মেধাতন্ত্রের সমস্যা
আমাদের সমাজে এমন ধারনা আছে যে মেধাবীদের সুযোগ দিতে হবে। মেধাবীদের সুযোগ দিলেই সামাজিক দুর্নীতিসহ অনেক সমস্যার সমাধান হবে মনে করা হয়। এই মেধাবীদের সুযোগ দান বা মেধাতন্ত্রের আগের অবস্থা অভিজাততন্ত্র। যখন অভিজাতেরা বা অভিজাতদের সন্তানেরা সমস্ত সুযোগ সুবিধা ভোগ করত, সামাজিক ক্ষমতার জায়গাগুলিতে অবস্থান করত তারা। ফলে, মেধাবীদের সুযোগ দান মানে অপেক্ষাকৃত গণতান্ত্রিক বা উদার মনে হয় শুনতে।
কিন্তু সমাজে অভিজাতদের বা টাকাওয়ালাদের বেশী সুযোগ পাওয়া যেমন ন্যায্য নয় তেমনি মেধাবীদের বেশী সুযোগ দানও ন্যায় হয় না। এই তিন বস্তু প্রায় একই বস্তু, কোনটা বেশী খারাপ আর কোনটা কম খারাপ। নীতির বিচারে অভিজাততন্ত্র যেমন দুর্নীতি, টাকাওয়ালাদের বেশী সুযোগ যেমন দুর্নীতি, মেধাবীদের বেশী সুযোগ দানও একধনের অন্যায় ব্যবস্থা।
মেধা জিনিসটা হচ্ছে, বুদ্ধিমত্তা, আইকিউ, পরিশ্রম বা ইফোর্ট দানের ক্ষমতা ইত্যাদি। কিন্তু এগুলি একজন মানুষ কীভাবে অর্জন করে জানতে গিয়ে বিজ্ঞানীরা এ সংস্লিষ্ট গবেষনায় যা পেয়েছেনঃ
১। বুদ্ধিমত্তা পরিমাপ করা যায় (মোটামোটি ভাবে হলেও)।
২। বুদ্ধিমত্তা বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া ( বেশীরভাগ ডিএনএ দ্বারা নির্ধারীত হয়।)
৩। বুদ্ধিমত্তা খুবই পলিজেনিক ( অর্থাৎ প্রচুর জেনেটিক বিষয় দ্বারা প্রভাবিত, অল্প অল্প)।
৭৮,৩০৮ জন ব্যক্তির ডেটা পর্যবেক্ষণ করে বিজ্ঞানীরা এইসব সিদ্ধান্তে আসেন, প্রবন্ধটি নেচার জেনেটিকস জার্নালে প্রকাশিত হয়।
মেধাতন্ত্রে মেধা অনুসারে সুযোগ দেয়া হয় কিন্তু কোন ব্যক্তির এই মেধা পাওয়া না পাওয়া বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই প্রাকৃতিক ব্যাপার। কারণ এটি জন্মসূত্রে পাওয়া। ফলে মেধাতান্ত্রিক সমাজের সফল ব্যক্তি জন্মসূত্রে প্রাপ্ত উপহারের জন্যই পুরস্কৃত হয়। এজন্য জন রল এর মত পলিটিক্যাল দার্শনিক মেধাতন্ত্রকে অভিজাততন্ত্রের চাইতে ন্যায্যতর ব্যবস্থা মনে করেন না।
জেনেটিক্যালি প্রাপ্ত গুণের পরে আসে সেই গুণ বিকাশের পরিবেশ ও খাদ্য পুষ্ঠি ইত্যাদির কথা। একশোভাগ মেধাতান্ত্রিক সমাজ বানানোর জন্য সবার জন্য সমান সুযোগের ব্যবস্থা করতে হবে। তা করতে হলে, জন্মের পর পরই বাচ্চাদের নিয়ে গিয়ে একই ধরনের সমাজে বড় করতে হবে যাতে তাদের মস্তিষ্ক বিকাশের জন্য একই পরিবেশ পায়। তারা একই ধরনের খাবার, সাংস্কৃতিক আবহ ইত্যাদি পায়। কিন্তু তা কি করা যাবে মেধাতান্ত্রিক সমাজে? যদি না করা হয়, তাহলে তো অভিজাততন্ত্রের মত কিছু ভাগ্যবানেরাই মেধাবী হবে ও সমাজের সব হালুয়া রুটি খেয়ে নিবে।
