রুচি বিষয়ে

আমাদের রুচি আসলে কার রুচি?

জ্যাক লাঁকা বলেছেন আওয়ার ডিজায়ার হচ্ছে ডিজায়ার অব আদারস। এই আদারস কারা? বিগ ব্রাদারস। বিগ ব্রাদার্সেরা ছোট শিশুর রুচি গঠনে ভূমিকা পালন করে থাকেন। এই বিগ ব্রাদার্সের মধ্যে আছেন পরিবারের লোকজন, মা বাবা, দাদা, ভাই, বোন ইত্যাদি। মানুষের বাচ্চারা পরিবার থেকেই যে বেশী শিখে তা তো জানা কথাই। পরিবার বা বাইরের লোকজন বিচ্ছিন্ন হয়ে যদি তারা থাকত তাহলে তারা স্বাভাবিক হত না। যেমন, শিশু জিনি যাকে তার পাষন্ড পিতা এক ঘরে বন্দী করে রেখেছিল দশ বারো বছর। পরে যখন এটা বের হয় তখন দেখা যায় জিনি মারত্মক অসুস্থ, কথাই বলতে পারে না।

এছাড়া জার্মানীর সেই অদ্ভুত ঘটনার কথা বলা যায়। ক্যাসপার হোজার নামের এক যুবক, হঠাৎ একদিন সে বের হয়ে এসে বলেছিল কেউ একজন তারে এক অচেনা জায়গায় লুকিয়ে রাখছিল বন্দি করে, ছোটকাল থেকে। সে এর আগে মানুষের সংস্পর্শে আর আসে নাই। হঠাৎ ছাড়া পেয়ে আসছে সে। তারে নিয়া একটা ফিল্মও হইছে যার ইংরাজি নাম দ্য এনিগমা অব ক্যাসপার হোজার।  তবে, হোজারের মানুষের সংস্পর্শে ছোটকাল থেকে না থাকার ব্যাপারটা ইতিহাসবিদেরা নাকচ করে দেন। এর স্বপক্ষে শক্তিশালী যুক্তি হলো, মানুষের সংস্পর্শে না থাকলে সে ভাষা শিখলো ক্যামনে?

যাইহোক, মানুষের সমাজের যে আচার আচরন, পোষাক, ব্যবহার ইত্যাদি প্রচলিত এটা হচ্ছে সেই সমাজের রুচির বহিঃপ্রকাশ। এই রুচির বাইরে যাওয়ারে সেই সমাজ বিভিন্নভাবে নিরোৎসাহীত করে। আমাজন জঙ্গলে আধুনিক মানবজাতি বিচ্ছিন্ন যে মানবসমাজ আছে, তাদের সমাজেও নানা রুচি তারা ঠিক করে নিয়েছেন। যেমন আমাদের সমাজে আমরা নিয়ে থাকি। এইসব সমাজে জন্ম নেয়া শিশু আসমান থেকে রুচি সাথে নিয়ে আসে না। সমাজে বড় হতে হতে সে তা অর্জন করে। তার মধ্যে জন্মগতভাবে একটা জিনিস থাকে, বিবর্তনগত ভাষায় একে বেঁচে থাকার বা টিকে থাকার তাড়না বলা যায়, (জাংগিয়ান সামগ্রিক কনশাসনেস বা চেতনা মনে হয় এটাই) যা সে তার পূর্বপুরুষ থেকে পেয়ে আসে। কিন্তু রুচি ইত্যাদি সে অর্জন করে।

তাই, মানুষের রুচি আসলে মানুষের রুচি নয়, আমাদের রুচি হচ্ছে সমাজের রুচি। বা সমাজের চাইতে আরো বৃহত্তর কিছুর যা সমাজরে প্রভাবিত করে।

 

রুচি নির্ধারন করে দেন কে?

