জিজেকঃ
রেসিজম নিয়ে পলিটিক্যাল কারেক্টনেসের চর্চার কথা বলতে গিয়ে স্লোভানিয়ান সাইকোএনালিটিক দার্শনিক স্ল্যাভো জিজেক নিজের জীবন থেকে উদাহরণ দিয়ে বললেন এক্স-যুগোস্ল্যাভিয়ায় (অর্থাৎ যখন স্লোভেনিয়া, ক্রোয়েশিয়া, বসনিয়া-হারজেগোভিনা, সার্বিয়া, মন্টেনিগ্রো, মেসিডোনিয়া একত্রে সোশ্যালিস্ট স্টেইটের মধ্যে ছিল) যখন তারা বিভিন্ন জাতির লোক যেমন বসিনিয়ান, ক্রোটস, সার্বিয়ান ইত্যাদি মিলিত হতেন তখন তার নিজেদের নিয়ে ডার্টি জোকস বলতেন। একে অন্যের বিরুদ্ধে না, নিজেরা নিজেদের নিয়ে। তারা এভাবে মজা করতেন। এটা খুব স্বাভাবিক ছিল। এর মাধ্যমে তাদের নিজেদের মধ্যে একটা বন্ধন তৈরী হয়ে যেত।
কিন্তু যুগোস্ল্যাভিয়ায় জাতিগত বিদ্বেষ, গৃহযুদ্ধ ইত্যাদি শুরু হলে ৯০ দশকের শুরুর দিকে, তখন এই জোকসগুলো ভ্যানিশ হয়ে যেতে শুরু করল। জিজেকের মতে পলিটিক্যাল কারেক্টনেসে সমস্যা এখানে। তিনি বলেন পলিটিক্যাল কারেক্টনেসের বদৌলতে এরকম নিজেদের নিয়ে ডার্টি জোকস বলার মত সুযোগ থাকে না। ওপেন রেসিজমের চেয়ে ভালো হলেও এটা রেসিজমকে দূর করার পরিবর্তে মানুষে মানুষে দূরত্ব রেখে সেন্সরশীপের মাধ্যমে রেসিজম কন্ট্রোল করার চেষ্টা করে। তার মতে পলিটিক্যাল কারেক্টনেস ঘৃণাকে দূর করার পরিবর্তে ঘনীভূত করে।
Slavoj Žižek: Political Correctness is a More Dangerous Form of Totalitarianism
জসীমঃ
কবি জসীম উদ্দীনের আত্মজীবনী “জীবন কথা”তে এরকম একটি ঘটনার উল্লেখ পাওয়া যায়। বইটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ১৫ই মে ১৯৬৪ সালে। “চৈত্র-পূজা” নামক প্রবন্ধে তিনি তার গ্রামের বাড়ির পাশে শোভারামপুর গ্রামে হিন্দুরা চৈত্র পূজা করত তার বর্ননা দিয়েছেন। চৈত্র সংক্রান্তির দিন মেলা বসত।
অভিনেতা অভিনেত্রীরা বিভিন্ন চরিত্রে কৌতুকাভিনয় করে দর্শকদের আনন্দ দিতেন। কেউ ভন্ড মোল্লার পাঠে অভিনয় করতেন। সেখানে আজানের সুরে সুরে মোল্লা চরিত্রে অভিনয়কারী ব্যক্তি তার অভিনয় শুরু করতেন। কিন্তু উপস্থিত মুসলমানরা তাতে বিক্ষুব্ধ হত না। জুলফক্কর মৃধা নামে এক লোক যাত্রা দলে ভন্ড ব্রাহ্মনের পাঠে অভিনয় করে লোকদের আনন্দ দিতেন। সেই দর্শকদের মধ্যে সমাজের বড় ব্রাহ্মনরা উপস্থিত থাকলেও তারা ক্ষুব্ধ হতেন না।
যে সময়কালের কথা লিখেছেন কবি তা সম্ভবত ১৯০৮-১৯৩০ হবে। তখন কবির বয়স ৫ থেকে ২৭ বছরের মধ্যে হবে। অর্থাৎ ১৯৪৬ এর ধর্মীয় দাঙ্গার পূর্ববর্তী সময়।
কবি যখন বইটি লিখেন অর্থাৎ প্রকাশ হওয়ার সালটাকে ধরলে ১৯৬৪ তে বলেছেন সেই উদার সাম্প্রদায়িক অবস্থা আর নেই।
শ্রীযুক্ত বাবুমন্ডলীঃ
আমি পলিটিক্যাল কারেক্টনেস চর্চার কিছু অসাধারণ উদাহরণ পেয়েছিলাম যখন বাংলাদেশের বিখ্যাত রাজনীতিবিদ সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত মারা গেলেন তার পরে। কিছু লোক আপত্তি জানিয়েছিলেন তাকে “বাবু” বলা নিয়ে। অর্থাৎ, অন্যরা বাবু সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলছিলো এতে তাদের তীব্র আপত্তি। এটা নাকী সাম্প্রদায়িক ডাক!
কিন্তু এটি খুবই স্বাভাবিক সম্বোধন। আমি কলকাতার মানুষকেও দেখেছি বাবু সম্বোধন করতে লেখায়। এমনকী আমাকেও অনেকে মুরাদুল বাবু বলেছেন। বাংলা অভিধানে বাবুকে বলা হয়েছে সম্ভ্রমসূচক শব্দ।
আবার আরেক ধরনের প্রচারণা দেখলাম “শ্রী” শব্দ নিয়ে। অভিধানে যা শ্রদ্ধাসূচক শব্দ হিসেবে অভিধা পেয়েছে। এখানের আপত্তিকারকদের বাংলাসাহিত্যে মুসলমান লেখকদের নামের আগে শ্রী লাগানোতে তাদের আপত্তি। তারা পূর্বেকার মুসলমান লেখকদের নামের আগে কলকাতার সাহিত্যিকেরা শ্রী লাগাতেন, একে সাম্প্রদায়িকতা হিসেবে অভিহিত করেন!
