শিক্ষা ব্যবস্থার বিমানবিকীকরণ প্রক্রিয়া

“A careful analysis of the teacher-student relationship at any level, inside or outside the school, reveals its fundamentally narrative character. This relationship involves a narrating Subject (the teacher) and patient, listening objects (the students). The contents, whether values or empirical dimensions of reality, tend in the process of being narrated to become lifeless and petrified. Education is suffering from narration sickness.”

পাওলো ফ্রেইরি তার অসাধারণ ইনফ্লুয়েনশিয়াল বই দ্য পেডাগোজি অব দ্য অপ্রেসড এর দ্বিতীয় চ্যাপ্টার শুরু করেছেন উল্লিখিত অনুচ্ছেদের মাধ্যমে। সাধারণ শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষক এবং তার ছাত্রছাত্রীর সম্পর্ক কেমন? শিক্ষক এখানে ন্যারেটর বা বর্ননাকারী। তিনি জ্ঞানের আধার। তিনি জ্ঞান দান করে যান। তিনি এই ব্যবস্থার সাবজেক্ট।

আর অবজেক্ট হচ্ছে ছাত্র ছাত্রী। তার জ্ঞান জমা হবার পাত্র যেন। শিক্ষকের দেয়া জ্ঞান তারা নিজেদের পাত্রে জমা করতে থাকে।

এই জমা করা এবং পাত্রে জমা হওয়াকে বিবেচনায় নিয়ে পাওলো ফ্রেইরি একে বলেছেন শিক্ষার ব্যাংকিং কনসেপ্ত। এখানে ডিপোজিটর শিক্ষকেরা, তারা জ্ঞান দেন, এবং জমা রাখার পাত্রগুলির ভিতরে তা জমা হতে থাকে।

কিন্তু যে বস্তু শিক্ষকেরা তার ছাত্র ছাত্রীদের দেন তা জ্ঞান হতে পারে না। কারণ জ্ঞান বা নলেজ এরকম কোন বস্তু নয়, জ্ঞান নিয়ত আবিষ্কার, পুনরাবিষ্কার, পৃথিবীব্যাপী, দুনিয়ার সাথে এবং অন্য মানুষের সাথে চলতে থাকা এক ক্লান্তিহীন অনুসন্ধান প্রক্রিয়ার ভিতর দিয়েই সামনে আসে কেবল।

“Knowledge emerges only through invention and re-invention, through the restless, impatient, continuing, hopeful inquiry human beings pursue in the world, with the world, and with each other.

In the banking concept of education, knowledge is a gift bestowed by those who consider themselves knowledgeable upon those whom they consider to know nothing. Projecting an absolute ignorance onto others, a characteristic of the ideology of oppression, negates education and knowledge as processes of inquiry.”

শিক্ষার ব্যাংকিং সিস্টেমে শিক্ষকেরা  নিজেদের জ্ঞানী মনে করেন। এবং তাদের বিপরীত অংশ এখানে ছাত্রছাত্রীরা, তাদের শিক্ষকেরা মনে করেন এরা জানে না কিছুই। এই জ্ঞানী শিক্ষকেরা না জানা ছাত্রছাত্রীদের উপর উপহার স্বরূপ জ্ঞান বর্ষণ করে যান।

শিক্ষার এই ব্যবস্থা শোষন বা নির্যাতনের মূল কনসেপ্টের সাথে যায়। যখন কোন এলিট গোষ্ঠী অন্য কোন দূর্বল লোকদের শোষন করতে যায় তখন তারা প্রথমেই ধরে নেয় এরা অসভ্য, এরা কিছু জানে না বা মূর্খ। উপনিবেশ স্থাপনকারী ইউরোপিয়ানরা এ দৃষ্টিতেই দেখেছিল ন্যাটিভদের।

সাধারণ শিক্ষা ব্যবস্থা যখন শোষনের মূলনীতি অনুসারে চলে, এবং জ্ঞান প্রকৃত অর্থে যা, (অনুসন্ধানের অবিরত প্রক্রিয়া) তা অস্বীকার করে, তখন সেই শিক্ষা ব্যবস্থা আসলে কী চায় তা দেখা দরকার।

ব্যাংকিং শিক্ষা ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্যগুলি দেখতে থাকলে দেখা যাবে এরা নির্যাতীতদের সামাজিক অবস্থাই যেন প্রকাশ করেঃ