স্ল্যাভো জিজেক বলেন, সিনেমা ইজ দ্য আল্টিমেট পার্ভাট আর্ট। এটা আপনি যা ডিজায়ার করেন তা আপনারে দেয় না, আপনাকে বলে কীভাবে ডিজায়ার করতে হয়।

রুচির ক্ষেত্রে ডিজায়ার গুরুত্বপূর্ন। চাহিদা আর ডিজায়ার এক নয়। চাহিদা হচ্ছে ক্ষুধা লাগলে মানুষের বাচ্চা খেতে চাইবে। কিন্তু যখন তার পেটে ভাত আছে, খাওয়ার চাহিদা নাই, তখন সে তার আম্মাকে বলবে, আম্মা একটা গল্প বলেন। এই গল্প শোনার আকাঙ্খাটাই তার ডিজায়ার। লাকাপন্থী দার্শনিক সলিমুল্লাহ খান তার ডিজায়ার বিষয়ক লেকচারে এমনই জানান দেন।

তো সিনেমা যখন একটা সমাজের মানুষকে কীভাবে ডিজায়ার করতে হবে তা বলে দিচ্ছে তখন ঐ মানুষদের রুচির নিয়ন্ত্রণ অনেকটা চলে যাচ্ছে তার হাতে। আর কীভাবে করতে হবে, এটা বলে সে সীমাবদ্ধ থাকলো ধরা যাক, কিন্তু টিভি মিডিয়ার অন্যান্য অনুসঙ্গগুলোর উদ্দেশ্য যেহেতু ব্যবসায়ীক তাই তারা সরাসরি দর্শকদের বলে কী ডিজায়ার করতে হবে।

যেমন, সৌন্দর্য একটা ধারণা। এই ধারণা তারা তাদের ব্যবসায়ীক স্বার্থ অনুযায়ী বিভিন্নভাবে তৈরী করে মানুষকে দিতে পারে। এর মধ্য দিয়েই মানুষের মনে একটা সৌন্দর্যের ধারণা তৈরী হচ্ছে বা পাকাপোক্ত হচ্ছে। গায়ের রঙ ভিত্তিক সৌন্দর্যের ধারণা ইত্যাদি বিষয় এখানে উদাহরন হিসেবে দেয়া যায়। টিভি বিজ্ঞাপনের অধিকাংশই থাকে রঙ ফর্সাকারী ক্রিমের। এইসব দেখে দেখে বড় হওয়া দর্শকের কাছে ফর্সা রঙই আকাঙ্খিত হবে। অন্যান্য রঙের সৌন্দর্য সে তার মত করে তৈরী করে নিতে পারবে না, সেই সময় ও পরিবেশ তার নাই।

কারণ সে যেসব মিডিয়ার প্রভাবের মধ্যে বড় হচ্ছে ঐসব মিডিয়ার প্রধান উদ্দেশ্য তাকে বিনোদন দেয়া। ব্যস্ত রাখা। তাকে স্বাধীন চিন্তা থেকে বিরত রাখা। যাতে তাকে ব্যবহার করেই গড়ে ওঠে মিলিয়ন ডলারের ব্যবসা।

তার রুচি এমনভাবে তৈরী করা হয় যাতে তাকে ব্যবহার করা যায়।

 

গায়ের রঙ বিষয়ক উদাহরণের ব্যাখ্যা

গায়ের রঙ বিষয়ক উদাহরনের কথা যে বলা হল তা কিঞ্চিত ব্যাখ্যা দাবী রাখে। এই অঞ্চলে যে দুইজন ধর্মীয় মহাপুরুষ তৈরী হয়েছিলেন তাদের গাত্রবর্ন গৌর নয়, এই যুক্তিতে মুজতবা আলী লিখেছিলেন, শাদা বা গৌর রঙ্গের প্রতি এখানকার লোকের আকর্ষন অনেক পরের ঘটনা। এমনকী ইংরাজরা যখন প্রথম এলো এখানে, তখন লোকে জিজ্ঞেস করত, আপনার গায়ে ধবল কেন?

