আহমদ ছফার যদ্যপি আমার গুরু এবং গোলাম মুস্তাকীমের সৈয়দ মুজতবা আলী প্রসঙ্গ-অপ্রসঙ্গ যে টাইপের বই, এগুলি খুবই উপভোগ্য হইয়া উঠে কারণ গুরু যিনি থাকেন তিনি অনেক কিছু জানেন ও তার শিষ্যরে জানাইতে থাকেন। সাধারণ ইন্টারভিউদের চাইতে এখানে বেশী বিষয়-বৈচিত্র থাকে, গুরুর জীবন যাপন প্রণালী এবং চরিত্র, বাচন ইত্যাদি সম্পর্কেও ধারণা মিলে। এই ধরনের বইয়ের একটা মূল সমস্যা অতি ভক্তি, মনে হয় না উল্লিখিত দুই বইতে অতি ভক্তি খুব একটা কাজ করেছে। তাই বই দুইটি ভালো।
গুরু অন্যসব ব্যক্তি বা বিষয়কে বিচার করেন, তা আমাদের সামনে আসে এই ধরনের বইতে। কিন্তু সমস্যাপূর্ন বিষয় হল যখন অন্য মানুষের কোন বিচার গুরু ঐ মানুষের বরাতেই উল্লেখ করেন।
এক্ষেত্রে আমাদের তিনি যেখানে ঐ বিচারটা পেয়েছেন, মানে মূল টেক্সট ঘাঁটতে হবে। কারণ সবারই বায়াস থাকে। এবং মূল টেক্সট ঘাঁটলে অনেক সময় হয়ত আমরা ভিন্ন চিত্র পাইতে পারি।
যেমন, উল্লিখিত দুই বইতে আমরা পাই রামকৃষ্ণ পরমহংস দেবের বঙ্কিম বিচার সম্পর্কে। আব্দুর রাজ্জাক ও মুজতবা আলী দুইজনাই এই বিচার উল্লেখ করছেন। যেমনঃ
“রামকৃষ্ণ বঙ্কিমরে দেইখ্যা কইছিলেন তোমার মনে এত অহংকার কেন?” – আব্দুর রাজ্জাক।
“একবার বঙ্কিম রামকৃষ্ণ পরমহংস দেবের কাছে গিয়ে বললেন, আমি হিন্দু ধর্মের সেবা করতে চাই। আমাকে আশীর্বাদ করুন। উত্তরে পরমহংস বললেন, বঙ্কিম, তোমার নাম ও বঙ্কিম, মনও বঙ্কিম। তোমাকে দিয়ে কিচ্ছু হবে না।” – সৈয়দ মুজতবা আলী।
মুজতবা আলী আবার আরেক জায়গায় পরমহংস দেবের বিদ্যাসাগর বিচারকে সামনে আনছেন।
“একবার রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব বিদ্যাসাগরের সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে বললেন, আমি সাগর দেখতে এসেছি।
কিছুটা কৌতুক করে বিদ্যাসাগর হেসে বললেন, কিন্তু সাগরের জল তো তেতো। রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব হেসে বললেন, আমি তেতো জিনিসই বেশি পছন্দ করি। ওটা শরীরের জন্য ভালো।”
রামকৃষ্ণের মুখে এই বিচার দেখে বঙ্কিম সম্পর্কে আমাদের মনে যে ধারণা আসে, বা বিদ্যাসাগরকে যেভাবে পরমহংস দেখছেন তার সাথে তুলনা করলে বঙ্কিম সম্পর্কে আমাদের মনে যে ধারণা আসে; মূল টেক্সট অর্থাৎ রামকৃষ্ণ পরমহংস দেবের কথামৃত পড়লে তা আর থাকে না।
বিদ্যাসাগরের প্রতি রামকৃষ্ণ পরমহংস দেবের মুগ্ধতা ছিল। বিদ্যাসাগরের বিদ্যা, তার জ্ঞান ও দান, মাতৃভক্তি ইত্যাদি কারণে তার চাইতে ১৬/১৭ বছরের ছোট রামকৃষ্ণ তাকে শ্রদ্ধার চোখে দেখতেন। এই শ্রদ্ধা কেমন ছিল তা বুঝা যায় বিদ্যাসাগরের বাড়িতে প্রবেশের আগে রামকৃষ্ণ যখন তার সাথের মাস্টারকে (মহেন্দ্রনাথ গুপ্ত, কথামৃতের লেখক) নিজের জামার বোতামে হাত দিয়ে বলেন, “জামার বোতাম খোলা রয়েছে, এতে কিছু দোষ হবে না?”