১। শিক্ষক শিক্ষা দান করেন, ছাত্র ছাত্রীরা গ্রহণ করে।

২। শিক্ষক সব জানেন, ছাত্র ছাত্রীরা জানে না কিছুই।

৩। শিক্ষক চিন্তা করেন এবং ছাত্র ছাত্রীরা চিন্তার বিষয়।

৪। শিক্ষক বলেন এবং ছাত্র ছাত্রীরা শুনে- বা শোনার অভিনয় করে।

৫। শিক্ষক নিয়ম শৃঙ্খলা বানান, ছাত্র ছাত্রীরা তা মেনে চলে।

৬। শিক্ষক তার পছন্দ নির্বাচন করেন এবং প্রয়োগ করেন, ছাত্র ছাত্রীরা তা মেনে চলে।

৭। শিক্ষক মূল কাজ করেন এবং ছাত্র ছাত্রীরা এই বিভ্রান্তিতে থাকে যে তারাও শিক্ষকের কর্মের মাধ্যমে কাজ করছে।

৮। শিক্ষক বিষয়বস্তু নির্বাচন করেন, ছাত্র ছাত্রীরা তা মেনে চলে বা এর সাথে খাপ খাওয়ায়।

৯। শিক্ষক নিজের পেশাগত অথরিটি কাজে লাগিয়ে জ্ঞানের বিভ্রান্তি তৈরী করেন, এবং ছাত্র ছাত্রীদের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে একে দাঁড় করান।

১০। শিক্ষক এই শেখন পদ্বতির সাবজেক্ট, এবং ছাত্র ছাত্রীরা তুচ্ছ অবজেক্ট মাত্র।

ছবিঃ পাওলো ফ্রেইরি।

পাওলো ফ্রেইরি এই দশ বৈশিষ্ট্য তুলে ধরেছেন সাধারণ শিক্ষা ব্যবস্থার, যা অত্যাচারীর বা শোষনকারীর বৈশিষ্ট্যই প্রতিফলিত করে। এখানে ছাত্র ছাত্রীদের অবস্থা প্যাসিভ, যেমন নির্যাতীতদের অবস্থা হয়ে থাকে।

এই শিক্ষা ব্যবস্থা হচ্ছে ছাত্র ছাত্রীদের মানবিক স্বত্তা ধ্বংস করে মানুষ থেকে মেশিন বা মেকানিক্যাল বস্তুতে পরিণত করার ব্যবস্থা, বিমানবিকীকরণের একটি প্রক্রিয়া। মানুষের চিন্তা করার ক্ষমতা, মানুষের স্বাধীনতা এবং তার সামগ্রীক চেতনাকে ধ্বংস করার মহা আয়োজন। সমাজের এলিট শ্রেণী এভাবেই শিক্ষা ব্যবস্থা তৈরী করেছে যাতে সাধারণ মানুষ কখনো নিজেদের জন্মগতভাবে প্রাপ্ত অসাধারণ চিন্তা ক্ষমতা ব্যবহার করতে না পারে এবং নিয়ম নীতি ও এইসব ভ্রান্ত জ্ঞানের বিভ্রান্তিতে পড়ে ডসাইল বডি বা নতমস্তক বিনয়ীতে পরিণত হয়।

“Oppression—overwhelming control—is necrophilic; it is nourished by love of death, not life. The banking concept of education, which serves the interests of oppression, is also necrophilic. Based on a mechanistic, static, naturalistic, spatialized view of consciousness, it transforms students into receiving objects. It attempts to control thinking and action, leads women and men to adjust to the world, and inhibits their creative power.”

নত মস্তক বিনয়ী বা অতিমাত্রায় প্যাসিভ, কথায় কথায় উঠবস করা চিন্তাহীন জনসমষ্টি এলিটদের জন্য দরকারী, কারণ এদের শোষন করা সহজ। অত্যাচার বা শোষন একটি নেক্রোফিলিক ব্যাপার, তারা জনসমষ্টিকে মৃত বানাতে চায়, মৃতদের প্রতিই তাদের ভালোবাসা, জীবনের প্রতি নয়। একজন মৃত প্রতিবাদ করতে পারে না, চিন্তা করতে পারে না। মৃতকে নিয়ন্ত্রণ সহজ। সাধারণ শিক্ষা ব্যবস্থা তাই জীবিত ছাত্র ছাত্রীদের মানবিক প্রবৃত্তি (চিন্তা ক্ষমতা, চেতনা, স্বাধীনতা ইত্যাদি) হত্যা করে তাঁকে মৃততে পরিণত করে।

শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য হওয়া উচিত মানবিকীকরণ। মানুষের ভেতরে যেসব মানবিক প্রবৃত্তি আছে, তার চিন্তা ক্ষমতা, সৃষ্টিশীল কাজের ক্ষমতা, স্বাধীনতা এগুলিকে ব্যবহার করতে করতে সে যেন একটি প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে এগিয়ে যায়। এই শিক্ষা প্রক্রিয়ায় শিক্ষক এবং ছাত্রছাত্রীর মধ্যে সাবজেক্ট-অবজেক্ট এর বিভেদ থাকবে না। তারা উভয়ই থাকবেন এক্টিভ, উভয়ই সাবজেক্ট। ব্যাংকিং শিক্ষা ব্যবস্থার ডাইকোটোমি বা দ্বিভাগ করা পদ্বতি; এখানে হবে না।

“Through dialogue, the teacher-of-the-students and the students-of-the-teacher cease to exist and a new term emerges: teacher-student with students-teachers. The teacher is no longer merely the-one-who-teaches, but one who is himself taught in dialogue with the students, who in turn while being taught also teach. They become jointly responsible for a process in which all grow. In this process, arguments based on “authority” are no longer valid; in order to function, authority must be on the side of freedom, not against it. Here, no one teaches another, nor is anyone self-taught. People teach each other, mediated by the world, by the cognizable objects which in banking education are “owned” by the teacher.”

শিক্ষকের ছাত্রছাত্রী বা ছাত্রছাত্রীর শিক্ষক এই ধরনের সম্পর্ক থাকবে না, হবে ছাত্র-শিক্ষক, উভয়ই সবজেক্ট এমন সম্পর্ক। এখানে শিক্ষকই কেবল শিক্ষাদানকারী নন, তিনিও শেখার প্রক্রিয়ার সাথে যুক্ত এবং ছাত্র ছাত্রীদের সাথে কথাবার্তার মাধ্যমে শিখেন। তারা উভয়ই একটা প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে নিজেদের মানবিকীকরণ করতে থাকেন। এখানে অথরিটি’র (ডিগ্রী, শিক্ষকের পেশা) দোহাই দিয়ে কোন যুক্তি প্রতিষ্ঠার অবকাশ নেই, বরং সবসময় অথরিটিকে থাকতে হবে স্বাধীনতার (মানবিক চেতনা, চিন্তা ক্ষমতা, স্বাধীনতা) পক্ষে, বিরুদ্ধে নয়। এখানে কেউ কাউকে শেখান না, অথবা কেউ নিজে নিজেকে শেখান না। পৃথিবীর সাপেক্ষে বা সাহায্যে বা মধ্যস্থতায় এখানে লোকেরা একে অন্যকে শেখান। এ পারস্পারিক শেখন প্রক্রিয়ায় তারা জ্ঞানগম্য যেসব বস্তু ব্যবহার করেন তা ব্যাংকিং শিক্ষা ব্যবস্থায় কেবল শিক্ষকদের মালিকানায় থাকত।

 

উপসংহারঃ

পেডাগোজি শব্দের বাংলা অর্থ শিক্ষাবিজ্ঞান বা শিক্ষাদান। পেডাগোজি অব দ্য অপ্রেসড অর্থ নতুন ধরনের এক শিক্ষাদান পদ্বতি, যেখানে ভিন্ন ছাত্র-শিক্ষক-সমাজ সম্পর্ক তৈরী হবে। ক্রিটিক্যাল পেডাগোজি শিক্ষাব্যবস্থার চলমান ব্যাংকিং কনসেপ্ট এর বিরুদ্ধে। এটি মনে করে শিক্ষাদান এবং শিক্ষা ব্যবস্থা একটি রাজনৈতিক বিষয়, এবং জ্ঞান কখনোই নিরপেক্ষ কিছু নয়। সামাজিক ন্যায়বিচার, গণতন্ত্র ইত্যাদি বিষয়গুলিও শিক্ষাদান এবং শেখন পদ্বতির সাথে সম্পর্কিত বিষয়। ক্রিটিক্যাল পেডাগোজির মূলকথা হলো মানুষের ভেতর ক্রিটিক্যাল কনশাসনেস বা চিন্তা ক্ষমতা জাগ্রত করা, যাতে সে ক্রিটিক্যালি চিন্তা করতে পারে, এবং সমাজ নিয়ে ক্রিটিক করতে পারে, রাজনৈতিক ভাবে সক্রিয় হতে পারে শোষন-নির্যাতন দূরীকরণে।