আবার দ্বিজ চন্ডিদাসের কবিতায় দেখা যায় চন্ডীদাসও গৌর বর্নকে আকাঙ্খিত হিশাবে উপস্থাপন করেছেন। বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগে (১২০১-১৮০০) বৈষ্ণব কবিরা ছিলেন, তাদের মধ্যে অন্যতম দ্বিজ চন্ডীদাস। এক কবিতায় রাধার সৌন্দর্য প্রকাশে তিনি বলেন, গোরোচনা গোরী, নবীনা কিশোরী। তাকে ঘাটে নাইতে দেখে কবির মাথা নষ্ট হবার জোগাড়। গোরোচনা অর্থাৎ উজ্জ্বল পীতবর্ন, গোরী – গৌরবর্না, ফর্সা মেয়ে।

এখানে পীতবর্ণ যে বলা হচ্ছে গৌরবর্ণের অর্থ তা হলুদবর্ণ। শাদা বা ফর্সা নয়। সম্ভবত তা দুধে আলতা কালার ইঙ্গিত করে। গৌর বর্ণের আরেক অর্থ “ফর্সা বা শাদা” হওয়া অনেক পরের ব্যাপার হতে পারে।

অথবা মধ্যযুগে বাংলায় মুসলমান সুলতানদের শাসন ছিল। এরা প্রথমে ছিল তুর্কী, ওই পর্বের প্রায় দুইশ বছর অন্ধকার যুগ। এর পরেও সুলতানেরা শাদা চামড়ার ছিলেন মনে হয়, যেহেতু তারা বাইরে থেকে আগত। শাসকদের রঙের কারণে মধ্যযুগে শাদা চামড়া আকর্ষনীয় বস্তুতে এই জন্য পরিণত হয়েছিল সম্ভবত। এরপরে আসে ইংরাজদের শাসন।

চীন, জাপান ইত্যাদি দেশেও ইংরাজদের সাথে যোগাযোগের পূর্ব থেকেই শাদা চামড়া সৌন্দর্যের একটা অংশ ছিল। তখনো মহিলারা রঙ ফর্সা করার জিনিসপত্র ব্যবহার করতেন। জাপানে দাঁত কালো করার চল ছিল। এটা এখন নাই।

কিন্তু আগে থাকলেও, বর্তমানে বাংলাদেশে যে সৌন্দর্যের মাপকাটি এতে শাদা রঙের একচ্ছত্র আধিপত্রের একটা প্রধান কারন দুইশ বছরের ব্রিটিশ শাসন। তাদের ধন সম্পদ প্রাচূর্যের প্রতি এখানকার মানুষের মুগ্ধতা। আর ওয়েস্টার্ন মিডিয়ার প্রভাবও যুক্ত এতে।

 

রুচি এবং সৌন্দর্য

কোন জিনিস বা আচরন কোন সমাজের চোখে রুচিশীল মানে ঐ সমাজের চোখে তা সুন্দর। উচ্চরুচি মানে উচ্চ মানসম্পন্ন সৌন্দর্য। নিম্নরুচি মানে প্রায় অসুন্দরের কাছাকাছি।

কুৎসিত বা আগলি নয়। আগলি সৌন্দর্যের বিপরীত শব্দ নয়। আগলি অন্য বস্তু, অসুন্দরের বাইরে তার অবস্থান। সুন্দরের বিপরীত অসুন্দর।

অরুচিকর বা নিম্নরুচির কোন জিনিস সুন্দর বলে পরিগণিত হয় না। সৌন্দর্যের ধারণা যেমন ব্যক্তিভেদে তার আপেক্ষিকতাধর্ম প্রদর্শন করে তাই রুচিও ব্যাক্তিভেদে আপেক্ষিকতা প্রদর্শন করে। কিন্তু সমাজের সামগ্রিক সৌন্দর্যের যেমন একটা মানদন্ড থাকে, রুচিরও এমন মানদন্ড সমাজে বর্তমান থাকে।

