বাংলাদেশের রপ্তানী বৈদেশিক আয়ের সবচেয়ে বড় অংশটি আসে তৈরী পোশাক শিল্প (গার্মেন্ট সেক্টর- রপ্তানীর ৮০%) থেকে এবং বাংলাদেশের অর্থনীতির চাকা ঘুরানোর মূল শক্তিই এই সেক্টর। প্রাচীন কাল থেকেই বাংলাদেশ বিখ্যাত ছিল বিভিন্ন বস্ত্র শিল্পের জন্য। নবম শতকের আরব ভূগোলবিদ সোলায়মানের বই সিলসিলাত উত তওয়ারীখ, ইবনে বতুতা এবং চীনের পর্যটকদের লেখায় এই দেশের কাপড়ের সুনামের উল্লেখ আছে। উনিশ শতকের এক ইংরাজ পর্যটক এও লিখেছেন যে এদেশের কাপড় যেত রোমান সাম্রাজ্যে, যদিও তার কোন প্রমান পাওয়া যায় নি।
আগেকার কাপড় শিল্পের ক্ষেত্রে সুতা থেকে শুরু সব কিছুই তৈরী হত এদেশে। যেমন বিখ্যাত মসলিন কাপড়ের কথা বলা যায়। এত সূক্ষ্ণ কাপড় সম্ভবত পৃথিবীর আর কোন দেশের তাঁতিরা বুনতে পারতেন না। এর সুতা থেকে শুরু করে সব কিছু তৈরী হত বাংলাদেশে।
ফরাসি, ওলন্দাজ, ইংরাজ ইত্যাদি দেশের কোম্পানি ব্যবসা করার জন্য বাংলাদেশে আসে, ওলন্দাজরা ঢাকায় আসেন ১৬৬৩ সালে। ১৭৪৭ সালে তারা এক লক্ষ টাকার মসলিন কাপড় কিনেছিলেন ইউরোপে রপ্তানী করার জন্য। সে বছর ইংরাজরা ইউরোপে রপ্তানীর জন্য কিনেছিলেন সাড়ে তিন লক্ষ টাকার মসলিন। একই বছর ফরাসিরা কিনেন আড়াই লক্ষ টাকার মসলিন কাপড়।
এছাড়াও ঢাকায় মসলিন কাপড়ের ব্যবসা করতেন ইরানী, তুরানী, আর্মেনী, মুগল ও দেশী ব্যবসায়ীরা। ১৭৪৭ তুরানীরা সংগ্রহ করেছিলেন এক লক্ষ টাকার মসলিন, পাঠান ব্যবসায়ীরা দেড় লক্ষ টাকার। আর্মেনীরা পাঁচ লক্ষ টাকার। আর্মেনীদের এসব কাপড় যেত জেদ্দায়, মিশর, বসরা ইত্যাদিতে। মুগল ব্যবসায়ীরা কিনেছিলেন চার লক্ষ টাকার কাপড়।
১৭৪৭ সালে ঢাকা ও এর আশপাশের অঞ্চল থেকে রপ্তানীর জন্য ব্যবসায়ীরা কিনেছিলেন প্রায় উনত্রিশ লাখ টাকার মসলিন। এটা কেবল মসলিন কাপড়ের হিসাব, এর সাথে সাথে অন্যান্য বস্ত্রও রপ্তানী হত। এক খন্ড মসলিন তৈরী করতে তাঁতি ও তার সহকারীর সময় লাগত প্রায় ছয় মাস। ঢাকায় তখন কাপড়ের ব্যবসা থেকে যে আয় আসত তা দিয়ে পুরো ঢাকার খাজনা দেয়া যেত মুগল সম্রাটকে।
১৭৫৭ সালের পর অবস্থা বদলে যায়। পলাশীর যুদ্ধে ইংরাজরা জেতার পরে তারা মসলিন ব্যবসার উপর একচেটিয়া ভাবে ঝেঁকে বসে।
১৭৬৫ সালে ইংরাজরা লাভ করে বাংলার দিওয়ানী বা শাসন ব্যবস্থা। তখন থেকেই অন্যান্য ব্যবসায়ীরা সরে পড়তে শুরু করেন ইংরাজদের চাপে। ফলে বিদেশে কাপড় রপ্তানী কমে যেতে থাকে। ইংরাজরা চালু করে দালাল-গোমস্তা ব্যবস্থা। দালাল-গোমস্তাদের কোম্পানি আগে টাকা দিয়ে দিত, দালার-গোমস্তারা সেই টাকার এক অংশ দিত তাঁতিদের। আবার মসলিন তৈরী শেষ হলে তারা ইচ্ছামত দাম নির্ধারন করত, ফলে তাঁতিদের অবস্থা হয়ে উঠেছিল করুণ।
