এইটি হচ্ছে তুরস্কের ফিল্ম। একে বলা যায় আধুনিক জমানার এক ক্লাসিক। এর গল্প, নির্মান ও অভিনয় আমার খুবই ভালো লেগেছে। ভালো লাগা আপেক্ষিক ব্যাপার, ব্যক্তিবিশেষে তা ভিন্ন হয়। ফিল্মটি কারো কাছে স্লো মনে হতে পারে এবং কারো কাছে মনে হতে পারে দীর্ঘ এবং ড্রামাহীন।
এই ফিল্মের শুরু হয় এইভাবে যে, একজন প্রসিকিউটার, একজন ডাক্তার এবং কিছু পুলিশ, স্বীকারোক্তি লেখক ইত্যাদি মিলে দুজন অপরাধীকে নিয়ে গাড়িতে করে রওনা হন। তখন সময় রাত। গাড়িগুলি চলে আনাতোলিয়ার বিস্তৃর্ন প্রান্তরের ভেতর দিয়ে চলে যাওয়া রাস্তা দিয়ে। অপরাধীরা বলেছে তারা এদিকেই কোথাও একটা লোককে মেরে পুঁতে রেখেছে। এই মৃতদেহকে বের করতেই এই অভিযান।
গল্পের স্থান এবং আবহাওয়া অনিন্দ্য সুন্দর। এবং বিস্ময়কর সুন্দর হচ্ছে এর কথাবার্তা বা ডায়লগ। ফিল্মটিতে প্রচুর কথাবার্তা আছে। এই কথাবার্তাগুলির সূত্র থেকেই ফিল্মের গল্প পরিস্কার হতে থাকে ধীরে ধীরে। প্রায়ই মনে হয় যেন চরিত্রগুলি অকারণে কথা বলে যাচ্ছে। এই স্টাইলটি আমার পছন্দের। অকারণ কথা মনে হবে, কিন্তু এই দেখতে অকারণ কথাগুলিই ফিল্মের গল্প এগিয়ে নিয়ে চলবে।
ফিল্মটিতে যেভাবে চিত্রায়ন করা হয়েছে, দেখে মনে পড়ে তারকোভস্কির ফিল্মের কথা। বিশেষত স্টকারের কথা। আনাতোলিয়াতে একটি দৃশ্য আছে আপেল নিচে পড়ে গড়িয়ে যায় একটি ছড়ায়। পরিচালক সময় নিয়ে ব্যাপারটিকে দেখিয়েছেন। আহা! কী যেন গড়িয়ে পড়ে যায়, কী যেন পড়ে যায় এইভাবে। খুবই মূল্যবান কিছু মনে হয় আমাদের, জীবন বা সময়।
সমস্ত রাত ধরে মৃতদেহটির খোঁজ চলে। আনাতোলিয়ার বিস্তৃত প্রান্তরে। আর জনমানব নাই, নিস্তঃব্দতা এবং কয়েকটি গাড়িতে চড়ে এইসব লোকেরা খুঁজে চলে এক মৃতদেহ। অপরাধীরা যদিও স্বীকার করেছিল আগে কিন্তু তারা এখন ভিন্ন কথা বলে। পুলিশের অফিসার বিরক্ত হন।
এই পুরা রাতে তাদের এই খোঁজ সব মূল চরিত্রের অনুভূতিতে সরাসরি আঘাত হানে। দর্শকেরা দেখতে পাবেন, চরিত্রদের অনুভূতি দেখানো হয়েছে, দেখানো হয়েছে এই রাতের প্রভাব তাদের চিন্তার উপরে।
এই ফিল্মের পরিচালকের নাম নুরী বিলগে সিল্যান। পরিচালক কিছু কাব্যময় দৃশ্য উপহার দিয়েছেন, করতে চেয়েছেন কিছু গভীর অনুভবের কাব্যিক রূপায়ন। সেগুলি দর্শকদেরও স্পর্শ করতে স্বক্ষম।
পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন যে সাহিত্যকর্মটি, গিলগামেশের এপিক, তাতে গিলগামেশের মনে হয়েছিল, সে একদিন থাকবে না পৃথিবীতে, আর এই পৃথিবী রয়ে যাবে। এর জন্য সে ছুটেছিল অমরত্বের খোঁজে। আর আজ হাজার হাজার বছর পরেও এই একই অনুভূতি আমাদেরও নাড়া দেয়। রবীন্দ্রনাথ লিখেন সোনার তরী, যে কৃষককে রেখে তার গোলাভরা সোনার ধান নিয়ে যায়। রবীন্দ্রনাথ মহাকালের অমোঘ নিয়মের প্রতি ইঙ্গিত করেন। কবি জীবনানন্দ দাশ লিখেন ‘মনে হয় একদিন আকাশের’ ‘যে শালিখ মরে যায় কুয়াশায়’ ‘কোথাও চলিয়া যাবো একদিন’ বা ‘ঘুমায়ে পড়িব আমি একদিন তোমাদের নক্ষত্রের রাতে।’
ওয়ান্স আপন ইন আনাতোলিয়া বা একদা আনাতোলিয়াতে ফিল্মে একই ধরনের অনুভূতির দেখা মিলে আরব এবং ডাক্তারের কথাবার্তায়।
আরবঃ তারা আপনাকে ওভারটাইম পে করছে, তাই না ডাক্তার?