এটা তৈরী হয় সাংস্কৃতিক পরিকাঠামোর মধ্যে। একে নিয়ন্ত্রণ করার বিপুল ক্ষমতা রাখে পপুলার মিডিয়া। এই পপুলার মিডিয়া, সাহিত্য ইত্যাদি যখন পুরোপুরিভাবে ব্যবসায়ীক উদ্দেশ্যে এবং একরকম ব্যবসায়ীদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় তখন তারা একে নিজ স্বার্থসিদ্ধির জন্য ব্যবহার করতে থাকে। এর জন্য দীর্ঘদিনের সংস্কৃতির মাধ্যমে অর্জিত রুচির ধারনার বিপরীতেও যায় তারা, যেহেতু পুজির শক্তি তাদের আছে, তাই তারা বহাল তবিয়তেই ভবিষ্যত প্রজন্মকে এমন এক রুচির দিকে নিয়ে যায়, যা ঐ সমৃদ্ধ সংস্কৃতি সমাজ ও তার অর্জিত জ্ঞান বিজ্ঞানের সাপেক্ষে স্বস্তা বলে বিবেচীত হতে পারে।

 

ভেনাসেরা, সৌন্দর্যের ইতিহাস

ভেনাস অফ ভিলেনদরফ নামে যে মূর্তিখানা, খ্রিস্ট্রের জন্মের প্রায় ২৫০০০ বছর পূর্বের, তার গঠন বর্তমানের সৌন্দর্যের হিশাবে অসুন্দর। সেই সময়ে আরো যেইসব মূর্তি পাওয়া গেছে, তারাও একইরকম। তাদের শারিরিক গঠন ফ্যাটি। তাদের স্তনের আকার বড়। হয়ত সেইসময়ের এমন ধারণা ছিল যে এইরকম শরীরের মহিলারা সুস্থ সন্তান ধারন এবং তার প্রতিপালনের জন্য বেশী উপযুক্ত।

শারীরিক গঠনে প্রতিসাম্যিক ফিট থাকা যে সুন্দর এই ধারনার উৎপত্তি খ্রিস্টের জন্মের প্রায় ৮০০ থেকে ৬০০ বছর পূর্বে। গ্রীকরা বিজ্ঞানে এবং গণিতে উৎকর্ষ অর্জন করে। তখন তারা সৌন্দর্যকে অন্যভাবে দেখতে শুরু করে। প্রতিসাম্য বা সিমেট্রির ধারণা তারা তাদের আর্কিটেকচারে প্রয়োগ করে। এটা ছিল সৌন্দর্যের প্রকাশ। প্লেটো প্রথম এই সৌন্দর্যের সমানুপাতের ধারণা মানবদেহের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করেন। তার মতে, যেসব নারী পুরুষের দেহের বিভিন্ন অংশ সমানুপাতিকভাবে অবস্থান করে তারাই প্রকৃত সুন্দর।

গ্রীসে অলিম্পিক খেলার চল হয়। সেখানে সাফল্যের জন্য শরীরের গঠন ঠিক রাখার প্রয়োজন ছিল। ফলে পূর্ববর্তীকালের অতিরিক্ত ওজনদার শারীরিক গঠনের ধারণা গ্রীকেরা ত্যাগ করে।

ছবিঃ আফ্রোদিতি অব নিটোস (৪০০ বিসিই)

তারা যে আফ্রোদিতি অব নিটোসের মূর্তি বানায় খ্রিস্টের জন্মের প্রায় ৪০০ বছর আগে, তাতে দেখা যায় শারীরিক গঠন ভারী নয়। স্তনের আকৃতি ছোট। তার শরীরের বিভিন্ন অংশের মধ্যে একটা সমানুপাত রাখা হয়েছে। এটা ছিল গ্রীকদের চোখে মহিলাদের সৌন্দর্য।