বিদ্যাসাগরকে রামকৃষ্ণ কীরূপে দেখতেন তা তার এই কথাতেই বোধগম্য হতে পারেঃ
“তোমার কর্ম সাত্ত্বিক কর্ম। সত্ত্বের রজঃ। সত্ত্বগুণ থেকে দয়া হয়। দয়ার জন্য যে কর্ম করা যায়, সে রাজসিক কর্ম বটে — কিন্তু এ রজোগুণ — সত্ত্বের রজোগুণ, এতে দোষ নাই। শুকদেবাদি লোকশিক্ষার জন্য দয়া রেখেছিলেন — ঈশ্বর-বিষয় শিক্ষা দিবার জন্য। তুমি বিদ্যাদান অন্নদান করছ, এও ভাল। নিষ্কাম করতে পারলেই এতে ভগবান-লাভ হয়। কেউ করে নামের জন্য, পুণ্যের জন্য, তাদের কর্ম নিষ্কাম নয়। আর সিদ্ধ তো তুমি আছই।”
রামকৃষ্ণের সাথে বিদ্যাসাগরের যখন দেখা হয় তখন বিদ্যাসাগরের বয়স ছিল ৬২/৬৩। রামকৃষ্ণের বয়স তখন ৪৬/৪৭, আন্দাজ। দেখা করার জন্য রামকৃষ্ণ গিয়েছিলেন বিদ্যাসাগরের বাড়িতে।
আর বঙ্কিমচন্দ্রের সাথে রামকৃষ্ণের দেখা হয় ভক্ত অধরলাল সেনের বাড়িতে। রামকৃষ্ণ বঙ্কিমের চাইতে প্রায় এক বছরের বড় ছিলেন, অর্থাৎ সমসাময়িক। রামকৃষ্ণ ভক্ত অধরের বাড়িতে গিয়ে ভক্তবৃন্দের সাথে কথা বলছেন এমন সময় অধর তার কয়েকজন ম্যাজিস্ট্রেট বন্ধুকে নিয়ে আসেন, তার মধ্যে একজন ছিলেন বঙ্কিম চন্দ্র।
অধর বঙ্কিমকে এভাবে পরিচয় করিয়ে দেন রামকৃষ্ণের সাথে।
অধর (বঙ্কিমকে দেখাইয়া ঠাকুরের প্রতি) — মহাশয়, ইনি ভারি পণ্ডিত, অনেক বই-টই লিখেছেন। আপনাকে দেখতে এসেছেন। ইঁহার নাম বঙ্কিমবাবু।
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে) — বঙ্কিম! তুমি আবার কার ভাবে বাঁকা গো!
বঙ্কিম (হাসিতে হাসিতে) — আর মহাশয়! জুতোর চোটে। (সকলের হাস্য) সাহেবের জুতোর চোটে বাঁকা।
রামকৃষ্ণের সাথে বঙ্কিমের এই আলাপ খুব সুন্দর হয় নি পরবর্তীতে দেখা যায়। বঙ্কিম এবং তার বন্ধুরা ইংরাজিতে কথা বলতে থাকলে রামকৃষ্ণ এ নিয়ে হাসি ঠাট্টা করেন।
বঙ্কিমের রামকৃষ্ণের প্রতি শ্রদ্ধা ভক্তি ছিল না তা তার কথাবার্তাতেই ফুটে উঠে। বঙ্কিম অনেক ক্ষেত্রেই কৌতুক করেছেন রামকৃষ্ণকে নিয়ে এবং এতে রামকৃষ্ণ বিরক্ত হয়ে উঠেন, আক্রমণ করেন তীব্র ভাষায়। যেমনঃ
(বঙ্কিমের প্রতি) — “আচ্ছা, আপনি কি বল, মানুষের কর্তব্য কি?”