ইংরাজদের অধীনস্থ দালাল-গোমস্তাদের নির্যাতন ছাড়াও কিছু প্রধান কারণ আছে মসলিন শিল্প ধ্বংস হবার পিছনে, যা উল্লেখ করেন ১৮৪৪ সালে ঢাকার কমিশনার আই ডানবার। তিনি তিনটি কারণের কথা উল্লেখ করেনঃ
১। ইংলান্ডে শিল্প বিপ্লব; অর্থাৎ বাষ্পীয় এঞ্জিনের আবিষ্কারের ফলে কল কারখানায় কম খরচে জিনিসপত্র তৈরীর প্রক্রিয়ার ফলে শিল্পের যে বিপ্লব হয়েছিল।
২। বিলাতী সস্তা সুতার আমদানী; এও শিল্প বিপ্লবের ফল। এর ফলে খালি মসলিন নয় অন্য বস্ত্র শিল্পও ধ্বংস হয়েছিল।চ
৩। বিলাতে ঢাকাই মসলিনের উপর উঁচু হারে কর আরোপ।
শিল্প বিপ্লবের ফলে ইংলান্ডের কল কারখানাগুলিতে কম খরচে এবং তাড়াতাড়ি পন্য তৈরীর প্রক্রিয়া শুরু হয়। অনেক কল কারখানায় স্বস্তায় সুতা ও কাপড় তৈরী হতে থাকে। তারা সেই সব কাপড় ও সুতা রপ্তানী করতে থাকে ভারতেও। সাধারনত হাতে তৈরী যে সুতা, তা তৈরীর পদ্বতি ছিল খুবই দীর্ঘ। যেমন, একজন মহিলা কাটুনি যদি প্রতিদিন সকালে সুতা কাটতেন তাহলে একমাসে মাত্র আধ তোলা সুতা তুলতে পারতেন। উনিশ শতকের শুরুতেই কাটুনির সংখ্যা কমে যেতে থাকে, ১৮০০ সালে ঢাকায় কাটুনি ছিলেন মাত্র তিন জন। এবং ১৮১৭ সালের দিকে ইউরোপে মসলিন রপ্তানী বন্ধ হয়ে যায়। উনিশ শতকের মাঝামাঝিতে এই শিল্প প্রায় উঠেই যায়।
এই হচ্ছে মসলিন শিল্প তথা প্রাচীন বাংলার পোশাক শিল্প ধ্বংস হবার কথা।
প্রযুক্তিগত উন্নয়ন খুবই মারাত্মক জিনিস এবং তা আরো বেশী অসাম্য তৈরী করে দেয়। কারণ প্রযুক্তি যখন একশো জনের কাজকে একজনের কাজে পরিণত করে তখন একজন প্রশিক্ষিত (যে ভাগ্যবান, তাই প্রশিক্ষন পাবার মত জায়গায় ছিল বা জন্মেছে।) ব্যক্তিই সুবিধা পায়, বাকী নিরান্নব্বই জন চাকরি হারায়।
এ জন্য বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং থেকে শুরু করে পৃথিবীর বড় চিন্তাশীলেরা প্রযুক্তিগত উন্নতির ভবিষ্যত প্রভাব বিষয়ে চিন্তিত। ঢাকার প্রাচীন স্বয়ংসম্পূর্ন কাপড় শিল্প ধ্বংস হয়েছিল ইংলান্ডে প্রযুক্তিগত উন্নয়নের জন্য (স্টিম এঞ্জিনের আবিষ্কার)। পরে একসময় ইউরোপে ঐসব কলকারখানায় শ্রমিক সংকট দেখা যায়, গরীবেরা এবং এদেশ থেকে গিয়েও অনেকে সেসব কলকারখানায় কাজ করেন। এর পরে তারা আরো উন্নত হয়, আরো শ্রমের দাম বাড়ে, নানা বিধি নিষেধ তৈরী হয় শ্রম কেনার ক্ষেত্রে, তখন বড় কোম্পানিগুলি আবার ফিরে আসে গরীব দেশগুলিতে স্বস্তায় শ্রম কেনার জন্য।