রোমানরা গ্রীকদের এই সৌন্দর্যের ধারণা অনুসরন করে। রেনেসাকালীন সময়ের পেইন্টিং গুলোতে দেখা যায় প্রায় সব ন্যুড মহিলাদের স্তন ছোট। ১৪ থেকে ১৭ শতক, তখন যেসব ন্যুড মহিলাদের ছবি আঁকা হয়েছে সেগুলো দেবীদের ছিল। কোন সাধারন মহিলার নয়। ওদের প্রত্যকের নামের সাথেই ভেনাস জুড়ে দেয়া হত। সাধারন মহিলাদের ন্যুড ছবি আঁকা গর্হিত হিশাবে দেখা হত তখন। ম্যানেটের অলিম্পিয়া একজন সত্যিকার মহিলা, একজন প্রস্টিটিউটের ছবি, যা রেনেসা পিরিয়ডের পরে আঁকা হলেও ঐধরনের ছবি, ভেনাস অব আরবিনোর মতো; কিন্তু এটি অশ্লীল হিসবে বিতর্কিত হয়েছিল।  কারন এটি সত্যিকার একজন মহিলার ছবি, ও একজন প্রস্টিটিউটের ছবি। ভেনাসের নগ্ন ছবি কেন অশ্লীল হিসেবে গৃহীত হয়, বরং মাস্টারপিস হিসেবে গৃহীত হয়েছিল, কারণ সেটা দেবী ভেনাসের ছবি।

 

 

এবস্ট্র্যাক্ট ফেমিনিন সৌন্দর্য বনাম ফারটাইল ফেমিনিন সৌন্দর্য

বিবর্তনগত দিক থেকে কোন মহিলাকে বা মেয়েকে পুরুষের সুন্দর লাগে এই কারণে যে তার মনে হয় ঐ মহিলার দ্বারা সুস্থ সন্তান উৎপাদন সক্ষম। অভিজিত রায় তার ভালোবাসা কারে কয় লেখায় এই বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। চর্বিযুক্ত নিতম্ব, বড় স্তন, কালো চুল, বড় চোখ ইত্যাদির মাধ্যমে বুঝা যায় এই মেয়েটি সুস্থ সন্তান জন্ম দান এবং তার প্রতিপালন করতে পারবে। বড় নিতম্ব বুঝায় সে বিপদ এলে সন্তান নিয়ে দ্রুত পালিয়ে যেতে পারবে। আগেকার সমাজে, যখন পুরুষ শিকারের জন্য দীর্ঘদিন বাইরে থাকত তখন মহিলাদের সন্তান নিয়ে একা থাকতে হত বাসস্থানে। এই সময় অল্প খাদ্য তার কাছে থাকত, ফলে তার সন্তানসহ টিকে থাকার জন্য ঐ ধরনের শারিরীক গঠনের দরকার ছিল।

জিরো ফিগার হলে ঐ পরিস্থিতিতে তার পক্ষে ঠিকে থাকা সম্ভব হত না।

খ্রিস্টের জন্মের ২৫০০০ বছর আগের যে ভেনাসমূর্তি, তার গঠন ঐ ফার্টিলিটি, টিকে থাকা, মাতৃরূপ ইত্যাদির প্রতীক। এটাই তখনকার সৌন্দর্যের ধারণা। ইন্ডিয়ান ভাস্কর্য ইত্যাদি এরকম বাস্টি বা কার্ভি ফেমিনিন রূপ দেখা যায়। খাজোরাহু মন্দিরের গাত্রে যেসব খোদাই চিত্র আছে সেগুলাতে ঐসব নগ্ন মূর্তির যৌনরূপ অংকিত আছে। তার মানে ধরা যায় এই ধরনের শরীরই আকাঙ্খিত ছিল তখন। ওইটাই ছিল সৌন্দর্য।

প্রাচীন গ্রীসে সৌন্দর্য বিবর্তনগত দিক থেকে গনীতের দিকে যায়। গাণিতিক হিশাব হয়ে দাঁড়ায় সৌন্দর্যের ধারনার মূল। তখন সামাজিক পরিস্থিতিও অতটা দূর্যোগপূর্ন ছিল না। ফলে বড় স্তন, অতিভারী নিতম্বের প্রয়োজন শেষ হয়।

সৌন্দর্য তখন ফার্টিলিটি থেকে এবস্ট্র্যাক্টের দিকে যায়। এর ধারা আধুনিককালেও অব্যাহত আছে। ভাস্কর্য এবং আর্ট এবস্ট্র্যাক্ট হচ্ছে। সেই সাথে মহিলাদের সৌন্দর্যের ধারনায় আসছে চিকনতা।

