নার্সিসাসের মন্দির এবং ওয়েট ট্রেইনিং
নার্সিসাসের জন্য যদি কোন মন্দির নির্মান করা যেত তাহলে তা কেমন হতো, এ নিয়ে ভাবি। আমার মতে, সে মন্দিরের ভেতরটা হতো আয়না নির্মিত, দেয়ালে দেয়ালে আয়না। যেদিকেই তাকাও কেবল স্বীয় মুখ ও শরীর দেখা যায়। নার্সিসাস এই মন্দিরে বসে থাকলে তার ভালো লাগত। হয়ত এটাই হতো তার বাসগৃহ। সব দিকে নিজেকে দেখতে দেখতে নার্সিসাস, আর বের হবার তাগিদই অনুভব করত না কখনো।
নার্সিসাসের মন্দিরের এই ধারনা মাথায় আসে জিমনেশিয়াম দেখে। জিমনেশিয়ামে সাধারণত অনেক আয়না থাকে দেয়ালে দেয়ালে। যারা জিম করেন, তারা ক্ষণে ক্ষণে সেই আয়নার দিকে তাকান এবং নিজেকে দেখেন। এদের মধ্যে অনেকে আছেন কেবল তন্ময় হয়ে নিজেকেই দেখেন। কোন একটা বারবেল নিয়ে হাতের মাসল ফুলাতে ফুলাতে সামনের আয়নায় ঐ মাসলের ফুটে উঠা প্রতিবিম্বতে তীক্ষ্ণ নজর রাখেন। বাড়ল কি না।
সবাই এরকম না অবশ্য। তবে সবাইই আয়নাতে দেখেন নিজেকে। ব্যায়াম করার সময়, পরে বা এমনিতেই। কারণ আয়নাই যেহেতু প্রায় সব দিকে।
‘সাধারনত’ তিন ধরনের মানুষ জিমে যান প্রধানত।
এক, যারা খুব হালকা বা ওয়েট কম। এরা যান বাল্কিং বা ওয়েট বাড়ানোর জন্য।
দুই, যাদের শরীরে বেশী চর্বি জমে গেছে। তারা চর্বি কমাতে যান প্রধানত।
তিন, যারা শারীরিক ভাবে দীর্ঘ বা বড় এবং শক্তিশালী। এরা সম্ভবত যান নিজেকে আরো শক্তিশালী করার জন্য।
ওয়েট ট্রেইনিং সহজ কথা নয়। তাই ফ্যাশনের জন্য হলেও ঐ বস্তু খুব কম লোকেই করে। বাজারে কোন ফ্যাশনের পণ্য আসলে তা কিনে পরা খুবই সহজ ব্যাপার, তাই ফ্যাশন হিসেবে এমন জিনিসই ভালো বাজার পায়। কিন্তু ওয়েট ট্রেইনিং নিয়মিত ভাবে প্রায় প্রতিদিন জিমে যাওয়া, শক্ত এক্সারসাইজ করা, আক্ষরিক অর্থেই মাথার ঘাম পায়ে ফেলা, ঠিকমতো খাবার গ্রহণ করা, ঠিকমতো ঘুমানো, নেশাদ্রব্য থেকে দূরে থাকা……মানে পুরো এক বিশাল ব্যাপার। তাও কয়দিন মেনে চললাম আর ছেড়ে দিলাম এমনও নয়। নিয়মিত ভাবে মেনে চলতে হয়, এটা যেহেতু লাইফস্টাইল।
ইতিহাসে জিম
জিম দর্শন নিয়ে ভাবার আগে ইতিহাসে বা প্রাচীন কালে লোকেরা কীভাবে জিম করতেন তা দেখার চেষ্টা করা যায়।
“তার অসাধারণ বাহুবলের একটি নযীর দেওয়া যাক। তিনি হিন্দুস্তানী দশ মন ওজনের বিশাল এক শিকল তৈরী করিয়েছিলেন। ইরাকী ওজনে যা হবে একশো মন। রোয সকাল বেলা ঐ শিকলটি তুলে নিয়ে বেড়াতেন। তাঁর অমন সহজ ঘোরাফেরা দেখে সবাই অবাক হয়ে যেত, কারণ বিশাল ঐ শিকল তোলার জন্য দরকার প্রচন্ড শক্তি।”
যার কথা বলা হচ্ছে তিনি মুগল সম্রাট আকবর। লিখেছেন তার ছেলে জাহাঙ্গীর বাদশা, নিজের আত্মজীবনীতে। বাংলা অনুবাদে বোরহানউদ্দীন খান জাহাঙ্গীর।
১ মনে ৩৭ দশমিক ৩২ কেজি হলে দশ মনে প্রায় ৩৭৩ দশমিক ২ কেজি। এত বেশী ওজনের বস্তু নিয়ে সম্রাট আকবর হাঁটাহাঁটি সত্যিই করতেন কি না, তা নিয়ে সন্দেহ থাকতে পারে। কিন্তু ওজনদার একটি ভারী শেকল নিয়ে প্রত্যহ সকালে তিনি এই যে চর্চা করতেন, এটা ছিল তার ব্যয়াম।