বঙ্কিম (হাসিতে হাসিতে) — আজ্ঞা, তা যদি বলেন, তাহলে আহার, নিদ্রা ও মৈথুন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (বিরক্ত হইয়া) — এঃ! তুমি তো বড় ছ্যাঁচড়া! তুমি যা রাতদিন কর, তাই তোমার মুখে বেরুচ্ছে। লোকে যা খায়, তার ঢেকুর উঠে। মূলো খেলে মূলোর ঢেকুর উঠে। ডাব খেলে ডাবের ঢেকুর উঠে। কামিনী-কাঞ্চনের ভিতর রাতদিন রয়েছো আর ওই কথাই মুখ দিয়ে বেরুচ্ছে! কেবল বিষয়চিন্তা করলে পাটোয়ারি স্বভাব হয়, মানুষ কপট হয়। ঈশ্বরচিন্তা করলে সরল হয়, ঈশ্বর সাক্ষাৎকার হলে ও-কথা কেউ বলবে না।
(বঙ্কিমের প্রতি) — “শুধু পাণ্ডিত্য হলে কি হবে, যদি ঈশ্বরচিন্তা না থাকে? যদি বিবেক-বৈরাগ্য না থাকে? পাণ্ডিত্য কি হবে, যদি কামিনী-কাঞ্চনে মন থাকে?
“চিল শকুনি খুব উঁচুতে উঠে, কিন্তু ভাগাড়ের কদিকে কেবল নজর! পণ্ডিত অনেক বই শাস্ত্র পড়েছে, শোলোক ঝাড়তে পারে, কি বই লিখেছে, কিন্তু মেয়েমানুষে আসক্ত, টাকা, মান সার বস্তু মনে করেছে; সে আবার পণ্ডিত কি? ঈশ্বরে মন না থাকলে পণ্ডিত কি?
“কেউ কেউ মনে করে এরা কেবল ঈশ্বর ঈশ্বর করছে, পাগলা। এরা বেহেড হয়েছে। আমরা কেমন স্যায়না, কেমন সুখভোগ করছি; টাকা, মান, ইন্দ্রিয়সুখ। কাকও মনে করে, আমি বড় স্যায়না, কিন্তু সকালবেলা উঠেই পরের গু খেয়ে মরে। কাক দেখো না কত উড়ুর পুড়ুর করে, ভারী স্যায়না! (সকলে স্তব্ধ)
“যারা কিন্তু ঈশ্বরচিন্তা করে, বিষয়ে আসক্তি, কামিনী-কাঞ্চনে ভালবাসা চলে যাবার জন্য রাতদিন প্রার্থনা করে, যাদের বিষয়রস তেঁতো লাগে, হরিপাদপদ্মের সুধা বই আর কিছু ভাল লাগে না, তাদের স্বভাব যেমন হাঁসের স্বভাব। হাঁসের সুমুখে দুধেজলে দাও, জল ত্যাগ করে দুধ খাবে। আর হাঁসের গতি দেখেছো? একদিকে সোজা চলে যাবে। শুদ্ধভক্তের গতিও কেবল ঈশ্বরের দিকে। সে আর কিছু চায় না; তার আর কিছু ভাল লাগে না।
(বঙ্কিমের প্রতি কোমলভাবে) — “আপনি কিছু মনে করো না।”
বঙ্কিম — আজ্ঞা, মিষ্টি শুনতে আসিনি।
তাদের কথাবার্তার আরেক অংশঃ
শ্রীরামকৃষ্ণ (বঙ্কিমের প্রতি) — কামিনী-কাঞ্চনই সংসার। এরই নাম মায়া। ঈশ্বরকে দেখতে, চিন্তা করতে দেয় না; দুই-একটি ছেলে হলে স্ত্রীর সঙ্গে ভাই-ভগ্নীর মতো থাকতে হয়, আর তার সঙ্গে সর্বদা ঈশ্বরের কথা কইতে হয়। তাহলে দুজনেরই মন তাঁর দিকে যাবে আর স্ত্রী ধর্মের সহায় হবে। পশুভাব না গেলে ঈশ্বরের আনন্দ আস্বাদন করতে পারে না। ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করতে হয় যাতে পশূভাব যায়। ব্যাকুল হয়ে প্রার্থনা। তিনি অন্তর্যামী, শুনবেনই শুনবেন। যদি আন্তরিক হয়।
“আর — ‘কাঞ্চন’। আমি পঞ্চবটীর তলায় গঙ্গার ধারে বসে ‘টাকা মাটি’ ‘টাকা মাটি’ ‘মাটিই টাকা’, ‘টাকাই মাটি’ বলে জলে ফেলে দিছলুম!”