জিরো ফিগার এখন সৌন্দর্য হিশেবে বিবেচীত হয়। এখন জিরো ফিগারের মাও অবলীলায় সন্তান টিকিয়ে রাখতে পারবেন, তার পর্যাপ্ত টাকা থাকলে। সামাজিক নিরাপত্তা এখন আছে, এবং নিরাপত্তার বড় অংশ টাকাতে স্থানান্তরিত হয়েছে। তবে এই জিরো ফিগার সৌন্দর্য ইত্যাদির ধারণা ব্যবসায়িক। এখন এখন রুচি নিয়ন্ত্রণের কেন্দ্রে ব্যবসায়ীক প্রতিষ্ঠানেরা। আধুনিক মুখরোচক ফাস্ট ফুড সংস্কৃতি মানুষকে চর্বিযুক্ত করে তুলবে এবং তারা আরো নানাবিদ পন্য, সেবা ব্যবহার করে নিজেদের কাঠামো ঠিক রাখতে চেষ্টা করবে, মেয়েরা সৌন্দর্যের জন্য জিরো ফিগারে যেতে চাইবে; এই হলো প্রকৃত দারুন বিজনেস মডেল। এরকম কোটি কোটি মানুষের একটা সিস্টেমে গড়ে উঠবে বিলিয়ন ডলারের ব্যবসা।

 

বাংলাদেশের নাটক পতনের কারণ

বাংলাদেশে একসময় জনপ্রিয় ছিল টেলিভিশন নাটক। কিন্তু একটা সময়ে এর জনপ্রিয়তা কমতে থাকে। দর্শক নাটক থেকে মুখ ফেরান। ধারণা করা হয়েছিল হয়ত অন্যান্য বিনোদন মাধ্যম এসে যাওয়ার কারণে এই অবস্থা। কিন্তু পরে দেখা গেল ভারতীয় বাংলা সিরিয়ালগুলো আসার পর সেগুলো বাংলাদেশে ভালো চলে। আগের যেসব নাটকের দর্শকেরা ছিলেন এদের এক বড় অংশই এগুলো দেখছেন। এর সাথে নতুন দর্শকও যোগ হচ্ছেন।

এটা থেকে স্পষ্ট বুঝা যায় অন্যান্য বিনোদন মাধ্যমের জন্য নাটকের দর্শক কমেনি। কমেছে অন্য কোন কারনে। এই কারন সম্পর্কে যে কথা বেশী বলা হয় তা হচ্ছে বিজ্ঞাপনের আধিক্য। ভারতীয় সিরিয়ালগুলোতে বিজ্ঞাপন কম থাকে। বাংলাদেশের টিভি নাটকে বিজ্ঞাপন বেশী দেখানো হয়, এটাকেই বলা হয়ে থাকে দর্শক হারানোর প্রধান কারন।

এখন কথা হলো, টিভি নাটকে দর্শক নাই, তাহলে বিজ্ঞাপন বাড়লো কেন?

এটা একটা যৌক্তিক প্রশ্ন। যেহেতু বিজ্ঞাপন দাতারা তাদের ভোক্তাদের টার্গেট করেই বিজ্ঞাপন দেখাবে।

এই প্রশ্নের উত্তরে যেতে হবে একটু পিছনে। তখন মোবাইল ফোন কোম্পানির বাণিজ্যের সময়। ফেইসবুক, ইন্টারনেট জনপ্রিয় হয় নি। মোবাইল ফোন কোম্পানিগুলো নানা ধরনের সিম, নানা ধরনের অফার আনল। রাত বারোটার পর থেকে কম পয়সায় কথা বলা ইত্যাদি। এগুলোর মূল টার্গেট ছিল তরুন তরুনীরা। এই তরুন তরুনীদের আবেগী প্রেম তারা বিজ্ঞাপনে ব্যবহার করত। তখন একটা ট্রেন্ডই তারা দাঁড় করাতে পেরেছিল এই ফোনে প্রেমালাপের। এই ধরনের বিজ্ঞাপন প্রচারের জন্য তাদের একটা মাধ্যমের প্রয়োজন ছিল। তারা বেছে নিয়েছিল টিভি নাটক। পুরনো যেসব নাটক হতো সেগুলোতে কিছু মধ্যবিত্ত ভ্যালু উপস্থিত থাকত। মোবাইল কোম্পানিগুলোর তখনকার বিজ্ঞাপন ঐসব নাটকের সাথে ঠিক যায় না, এবং এগুলো দেখে পরিবারের লোকজন। যারা তাদের টার্গেট ওডিয়েন্স না।