উল্লেখ্য, আমার নামের আগেও শ্রী ব্যবহার হতে দেখেছি, এবং তাকে আমি শ্রদ্ধাসূচক শব্দ হিসেবেই নিয়েছিলাম। এবং এতে সাম্প্রদায়িকতা থাকতে পারে এ চিন্তা কখনো আমার আসে নি তখন।
“শ্রী” এবং “বাবু” এই দুটি নিরীহ শ্রদ্ধাবাচক শব্দ আমাদের শিক্ষিত পলিটিক্যাল কারেক্টনেস চর্চাকারীদের অতি উৎসাহে কেমন ভিলেনাইজ হচ্ছে তা রীতিমত আতংকজনক। গ্রামের সাধারণ মানুষেরা বা অশিক্ষিত মানুষেরা কিন্তু এই কাজ করছে না। করছে কিছু তথাকথিত শিক্ষিত নামধারীরা, এবং এদের অনেকে আবার নিজেদের প্রগ্রতিশীল ও উদার বলে মনে করে। এটা আরেক মর্মান্তিক বিষয়।
এদের এই চর্চা সমাজকে আরো প্রতিক্রিয়াশীলতা দিকে নিয়ে যাবে। এইসব অহেতুক এবং মূর্খ পলিটিক্যাল কারেক্টনেস চর্চাকারীদের নাম দেয়া যাক শ্রীযুক্ত বাবুমন্ডলী।
সমাজ ও ফেইসবুক সমাজ বুঝাঃ
সমাজবিজ্ঞানীরা সমাজকে দুইভাবে ব্যাখ্যা করেন। এক হচ্ছে কম্যুনিটি, আর দুই সোসাইটি। সোসাইটিতে কেউ কাউকে চিনে না, আত্মিক যোগাযোগ নেই। এখানে অন্যের খুঁত ধরা হয়, সমালোচনা করা হয়। একজনের দুঃখে অন্যজন বেদনার্ত হয় না। অন্যের রাজনৈতিক বা সামাজিক বিপদে মশকরা করা চলে।
কিন্তু কম্যুনিটির চিত্র ভিন্ন। সেখানে একজনের বিপদে অন্যেরা ঝাঁপিয়ে পড়ে। কারো বাড়িতে আগুন লাগলে সবাই পানি নিয়ে দৌড়ায়। কারণ তারা জানে আগুন না নেভানো গেলে সবার ঘরই পুড়ে যাবে। তারা একে অন্যকে সাহায্য সহযোগীতা করে বিপদে আপদে। এইভাবে সেই সমাজ টিকে থাকে।
কম্যুনিটিতে ঝামেলা হতে পারে। কিন্তু তা মিটে যায়। কারণ একসাথে থাকতে হবে।
সোশ্যাল মিডিয়া তথা ফেইসবুকের যে সমাজ তা হলো সোসাইটি মূলক। তাই এখানে “বাবু” বা “শ্রী” এর মত নিরীহ শ্রদ্ধামূলক শব্দকে ভিলেন বানানো হয়। এখানে ভিন্নমতের কেউ একজন অপহৃত বা আততায়ীর হাতে নিহত হলে উল্লাস প্রকাশ করতে লোকের বাঁধে না।
উপসংহার বা আশঙ্কাঃ
সুধীর চক্রবর্তীর লোকসমাজ ও লোকচিত্র বইতে আছে হিন্দু মুসলমান সম্প্রীতির কথা বলতে কিছু লোক গেছে গ্রামে। গিয়ে জিজ্ঞেস করছে, তোমরা কেমন আছো? গ্রামের লোকেরা জানায়, আমরা ভালো আছি। আমাদের সমস্যা নেই। সমস্যা তো শহরে। কিন্তু আপনারা যে সম্প্রীতি সম্প্রীতি করে কীসব বলতে আসেন মাঝে মাঝে ওই সম্প্রীতির হাত থেকে আমাদের বাঁচান।
বর্তমানে এক প্রকট সমস্যা হচ্ছে এই ফেইসবুক সোসাইটি কম্যুনিটিগুলিতেও পৌছে যাচ্ছে। অর্থাৎ, গ্রামের লোকদের মোবাইলেও আজ ফেইসবুক। কোকেন যেমন ডোপামিন মস্তিষ্কে নিষ্ক্রমণের মাধ্যমে আমাদের আনন্দ দেয়, তেমনি ফেইসবুক আসক্তির মূলেও এই ডোপামিন। ফলে এই আসক্তি শক্ত আসক্তি। গ্রামের লোকেরাও এতে মজে যাচ্ছে। এবং এর মাধ্যমে ফেইসবুক সোসাইটির ধারনাগুলি, পলিটিক্যালি কারেক্ট সমালোচনাগুলি তাদের মধ্যে যাচ্ছে। ফলে তারা তাদের কম্যুনিটিতেও দেখতে পাচ্ছে সাম্প্রদায়িকতা। বা আগে যে জিনিস ছিল সাধারণ সেই জিনিসই তাদের কাছে হয়ে উঠছে সাম্প্রদায়িক আক্রমণ। দূরত্ব বাড়ছে, জমা হচ্ছে ঘৃণার বাষ্প।