মেধাতন্ত্র সমাজকে নিয়ে যায় জেনেটিক এক বর্ণবাদী সমাজের দিকে, পলিটিক্যাল সাইন্টিস্ট চার্লস মারে এমনই বলেন। জেনেটিক ভ্যারিয়েন্সের কারণে অল্প বা মাঝারি বুদ্ধিমত্তার লোকদের ঘরে উচ বুদ্ধিমত্তার সন্তানও কখনো জন্ম নিতে পারে, এটা ঠিক আছে। কিন্তু সাধারণত মেধাতান্ত্রিক সমাজে যারা মেধার জোরে এলিট হয়ে বসবে, তাদের সন্তানেরা গড়ে ভালো বুদ্ধিমত্তার হবে। তারা মেধা বিকাশের পর্যাপ্ত সুযোগ পাবে বাবা-মায়ের ভালো আর্থ-সামাজিক অবস্থানের কারণে। খাবার ও অন্যান্য সুবিধার জন্য মেধাভিত্তিক প্রতিযোগীতায় তারা কম্পিটিটিভ এডভান্টেজ পাবে।
পঞ্চাশ বছর ধরে স্ট্যানফোর্ডের সাইকোলজিস্টেরা একটি রিসার্চ করেছিলেন, যা থেকে তারা জানতে পেরেছেন যে, আর্থ-সামাজিক ধনী পরিবারের ১৮ মাসের বাচ্চা ঠিক বস্তু চিহ্নিত করতে সময় নেয় ৭৫০ মিলিসেকন্ড। অন্যদিকে ১৮ মাসের গরীব পরিবারের সন্তান ঠিক বস্তু চিহ্নিত করতে আরো ২০০ মিলিসেকেন্ড বেশী নেয়। এই ২০০ মিলসেকন্ড মেন্টাল প্রসেসিং স্পিডের ক্ষেত্রে বিশাল ব্যবধান। গরীবের বাচ্চারা প্রায় ত্রিশ ভাগ কম শব্দ শিখে ১৮ থেকে ২৪ মাসের ধনীদের বাচ্চার চাইতে। দুই বছর বয়েসেই ভাষা শেখার ক্ষেত্রে গরীবের সন্তান ধনীর সন্তানের চেয়ে ছয় মাস পিছনে পড়ে যায়। এই জিনিসটা তার বুদ্ধিবৃত্তি ও মেধায় মারাত্মক প্রভাব ফেলে।
গবেষক-বিজ্ঞানীরা এ পর্যন্ত আমাজন জঙ্গলে ১৬০০০ ভিন্ন ভিন্ন প্রজাতির গাছ শনাক্ত করেছেন। এত বিশাল সংখ্যক বৃক্ষ প্রজাতির মধ্যে মাত্র ২২৭ টি প্রজাতির গাছই আমাজনে প্রবল। তারা প্রায় ৫০ ভাগ দখল করে আছে। হিসাব করলে দাঁড়ায়, ১.৪ ভাগ প্রজাতির গাছ ৫০ ভাগ জায়গা দখল করে আছে।
যে প্রক্রিয়ায় এটা হয় তা খুবই সরল ও সহজবোধ্য। ধরা যাক দুই প্রজাতির ভিন্ন গাছ পাশাপাশি জন্মেছে আমাজন রেইন ফরেস্টে। তারা সূর্যের আলো, পানি, পুষ্টি ইত্যাদির জন্য পরস্পরের সাথে প্রতিযোগীতায় লিপ্ত হবে। এখন একটি গাছ যদি সামান্য জেনেটিক কারণে একটু বেশী বেড়ে উঠে তাহলে সে বেশী সূর্যের আলো পাবে। এই বেশী আলো পাওয়া তাকে আরো বেশী বাড়তে সাহায্য করবে। এভাবে প্রতিদিন একটু একটু করে সুবিধা পেয়ে সে তার পাশের গাছটিকে অনেক ছাড়িয়ে যাবে কিছু বছরে। সে তার বীজ ছড়িয়ে দেবার বেশী সুযোগ পাবে। পরবর্তীতে তার বংশধরেরাও এই বেড়ে উঠার ক্ষমতা পাবে জন্মগতভাবে। এবং প্রজাতি হিসেবে তারা এগিয়ে যাবে।
বিজ্ঞানীরা এর নাম দিয়েছেন একুমিউলেটিভ এডভান্টেজ। একটি গাছের শুরুর দিকে সামান্য সুবিধার দরকার হয় পাশেরটাকে ছাড়িয়ে যেতে এবং প্রায় সমস্ত অরণ্য দখল করে নিতে। এই শুরুর দিকে এগিয়ে যাবার সুযোগ স্বাভাবিক ভাবেই মানুষের ক্ষেত্রে পায় আর্থ-সামাজিকভাবে ধনী পরিবারের সন্তানেরা।
