বাজী

Ronald Dahl
Roald Dahl in 1954

লোকটি হে হে হে করে টেনে টেনে হেসে বলল, বাজী ধরবেন? বাজী?

একটা স্বস্তা চায়ের দোকানে বসেছিলাম আমি সহ আরো তিনজন। তাদের মধ্যে একজন মধ্যবয়স্ক। মুখ দেখেই বুঝা যাচ্ছে দুনিয়ার কোন কিছুতে তার কোন আগ্রহ অবশিষ্ট নেই। আরেকজন সাহেব গোছের লোক। কোট টাই পরা। এই চায়ের দোকানে কেন এবং কীভাবে এসে পড়েছেন তা এক বিস্ময়। আর তৃতীয় জন হল এক অল্প বয়েসী যুবক ছেলে। খুব সম্ভবত বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্স্ট ইয়ারে পড়ে। আর চতুর্থজন আমি।

আরেকজন হলেন বক্তা। যিনি এইমাত্র এসেছেন ও বাজী ধরার কথাটা বলছেন। তার গায়ের রঙ কালো। কুচকুচে কালো। গায়ে খয়েরী রঙের চাদর। মাথায় কালো ময়লা হ্যাট। তিনি কথা বলার সময় মাঝে মাঝে হে হে হে করে হাসেন। তার গলার স্বর খসখসে ও ক্ষীণ।

লোকটার বাজী ধরার প্রস্তাবে আমি কিছু বললাম না। এইসব অনেক লোক মিলে, যারা যেচে এসে কথাবার্তা বলতে চায়। নিজেদের স্বার্থেই বলতে চায়, হয়ত কিছু বিক্রি করবে বা কোন সাহায্য চাইবে। এগুলিতে আমার আগ্রহ নেই।  কিন্তু দেখলাম যুবক ছেলেটি বেশ আগ্রহ নিয়ে তাকাচ্ছে।

বাজী ধরার প্রস্তাবকারী লোকটি এবার ছেলেটির দিকে তাকিয়ে বললেন, ধরবে বাজী?

ছেলেটি লাইটার দিয়ে সিগারেট ধরাচ্ছিল।

ছেলেটি জিজ্ঞেস করল, কি নিয়ে?

যেকোন কিছু।

কিন্তু সেটা কী?

এই যেমন ধরো তোমার লাইটারটা নিয়ে বাজী ধরা যায়।

লাইটার নিয়ে?

হ্যা। তুমি কি এই লাইটার দিয়ে টানা দশবার আগুন জ্বালাতে পারবে?

অবশ্যই পারব।

আমি বলছি পারবে না।

আমি পারব।

তাহলে এ নিয়েই বাজী হয়ে যাক। তুমি যদি বাজীতে জিততে পারো তাহলে আমি তোমাকে আমার ক্যাডিলাকটা দিয়ে দেব।

মানে কী?

মানে হল এই দোকানের পাশের হোটেলে আমি উঠেছি। ঐ পার্কিং এ যে গাড়িটা দেখতে পাচ্ছো, ক্যাডিলাক, ওটা আমার। আমি ওটা তোমাকে দিয়ে দেব যদি জিততে পারো।

কিন্তু আমি আসলে এত বড় বাজী ধরতে পারবো না। আমার কাছে সাকুল্যে আছেই দুইশ টাকা।

আচ্ছা আচ্ছা। সে ঠিক আছে। হে হে হে। আমি তোমাকে এমন কিছু বাজী ধরতে বলব না যা দিতে তোমার কষ্ট হয়। তুমি তোমার কড়ে আঙ্গুলটা বাজী ধরতে পারো।

মানে?

মানে হল যদি বাজীতে হেরে যাও তাহলে তোমার কড়ে আঙ্গুলটা আমি কেটে নেব।

এ কীভাবে সম্ভব!

খুব সম্ভব। চিন্তা করে দেখো কড়ে আঙ্গুলের কাজটাই বা কি!

বৃদ্ধ লোক ও যুবকের কথাবার্তা শোনে আমি বেশ আগ্রহ অনুভব করছি। কিন্তু সরাসরি তাদের দিকে তাকাচ্ছি না। সাহেব লোকটির একটা ফোন এসেছিল তিনি উঠে চলে গেছেন। মধ্যবয়স্ক বিরক্ত লোকটিও তার চা শেষ করে চলে গেছেন। টেবিলে তখন আমি আর যুবক ছেলেটি, আর পাশে দাঁড়িয়ে ওই বুড়ো লোক।

বৃদ্ধ লোক আমার দিকে তাকিয়ে হে হে করে হেসে বলল, আপনার কি কোন কাজ আছে এখন?

আমি বললাম, না। কেনো?