তবে ছয় শতকের গ্রীক এথলেট মিলো চার বছরের ষাঁড় কাঁধে নিয়ে অলিম্পিয়ায় স্টেডিয়াম প্রদক্ষিণ করেছিলেন বলে লিখে গেছেন থিওডোরাস। চার বছরের ষাঁড়ের ওজন বর্তমান হিসাবে প্রায় ৫০০-৯৯৭ কেজি হবে। আধুনিক কালে এত ভারী বস্তু নিয়ে হাঁটাহাঁটির যে রেকর্ডটি আছে তা হলো জর্মন এইচ গর্নর ৩ জুন ১৯২১ সালে ৬৫৪ কেজির একটি পিয়ানো নিয়ে অল্প দূর হেঁটেছিলেন।
প্রাচীন গ্রীক এথলেট মিলো যে ষাঁড়টি তুলেছিলেন কাঁধে সেটি যখন বাচ্চা ছিল তখন থেকেই তিনি ওটাকে কাঁধে নিয়ে ব্যায়াম করতেন। এভাবে ধীরে ধীরে ওয়েট বাড়তে বাড়তে তিনি চার বছরের ষাঁড়টি নিতে সক্ষম হন। আধুনিক ওয়েট ট্রেইনিং এও এই বিষয়টি মানা হয়, ধীরে ধীরে ওয়েট বাড়ানো।
এখানে একটা বিষয় বুঝার মতো যে মিলো চার বছরের ষাঁড়টি নিয়ে যে হেঁটেছিলেন তা ওয়েট লিফটিং। আর বাচ্চা ষাঁড়টি নিয়ে প্রতিদিন তিনি যে কাঁধে তুলে ব্যায়াম করতেন তা ওয়েট ট্রেইনিং। অনেক সময় অনেকে এই দুই শব্দ একই অর্থে ব্যবহার করে থাকেন।
একবার বিখ্যাত মিলো টিটোরমাস নামের এক শেফার্ডকে ওয়েট লিফটিং এ চ্যালেঞ্জ করে বসলেন। বিশাল এক পাথর ছিল, মিলো তা সরাইতেই পারলেন না। কিন্তু টিটোরমাস তা প্রথমে হাঁটু পর্যন্ত তুললেন, এরপর কাঁধে নিলেন, নিয়ে ১৫ সেন্টিমিটার এগিয়ে গেলেন, ও ছুঁড়ে ফেলে দিলেন! মিলো অভিভূত হয়ে বিজয়ী টিটোরমাসকে বলেছিলেন, দ্বিতীয় হারকিউলিস।
ওয়েটলিফটিং ইন এন্টিকুইটিঃ এচিভম্যান্ট এন্ড ট্রেইনিং নাইজেল বি ক্রোথারের গবেষনা প্রবন্ধ, সেখান থেকেই এই ঐতিহসিক তথ্যগুলি নেয়া।
জিমের দর্শন
জিমের বা ওয়েট ট্রেইনিং এর দর্শন তৈরী করতে আমরা সিধা প্রশ্নই করতে পারি যে সক্রেটিস কি জিম করতেন? যেহেতু সক্রেটিসই আমাদের কাছে মহাশক্তিধর ফিলোসফার, তাই তাকে দার্শনিকদের প্রতিনিধি হিসেবে নেয়া ভালো। সক্রেটিস যদিও যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন, কিন্তু তিনি ওয়েট ট্রেইনিং করতেন এমন জানা যায় না।
সক্রেটিসের একজন শিষ্য জেনোফ্যানের পুস্তক মেমোরোবিলিয়াতে সক্রেটিস এর কিছু বক্তব্য পাওয়া যায় ফিটনেস নিয়ে। সক্রেটিস সম্পর্কে জানার তিন মৌলিক উৎসের একটি জেনোফ্যানের লেখা।
মেমোরোবিলিয়াতে আছে, সক্রেটিসের এপিজেনিস নামে এক যুবকের সাথে সাক্ষাত, যে বেশ স্থুল হয়ে উঠেছে।
সক্রেটিস বলেন, “এপিজেনিস, মনে হচ্ছে তোমার ব্যয়াম করা দরকার।”
এপিজেনিস উত্তরে জানায়, আমি এথলেট নই।
তখন সক্রেটিস তার বক্তব্য পেশ করেন, ভালো স্বাস্থ্যের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে। সেখানে শেষ পর্যায়ে তিনি বলেন, এটা দূর্ভাগ্য যখন কেউ যখন বুড়ো হয়ে গেল না দেখেই তা শরীরের শক্তি, সৌন্দর্য!
“No man has the right to be an amateur in the matter of physical training. It is a shame for a man to grow old without seeing the beauty and strength of which his body is capable.”