বঙ্কিম — টাকা মাটি! মহাশয় চারটা পয়সা থাকলে গরিবকে দেওয়া যায়। টাকা যদি মাটি, তাহলে দয়া পরোপকার করা হবে না?
আগে বিদ্যা না আগে ঈশ্বর এই তর্কে গিয়ে তাদের কথোপকথনঃ
“তোমার দরকার ঈশ্বরকে লাভ করা! তুমি অত জগৎ, সৃষ্টি, সায়েন্স, ফায়েন্স এ-সব করছো কেন? তোমার আম খাবার দরকার। বাগানে কত শ আমগাছ, কত হাজার ডাল, কত লক্ষ কোটি পাতা, এ-সব খবরে তোমার কাজ কি? তুই আম খেতে এসেছিস আম খেয়ে যা। এ-সংসারে মানুষ এসেছে ভগবানলাভের জন্য। সেটি ভুলে নানা বিষয়ে মন দেওয়া ভাল নয়। আম খেতে এসেছিস আম খেয়েই যা।”
বঙ্কিম — আম পাই কই?
শ্রীরামকৃষ্ণ — তাঁকে ব্যাকুল হয়ে প্রার্থনা কর। আন্তরিক হলে তিনি শুনবেনই শুনবেন। হয়তো এমন কোনও সৎসঙ্গ জুটিয়ে দিলেন, যাতে সুবিধা হয়ে গেল। কেউ হয়তো বলে দেয়, এমনি এমনি কর তাহলে ঈশ্বরকে পাবে।
বঙ্কিম — কে? গুরু! তিনি আপনি ভাল আম খেয়ে, আমায় খারাপ আম দেন! (হাস্য)
শ্রীরামকৃষ্ণ — কেন গো! যার যা পেটে সয়। সকলে কি পলুয়া-কালিয়া খেলে হজম করতে পারে? বাড়িতে মাছ এলে মা সব ছেলেকে পমুয়া-কালিয়া দেন না। যে দুর্বল, যার পেটের অসুখ, তাকে মাছের ঝোল দেন; তা বলে কি মা সে ছেলেকে কম ভালবাসেন?
রামকৃষ্ণ এবং বঙ্কিমের এইসব কথাবার্তা (নেয়া হয়েছে শ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত থেকে) দেখলে বুঝা যায় তাদের একজনের উপর আরেকজনের শ্রদ্ধা ছিল না। রামকৃষ্ণকে কৌতুক করতে চেয়েছেন বঙ্কিম অনেক জায়গায়, রামকৃষ্ণ উত্তরে তাকে আক্রমণ করেছেন, বিরক্ত হয়েছেন। এই পুরা কথাবার্তা পড়লে এটা বোধগম্য হয় যে রামকৃষ্ণ বঙ্কিমকে “তোমার নামও বঙ্কিম, মনও বঙ্কিম” এই টাইপের আক্রমণ করতে পারতেন।
বিদ্যাসাগরের সাথে রামকৃষ্ণের এইরূপ সম্পর্ক ছিল না। ফলে তার সাথে এই ধরনের আলাপ হয় নাই। তার প্রতি রামকৃষ্ণের শ্রদ্ধামূলক সম্পর্ক ছিল, তাই ভালো কথাই তিনি বলে গেছেন তার সম্পর্কে।
রামকৃষ্ণের বঙ্কিম বিচারকে তাই তার বিদ্যাসাগর বিচারের সাথে মেলালে হবে না। দুইজনের সাথে তার দুইরকম সম্পর্ক ছিল, তা বিবেচনায় নিতে হবে। যদ্যপি আমার গুরু বা সৈয়দ মুজতবা আলী প্রসঙ্গ অপ্রসঙ্গ এর মত বই তাই সাবধানতার সাথে পাঠ জরুরী। কারণ এই ধরনের বইয়ে, গুরুর কথাবার্তায়, দুইজনের সাথে দুই ধরনের সম্পর্ক যে ছিল রামকৃষ্ণের, তা বুঝার উপায় নাই।