বৃদ্ধ লোক বলল, হে হে হে কাজ না থাকলে আপনি আমাদের বাজীতে রেফারি হবেন দয়া করে। যদি ছোকরা বাজী ধরতে রাজী হয়। মনে হয় না রাজী হবে। ভয় পেয়েছে। হে হে হে।

শেষ কথাটি লোকটি বলেছিল যুবক ছেলেটাকে উত্তেজিত করতেই, আমার মনে হলো। এতে কাজও হলো।

যুবক ছেলেটি প্রায় চেঁচিয়ে বলল, না। আমি বাজী ধরতে রাজী।  সে পকেট থেকে লাইটার বের করল।

বৃদ্ধলোক বলল, আরে এখানে না। আমার হোটেল রুমে চলো। এই ভদ্রলোকও থাকবেন।

বৃদ্ধলোকের কথামত আমি, ঐ যুবক আর বৃদ্ধলোক তিনজন হোটেল রুমে গেলাম। কী হয় দেখার ইচ্ছা আমার, বিনা পয়সায় এমন মজার জিনিস দেখতে আগ্রহ অনুভব করছিলাম। রুমে দেখলাম বিক্ষিপ্ত ভাবে বিভিন্ন জিনিসপত্র পড়ে আছে।

বৃদ্ধলোক টেবিলের সামনে এসে যুবককে বলল, এই খানে তোমার বামহাতটা বেঁধে রাখা হবে। যাতে যদি তুমি বাজীতে হেরে যাও তখন সাথে সাথেই আমি আঙ্গুল কেটে নিতে পারি। আর এই নাও গাড়ির চাবি।

বৃদ্ধলোক চাবি টেবিলে রাখল। তার পকেট থেকে চিকন ধারালো ছুরি এবং দড়ি বের করল। আমি অবাক হয়ে গেলাম। এই লোক কি এসব নিয়ে ঘুরে নাকী।

আমি ভেবেছিলাম চাকু দেখে ছেলেটি ভয় পাবে এবং বাজী থেকে সরে আসবে।  আমার বৃদ্ধলোকটিকে অস্বাভাবিক মনে হচ্ছিল তখন। অস্বাভাবিক না হলে এমন বাজী কেউ ধরে!

কিন্তু ছেলেটি বাজী থেকে সরে আসল না। সে টেবিলের উপর গাড়ির চাবিটা একবার স্পর্শ করে বলল, আমি রাজী।

বৃদ্ধ লোকটি বলল, তাহলে এবার শুরু করা যাক।

সে যুবক ছেলেটির বামহাতের কড়ে আঙ্গুল টেবিলের উপর রেখে হাতটা নিপুন দক্ষতায় বেঁধে দিল। আমি বাঁধার দক্ষতা দেখে ভয় পেলাম। মনে হচ্ছে এই লোকটি এই কাজে খুব অভিজ্ঞ।

লোকটি হে হে হে করে হেসে বলল, এবার শুরু কর জ্বালানো। আমার দিকে তাকিয়ে বলল, আর আপনি গুনতে থাকুন স্যার।

ছেলেটি জ্বালাতে শুরু করল। প্রথবার দপ করে আগুন জ্বলে উঠল।

দ্বিতীয়বার ও জ্বলল।
তৃতীয়বার ও জ্বলল।
চতুর্থ
পঞ্চম
ষষ্ট……

আমি অনুভব করলাম ভয়ে আমার গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। যুবক ছেলেটির হাতের সামান্য উপরে চকচকে ধারালো ছুরি। একবার না জ্বললেই  মুহূর্তেই নেমে এসে হাত থেকে কড়ে আঙ্গুলকে আলগা করে দেবে।

আমি দেখলাম লাইটার হাতে ছেলেটি ঘামছে। সে আবার লাইটারে চাপ দিল। মৃদু শব্দের সাথে দপ করে আগুন জ্বলে উঠল সপ্তমবারের মত।

বৃদ্ধ লোকটির চোখমুখে উত্তেজনা। যেন সে আকাঙ্খিত কোন জিনিসের একেবারে সন্নিকটে এসে গেছে।

ছেলেটি আবার লাইটারে চাপ দিল। আর সাথে সাথেই শব্দ করে খোলে গেল রুমের দরজা।

এক মধ্যবয়স্ক মহিলা দ্রুত এসে “আবার শুরু করেছে লোকটা” বলে এক ধাক্কা দিয়ে বৃদ্ধলোকটিকে সরিয়ে দিল।

ঘটনার আকস্মিকতায় আমি চমকে গেছি। যুবক ছেলেটাও অবাক হয়েছে। সে বামহাতের বাঁধন খোলে ফেলেছে।

মধ্যবয়স্ক মহিলা আমাদের দিকে তাকিয়ে বলল, আপনারা নিশ্চয়ই বাজী ধরতে এখানে এসেছেন। এই লোকটি এই করে বেড়ায়। এ পর্যন্ত ৪৭ জন মানুষের আঙুল কেটে নিয়েছে। আর হারিয়েছে সাত সাতটি গাড়ি। বিশ্বাস হয় আপনাদের?