ফিলোসফিতে ‘কিন্তু’ থাকে, তাই সক্রেটিসের উপরিউক্ত বক্তব্যটিতেও কিন্তু আছে। তিনি কোন প্রেক্ষাপটে এপিজেনিসকে স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য, ফিট থাকার জন্য উপদেশ দিলেন? যদিও সেই সময়ে শারীরিক সৌন্দর্য গুরুত্বপূর্ন হিসেবেই দেখা হত কিন্তু সক্রেটিসের এই বক্তব্যের পিছনে শারীরিক সৌন্দর্য প্রধান ছিল না।
সক্রেটিসের পুরো বক্তব্যে এটা উল্লেখ ছিল যে আর্মিতে ট্রেইনিং দেয়া হয় না, তাই প্রত্যেক যুবকের উচিত ব্যয়াম করে নিজেকে ফিট রাখা যাতে স্টেইট আক্রান্ত হলে সে যুদ্ধ করে বাঁচাতে পারে।
তখনকার এথেন্সের আর্মিতে ট্রেইনিং দেয়া হত না। আর এক শ্রেনীর ধনী ছিল অলস। এরা শহর বাঁচানোর জন্য যে তাদের লড়তে হবে, এই সত্য অবহেলা করে আরাম আয়েসে ভেসে গিয়ে বেঢপ সাইজের হয়ে বসে থাকত। জেনোফ্যান নিজে সৈনিক ছিলেন। তিনি তীব্রভাবে অপছন্দ করতেন এমন জিনিস। তাই হয়ত গুরুর মুখ দিয়ে এ সম্পর্কে কিছু কড়া কথা শুনিয়ে দিলেন। সক্রেটিসের আরেক শিষ্য প্লেটোর মতো জেনোফ্যানও আর্মিতে ট্রেইনিং ব্যবস্থা চালু ও জোরদার করার পক্ষে ছিলেন।
সক্রেটিসের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ন শিষ্য এবং বৃহৎ দার্শনিক প্লেটোও ছিলেন ফিজিক্যাল ট্রেইনিং এর পক্ষে। তিনি রিপাবলিকে এ সম্পর্কে তার মত জানানঃ
আলস্য এবং ঝিমানি মানুষের ভালো অবস্থা (শারীরিক ও মানসিক) নাশ করে, আর চলাফেরা ও নিয়মাবদ্ধ এক্সারসাইজ (বা ওয়েইট ট্রেইনিং) তা ধরে রাখে ও সংরক্ষণ করে।
“Lack of activity destroys the good condition of every human being, while movement and methodical physical exercise save it and preserve it.”
সক্রেটিসের এবং সিনিকদের প্রভাবে সমৃদ্ধ হওয়া আরেকটি প্রাচীন দার্শনিক ধারার নাম স্টোয়িসিজম। স্টোয়িকদের একটি মূলকথা কী নিজের নিয়ন্ত্রণে আছে এবং কী নিজের নিয়ন্ত্রণে নেই তা বুঝতে পারা। নিজের নিয়ন্ত্রণে মোটামোটি থাকে একজনের বডি এবং মাইন্ড।
মোটামোটি বললাম, কারণ বিজ্ঞানের আধুনিক গবেষনা দেখাচ্ছে বডি এবং মাইন্ডও পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে নেই। কিন্তু এর বড় অংশ নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা অন্তত একজন করতে পারেন।
মাইন্ডের জন্য কী দরকার? মাইন্ড পরিপুষ্ট ও শার্প করার জন্য আছে ভালো বই।
এবং বডির জন্য, অবশ্যই এক্সারসাইজ।
একজন যখন এক্সারসাইজ করার জন্য একটা নির্দিষ্ট সময়ে জিমে যাবেন প্রতিদিন, তার নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ অনেকটাই বেড়ে যায়। কারণ প্রতিদিনই জিমে যাবার মুহুর্তে তার মনে হবে আজ না যাই। এই বিরুদ্ধ প্রবণতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেই তাকে যেতে হয়। স্বয়ং বক্সার মোহাম্মদ আলীও নিজে স্বীকার করেছেন প্র্যাক্টিসের কালে তার মনে হতো আজ বাদ দেই।
স্টোয়িক দৃষ্টিকোন থেকে দেখলে, এই এক্সারসাইজে বিউটি গুরুত্বপূর্ন নয়, একটি আউটকাম। স্টোয়িকেরা ভার্চ্যুকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন হিসেবে দেখেন, এবং অতি অবশ্যই ভার্চ্যু অধিক গুরুত্বপূর্ন। নিয়মিত ওয়েট ট্রেইনিং এই ভার্চ্যু উন্নয়নে সরাসরি প্রভাব ফেলে।
দার্শনিক জিন জ্যাক রুশো* শিশুদের স্কুলে জিমনেশিয়াম রাখার জন্য বলেছিলেন, কেবল রোবাস্ট এবং হেলদি শারীরিক অবস্থার জন্য নয়, বাচ্চাদের নৈতিক সমৃদ্ধির জন্যও।
*জিন জ্যাক রুশো ইচ্ছা করেই বলেছি। জঁ-জাক রুশো বলি নি।
*জিম ওয়েট ট্রেনিং অর্থে ব্যবহার করেছি, যেহেতু এটাই প্রচলিত।
*ফিলোসোফিক্যাল পয়েন্ট থেকে নার্সিসাসকে আনা হয়েছে। নার্সিসিস্টিক পার্সোনালিটি ডিজওর্ডার নয়।
*এটা আরো কয়েক পর্বে লেখব।