যদি আমাদের যা দরকার তার সবই যদি মেশিন তৈরী করে, তাহলে এর ফল নির্ভর করবে কীভাবে তা ভাগ বিভাজন হবে। সবাই দারুণ আরামদায়ক একটা জীবন যাপন করতে পারবে যদি সম্পদ ভাগাভাগিটা ঠিক হয় অথবা বেশীরভাগ মানুষ হয়ে পড়বে অতি দরিদ্র যদি মেশিনের মালিকেরা নিজেরা সংঘবদ্ধভাবে বিরোধী হয়ে যায় সবার সম্পদের ভাগাভাগি বিষয়ে। এখন পর্যন্ত যা হচ্ছে, তাতে বুঝা যাচ্ছে আমরা যাচ্ছি দ্বিতীয়টার দিকেই, অর্থাৎ প্রযুক্তি ডেকে আনছে অসীম অসাম্য। – বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং।
বাংলাদেশেও তারা এসেছে, এটাই এখন বাংলাদেশের গার্মেন্ট ব্যবসা। মজার ব্যাপার হলো একসময় এদেশে সম্পূর্ন নিজেদের কাপড় ব্যবসা ছিল।
বর্তমানে বাংলাদেশে যে কাপড় ব্যবসা আছে তা হলো দর্জি ব্যবসা। বাংলাদেশ থেকে অল্প দামে কাপড় তৈরী করিয়ে নিয়ে যায় বিদেশী কোম্পানিরা। সুতা থেকে কাপড় সবই আসে বিদেশ থেকে। বাংলাদেশ কেবলমাত্র স্বস্তায় শ্রম বিক্রি করে এখানে। (এন্ট্রি লেভেলে শ্রমিক পায় মাসে ৩০০০ টাকা ২০১০ সাল থেকে, অর্থাৎ দিনে ১.২০ ডলার; তাহলে ৫ ঘন্টা কাজ করলে ঘন্টায় দাঁড়ায় ০.২৪২ ডলার বা ১৯.৮৪ টাকা। )
বর্তমানে পৃথিবী একটি নতুন যুগে প্রবেশ করেছে। এটি হলো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (AI) বিপ্লব। এ পর্যায়ে ধারণা করা হচ্ছে উন্নত দেশের প্রায় ৭০ ভাগ কাজ চলে যাবে রোবটের হাতে। তাদের ক্ষেত্রে অবশ্য একটা সুবিধাও আছে, এইসব রোবট এবং এ সংস্লিষ্ট নানাবিদ কাজের ক্ষেত্র তৈরী হবে, তাতে মানুষেরা কাজ করতে পারবে। যদিও বড় আশঙ্কা আছে অনেক মানুষের কাজ হারানোর তথাপি তা ১৯ শতকের শিল্প বিপ্লবের মত হবে না উন্নত দেশগুলির লোকদের জন্য, এমন অভিমতও আছে। এছাড়াও উন্নত দেশগুলি নিজেদের দেশের শ্রমিকদের ক্ষেত্রে বেশী সহানুভূতিশীল থাকবে, যেহেতু এখানে নীতিনির্ধারক ও রাজনীতিবিদদের স্বার্থ আছে, জনগনের ভোট।
কিন্তু অচিরেই ইউরোপে আবিষ্কার হতে পারে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে দ্রুত কাপড় তৈরীর পদ্বতি। এতে স্বল্প সময়ে, অল্প লোকবলের মাধ্যমে কাপড় তৈরী করা সম্ভব হবে। যদি এমন হয় তাহলে শিল্প বিপ্লবের সময় যেভাবে বাংলার তাঁতিরা মার খেয়েছিল, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বিপ্লবের কালে মার খাবে গার্মেন্ট শ্রমিকেরা। কোম্পানিগুলি কম খরচে কাপড় বানাতে পারলে বাংলাদেশে আসবে না। এদেশের লোকদের বিপুল বেকারত্বের যে তৈরী হবে, এই বেকারদের মধ্যে কী বড় সংখ্যক কাজ নিতে পারবে রোবট এবং তার মেরামত ও তৎ-সংস্লিষ্ট অন্যান্য কর্মক্ষেত্রে? সে প্রশিক্ষণও তো তার নাই। ফলে তাকে তো বেকারত্বই বরন করতে হবে।
প্রচুর মানুষ বেকার হবে। বাংলাদেশের অর্থনীতি, অর্থনৈতিক উন্নতি পড়বে হুমকির মুখে। বাংলাদেশ; এমন অবস্থা হলে (যা আসলে হতে যাচ্ছে) কীভাবে মোকাবেলা করবে তা ভেবে রেখেছে কী?