তারা তাদের টার্গেট ওডিয়েন্স তরুন সমাজকে সরাসরি যুক্ত করতে চাইল।

এজন্য তারা এমন নাটকে বিজ্ঞাপন দিতে শুরু করল যেগুলো তরুন তরুনীর প্রেম নির্ভর, রাত জেগে ফোনালাপ করা যার রোমান্টিকতা। যার নাম দেয়া যাক ডিজুস প্রেম। এই ডিজুস শব্দটি গ্রামীন ফোনের ডিজুস সীম থেকে নেয়া। ওইসময়ের ছেলেমেয়েদের নামই পড়ে গিয়েছিল ডিজুস জেনারেশন।

তরুণ নির্মাতারা আসতে থাকলেন মার্কেটে। নাটক পরিবার থেকে বের হতে শুরু করল। পাড়া মহল্লা হয়ে প্রাইভেট ভার্সিটি, ডেটিং ইত্যাদিতে চলে গেল। তরুন দর্শক আকৃষ্ট করতে ফাতরামি, প্রেম ইত্যাদি ভালোভাবে মিশিয়ে নির্মাতারা নাটক বানালেন। বিজ্ঞাপন চললো, নাটকও খুব চললো।  তরুন তরুনীদের কাছে তখন ফেইসবুক অত জনপ্রিয় হয় নি, ইন্টারনেট স্পিড নেই। তাই এই নাটকগুলো তারা দেখল। নাটকের একটা ক্রেজ তৈরি হল এদের মধ্যে। অবচেতনে তারা মোবাইল কোম্পানিগুলোর বিজ্ঞাপনের ফাঁদেও ধরা পড়ে গেল।

এই নাটকগুলাতে টি আরপি বেশী পাওয়া যেত। ফলে বিজ্ঞাপন দাতারা আরো আসতে লাগল। ফলে সমগ্র নাটকের দুনিয়ায় এইসব নাটক একচ্ছত্রভাবে বিরাজ করা শুরু করল।

এর মাঝে বদলে গেল দৃশ্যপট। ইন্টারনেট স্পিড ভালো হলো, ফেইসবুক হয়ে গেল অনেক জনপ্রিয়। তরুন দর্শকেরা ইন্টারনেট, বিনোদনের নয়া মাধ্যম পেয়ে টিভিতে নাটক দেখা ছেড়ে দিল।

তাদের রুচিও বদলে যেতে শুরু করলো কিছুটা।

এরমাঝে টিভি নাটকের জগতে পারিবারিক নাটকের শূন্যতা দেখা দিল। যেখানে এসে প্রবেশ করলো ভারতীয় বাংলা নাটকগুলো।

তাদের গ্রহণ করলেন পারিবারিক নাটক দেখার মূল মধ্যবিত্ত দর্শকেরা।

এভাবে বাংলাদেশের নাটক দর্শক হারালো। হারালো তার অবস্থান।

খেয়াল করলে দেখবেন মোবাইল কোম্পানির বিজ্ঞাপনগুলো, অফারগুলো তখন প্রেমভিত্তিক ছিল, এখন হয় বন্ধু-বান্ধব বা কখনো ফ্যামিলি ভিত্তিকও হয়। তাদের লুতুপুতু প্রেমবাণিজ্য এখন আগের মত নাই, অল্প ঠিকে আছে।

অবস্থার সুযোগে নিজেদের প্রয়োজনমত রুচি তৈরী এবং তা ব্যবহার করে এভাবে মুনাফা তৈরী করে কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান। এবং শেষপর্যন্ত তা সমাজের অনেক ক্ষতি করতে পারে।

