি? যারা বেশি ডিপে গেছেন কোন বিষয়ে, যেমন ধরা যাক আইনস্টাইন, তিনি ডিপে গিয়ে তো এইটাই দেখাইলেন যে ডিপনেস অতল, ডিপনেস অতি অতি ডিপ, বা কতো ডিপেই বা গেলেন তিনি? কতো ডিপে একজন যাইতে পারে? বা, আদৌ ডিপনেস বলতে কি কিছু আছে?
তখন এই সত্য স্বীকার করা জরুরী হয়ে উঠে, নিজের কাছে নিজে অন্তত সৎ থাকার জন্য, এন্ডি ওয়ারহলের কথায়, I am a deeply superficial person. বা অভিনেত্রী আভা গার্ডনারের কথায় ‘Deep down, I’m pretty superficial.’