আমি শুনে স্তম্ভিত হয়ে গেছি।

ভদ্রমহিলা বললেন, যে গাড়ি বাজী ধরেছে আপনাদের সাথে ওটা আসলে আমার গাড়ি। এই লোকের আসলে কিছুই আর বাকি নেই। বাজী ধরতে ধরতে সব শেষ। একেবারে নিঃস্ব সে। আর আসলে এই গাড়িটা আমি ওর কাছ থেকেই জিতেছি এই কিছুক্ষণ আগে। অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। তবু আমি জিতেছি। গাড়িটা আমার।

যুবক ছেলেটি উত্তেজনায় গাড়ির চাবি হাতে নিয়ে ফেলেছিল সে চাবি টেবিলে রেখে দিল।

ভদ্রমহিলা আমাদের দিকে তাকিয়ে ভদ্রতার হাসি হাসলেন।

তারপর হাত বাড়িয়ে চাবিটা নিলেন। তখন আমি লক্ষ করলাম তার হাতে আঙুল মাত্র একটি। শুধুমাত্র বৃদ্ধাঙ্গুল। সে আঙ্গুলে রিংটা গলিয়েই তিনি চাবিটা নিলেন।

————————————-

রোয়াল্ড দাল এর ‘ম্যান ফ্রম দি সাউথ’ অবলম্বনে। মূল গল্প পড়লে বুঝা যাবে রূপান্তরে আমি প্রচুর স্বাধীনতা নিয়েছি।

লেখক সম্পর্কেঃ

ব্রিটিশ লেখক রোয়াল্ড দাল।  তিনি ১৯১৩ সালের ১৩ ই সেপ্টেম্বর জন্মেছিলেন।

ছিলেন ফাইটার পাইলট। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে রয়াল এয়ার ফোর্সের হয়ে যুদ্ধ করেছেন। তার প্লেন ক্র্যাশ হয় মিশরে। এই প্লেন ক্রাশের দূর্ঘটনা থেকে সুস্থ হবার পর আবার কাজ নিয়ে যান ওয়াশিংটন ডিসিতে। সেখানে একজন লেখক ইন্টারভিউ নেয়ার জন্য এমন একজনকে খুঁজছিলেন যিনি সরাসরি যুদ্ধে ছিলেন। রোয়াল্ড দালকে তিনি অনুরোধ করেন স্যাটারডে ইভেনিং পোস্টে নিজের অভিজ্ঞতার আলোকে কিছু লেখার জন্য। দাল লিখে দেন। সেটার কোনরূপ পরিবর্তন না করে ছাপানো হয়। দালকে দেয়া হয় এক হাজার ডলার। রোয়াল্ড দাল লেখক হয়ে যান। পরবর্তীতে তার এই অভিজ্ঞতা শট ডাউন অভার লিবিয়া নামে পরিবর্তীত হয়।

তিনি ছোটদের জন্য অনেক অসাধারণ লেখা লিখে গেছেন। চার্লি এন্ড দ্য চকলেট ফ্যাক্টরী তার একটি। এটি নিয়ে হলিউডে ফিল্ম হয়েছে এবং অভিনয় করেছেন জনি ডেপ। তার ম্যান ফ্রম দ্য সাউথের স্ক্রীন এডাপ্টেশন হয়েছে তিনবার। আলফ্রেড হিচকক প্রেজেন্টস এবং কোয়ান্টিন টরান্টিনোর ফোর রুমস এ।

(Photo by Dumant/Getty Images)
(Roald Dahl Photo by Dumant/Getty Images)

এছাড়াও সুদর্শন দাল ছিলেন ব্রিটিশ স্পাই। তথ্য সংগ্রহের জন্য তাকে আমেরিকান অনেক ক্ষমতাবান মহিলাদের পটাতে হত। এবং এই কারণে তাকে অনেক হাই সোসাইটি মহিলাদের সাথে রাত্রী যাপন করতে হয়েছে।

ছবিঃ উইকিপিডিয়া।

1 thought on “বাজী”

  1. Pingback: লেখক লেখক রম্য | @ মুরাদুল ইসলামের ব্লগ

Leave a Comment

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

×
গুরুত্বপূর্ণ
Scroll to Top
বই মডেলিং