 

উচ্চ ও নিম্নরুচি

গরীবের রুচি নাই এটা একটা বুর্জোয়া ক্যাপিটালিস্ট ধারনা। গরীবের রুচিবোধ আছে এবং তা বুর্জোয়াদের থেকে ভিন্ন হলে সেগুলো নিম্নরুচী হয় না। জহীর রায়হানের হাজার বছর ধরে উপন্যাসে এক গ্রামীন জীবনের চিত্র আঁকা আছে। সেখানে ঐসব মানুষদের রুচি, আচার, সংস্কৃতি ইত্যাদি আছে। এসব বুর্জোয়াদের সাথে, পশ্চিমা এনলাইটনমেন্টের সাথে না মেলার কারনে সেসব নিম্নরুচী নয়। শহীদুল জহিরের ভালোবাসা গল্পে দেখা যায় দিনমজুর হাফিজদ্দি একটা ফুল নিয়া ঘরে ফেরে একদিন। এটা বুর্জোয়া কালচার, দরিদ্র হাফিজদ্দি এবং তার বউ আবেদা এইসব দেখেছে বুর্জোয়া মিডিয়ায়। ফিল্মের নায়কদের মত হাফিজদ্দি বউয়ের চুলে ফুল গুঁজে দেয় না, আবেদার ইচ্ছা হইলেও এমন হবে এই দুঃসাহসিক চিন্তাও সে করে না। এই সংকোচ তাদের, সংকোচের ভেতরেও শহীদুল জহির ভালোবাসা দেখাইছেন, যখন হাফিজদ্দি বলে আবেদারে, “ফুলটারে তরে দিয়া দিলাম যা।”

এইগুলারে নিম্নরুচি বলে না। বা তাদের টোটাল জীবন যাপন, প্রেম ভাব ভালোবাসা; এসবে যে রুচি প্রতিভাত হয় তা কোন ক্রমেই নিম্নরুচি নয়।

বর্তমান বাংলাদেশে গ্রামীন সংস্কৃতিযুক্ত জায়গাতে বা অতি দরিদ্র বাদ দিলে গরীবের ঘরেও স্বমহিমায় বসবাস করেন টেলিভিশন। সেখানে যা প্রচারিত হয় তা এইসমস্ত মানুষের রুচি নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রেও ভূমিকা রাখে। বিজ্ঞাপন দাতারা তাদের ব্যবসায়ীক স্বার্থে নয়া রুচি তৈরীর প্রয়াস নেয়। এখন সবাই অর্থাৎ বুর্জোয়ারা এবং গরীবেরা একটি সামগ্রীক বুর্জোয়া কালচারের ভেতর এখন চলে আসছে। সামগ্রীক বুর্জোয়া কালচার ও মিডিয়ার রুচি নিয়ে কথা বলতে গেলে তাই স্বাভাবিক ভাবেই উচ্চ ও নিম্নরুচির কথা আসবে।

উচ্চ রুচি বলতে তাই, যা দেশের সমাজ সংস্কৃতি, সাহিত্য ও শিল্পের ঐতিহাসিক পরম্পরা মেনে আসে। যেগুলোতে কেবলই ব্যবসা উদ্দেশ্য নয়। যা সামাজিক রুচিকে উন্নত করে।

নিম্নরুচি সেগুলো যা কর্পোরেট স্বার্থে তৈরী হয় এবং সামাজিক রুচির অধঃপতন ঘটায়। এই সামাজিক রুচির অধঃপতন বুঝাচ্ছে রুচি ম্যানিপুলেশন। যেহেতু মিডিয়ার ভোক্তারা কর্পোরেটদের প্রোডাক্ট বা সার্ভিসেরও ভোক্তা, তাই তারা এই ম্যানিপুলেশন চালায়। যা কোন সমাজের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি এবং ভবিষ্যতের জন্য ক্ষতিকর।

Leave a Comment

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

×
গুরুত্বপূর্ণ
Scroll to Top
বই মডেলিং