ডাক্তারঃ আমি জানি না। আশা করি তারা করবে।
আরবঃ তারা করবে। তাদের করা উচিত। টাকা ভালো যখন এর সাথে একটি মৃতদেহের সংযুক্তি আছে। টেভফিককে দেখুন। সে কোন অভারটাইম ছেড়ে দেয় না। এত এত অভারটাইম নিয়ে দেখা যায় হঠাৎ করে ওর বাড়িতে দোতলা উঠছে।
ইগদেবেলীতে দারুণ বৃষ্টি হচ্ছে, ডাক্তার। এখানেও শুরু হবে আপনি কিছু বুঝে উঠার আগেই। আমি এখানে প্রচুর আসি, ডাক্তার। জায়গাটা আমার প্রিয়। পিস্তলে ৪০ বা ৫০ রাউন্ড গুলি নিয়ে গাড়িতে উঠে পড়ি। তারপর এখানে এসে গুলি ছুঁড়ি। যদি কোন কিছু না পাই, তাহলে সোজা আকাশের দিকে। কীভাবে বলব, আসলে ব্যাপারটা হচ্ছে কারো ক্ষতি না করে নিজের ভেতরে রাগ, উদ্বেগ দূর করার এক উপায় এটা।
ডাক্তারঃ তোমার পিস্তল আছে?
আরবঃ এখানে কার নেই, ডাক্তার? পিস্তল ছাড়া আপনি এই কাজ করতে পারবেন না। ভালো মানুষ আছে, খারাপ মানুষ আছে। কিছুই বুঝে উঠা যায় না। যদি সময় আসে তাহলে আপনাকে হিংস্র হতেই হবে, এবং ওদের দুই চোখের মাঝখানে গুলি করতে হবে। এরকমই এখানে চলে, ডাক্তার। নিজের হাতে বিষয়টা নিয়ে নিতে আপনি এক প্রকার বাধ্য এখানে। আপনি যদি না পারেন তাহলে ওরা ঠিকই করে নেবে। আপনি বুঝতেও পারবেন না কীভাবে ঘটল। এটাই এখানকার নিয়ম। ওরা ব্যর্থ হবে না, ওদের বোকা বানানো যাবে না। ওরা চতুর বদমাশ। সবচেয়ে খারাপ জিনিস হল, তারা এমনভাবে ব্যাপারটা তৈরী করে যেন আপনি ওদের কাছে ঋণী। আমি জানি, আপনাকে বলছি, সবসময় বৃত্তে থাকতে হবে এবং কেন্দ্রে চোখ রাখতে হবে। হাতকড়া? হ্যাঁ, তা কাজ করে কিন্তু ঠিক সময় ও স্থানে কেবল। কিন্তু যখন আপনার দিকে আসবে, আপনাকেও ত্যাগের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।
আমরা কেউই চিরদিন বেঁচে থাকতে পারি না, পারি কি ডাক্তার? নবী সলোমন, ৭৫০ বছর পর্যন্ত বেঁচে ছিলেন। সম্পদ, ক্ষমতা…এবং শেষপর্যন্ত তাকেও মরতে হয়েছে। ঠিক না, ডাক্তার?
ডাক্তারঃ ইগদেবেলীতে বৃষ্টি হচ্ছে, হতে থাক। শত শত বছর ধরে এভাবে বৃষ্টি হয়ে আসছে তাতে কী আসে যায়? কিন্তু আজ থেকে একশো বছর পর, আরব… না তুমি…না আমি…প্রসিকিউটর বা পুলিশ অফিসার…
যাই হউক, কবি বলেছেন, ‘তবুও সময় বয়ে যাবে… রইবে না আমার চিহ্নমাত্র…। শীতলতা আর অন্ধকার ঘিরে ধরবে আমার ক্লান্ত হৃদয়…।’ তাই নয় কি, আরব?