ব্রিটিশ সমাজতাত্ত্বিক মাইকেল ইয়াং মেধাতন্ত্রের সবচেয়ে বেশী যে জিনিসটাকে অপছন্দ করতেন তা হলো, মেধাতান্ত্রিক সমাজে মেধার জোরে যারা সামাজিক সুবিধা পায় এরা মনে করে নিজের যোগ্যতায় পেয়েছে। অভিজাততান্ত্রিক সমাজে বাবার ক্ষমতায় বা বংশ ক্ষমতায় যারা সামাজিক সুযোগ পেত তাদের মধ্যে নিজের যোগ্যতা নিয়ে সন্দেহ, অনুশোচনার বোধ তৈরী হবার সুযোগ থাকত। এবং এজন্য তারা সমাজে যারা তাদের নিচে থাকত এদের প্রতি কম খারাপ ব্যবহার করত।
কিন্তু মেধাতান্ত্রিক সমাজের প্রায় একই ধরনের অবস্থায় থেকেও সুবিধাপ্রাপ্তরা অনুশোচনা অনুভব করে না, বরং নিজেকে মেধাবী ভেবে গর্ব অনুভব করে। অনৈতিক সুবিধাকে যখন কেউ নৈতিক হিসেবেই বিশ্বাস করে ও মানে, তখন তা খুবই ভয়ংকর।
মেধাতন্ত্র সামাজিক অসাম্য গভীর করে তোলে। আমাদের দেশের মত দেশের জন্য তা আরো মারাত্মক। অজ পাড়াগাঁয়ের একজন ছাত্র বা ছাত্রী একজন শহুরে ছাত্র বা ছাত্রীর সমান শিক্ষার সুযোগ পাচ্ছে না, তা সাদা চোখেই দেখা যায়। কিন্তু মেধাতন্ত্রে তাদের প্রতিযোগীতা করতে হয় একসাথেই। এছাড়া, যাদের গরীব বাবা মা সে ভুগছে অপুষ্টিতে। উপসাহারা অঞ্চল, যেখানে মাঝে মাঝে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়, সেখানে অপুষ্টির হার গড়ে ২৪.৭ শতাংশ আর সব নিম্ন আয়ের দেশে গড়ে ২৭.৭ শতাংশ। বাংলাদেশে এই হার ৪১.৩ শতাংশ! মেধাতন্ত্রে, শিশু বয়েসে অপুষ্টির শিকার এই ৪১ ভাগ লোককে পাঠানো হয় বাকী প্রায় ৫৯ ভাগ পুষ্টি পাওয়া লোকদের সাথে মেধার প্রতিযোগীতায়। এবং তুলে ধরা হয় ব্যবস্থাটি স্বচ্ছ, গণতান্ত্রিক, উদার! বলা হয়, মেধাবীদের সুযোগ দিলেই সব সমস্যার সমাধান!
আর সুযোগ প্রাপ্ত মেধাবীরা গর্বে আটখানা হয়ে থাকেন, সমাজের হালুয়া রুটির ভাগ পেয়ে, যেন নিজ যোগ্যতা আর পরিশ্রমে পেয়েছেন তারা! প্রতিভা, মেধা, বুদ্ধিমত্তা যে জন্মসূত্রেই পেয়েছেন বেশীরভাগ, কাজের ড্রাইভ যে জন্মসূত্রেই পেয়েছেন অধিকাংশ, এবং জন্মসূত্রেই যে খাদ্য, পুষ্টি, সাংস্কৃতিক সামাজিক পরিবেশ পেয়েছেন, তা এরা ভুলে যান বা স্বীকার করতে চান না।
উপরের ছবিতে যেমন বিভিন্ন আকৃতির ছেলেরা আছে, সামাজিক এবং জেনেটিক, ও বিভিন্ন সামাজিক শ্রেণীতে জন্মভাগ্যের কারণে মানব সমাজেও এমন মেধায় নানা আকৃতির লোক বিদ্যমান। সবাইকে একই মেধার প্রতিযোগীতায় পাঠালে বেশীরভাগেই বঞ্চিত হবে, কিছু ভাগ্যবানরা হবে সুবিধাপ্রাপ্ত। ন্যায়বিচার হলো, যার কম, যার দরকার, তাকে বেশী দেয়া, যার বেশী আছে তাকে অল্প দিলেও হয়।
—–
“Both liberty and equality are among the primary goals pursued by human beings throughout many centuries; but total liberty for wolves is death to the lambs, total liberty of the powerful, the gifted, is not compatible with the rights to a decent existence of the weak and the less gifted.”
― The Crooked Timber of Humanity: Chapters in the History of Ideas