সৌদি আরব অস্ত্র কিনলে বা আমেরিকার লগে ফ্রেন্ডশীপ করলে খালি আপত্তি দেখি। একচেটিয়া আপত্তি। দল মত নির্বিশেষে সবাই সৌদি কিংরে গাইল দিতে থাকেন। কিন্তু সৌদির অস্ত্র দরকার বাহে! ইরাক, আইসিস, জিহাদিস্ট গ্রুপ; আর চিরশত্রু ইরান। সৌদির পূব প্রদেশের তেলসমৃদ্ধ অঞ্চলে শিয়াদের মাঝে বিদ্রোহ তৈরী’র চেষ্টায় ইরান। ইরান সৌদির জন্য থ্রেট। ইরান যদি পারমানবিক বোম বানাইয়া ফেলত তাইলে রাতারাতি সৌদি পারমানবিক বোমা কিনে ফেলত আমেরিকা বা পাকিস্তানের কাছ থেকে। এরপরে মিশর কিনত আর কারো কাছ থেকে, ফলে মিডল ইস্ট আপনে পাইবেন নিউক্লিয়ার বোমার উপরে তখন; খালি যুদ্ধ লাগার অপেক্ষা। অনেকে বলে আমেরিকা পারমানবিক বুম বানাইতে পারে, ইজরায়েল পারে তাইলে ইরান বানাইলে কী সমস্যা, আমেরিকা কেন তাদের বাঁধা দেয়?…আমেরিকা এই কারণে বাঁধা দেয়, মিডলইস্টরে যুদ্ধের হাত থেকে বাঁচাইতে। এখন আবার কেউ ভাইবেন না আমেরিকা মহান তাই যুদ্ধ আটকাইতে চায়। আমেরিকা এই অঞ্চলে নিউক্লিয়ার যুদ্ধ আটকাইতে চায় তার নিজ প্রয়োজনেই। তেল-গ্যাসের দাম, বিশ্ব বাণিজ্য, অর্থনৈতিক ও কাঠামোগত উন্নয়ন; নিউক্লিয়ার যুদ্ধ হইলে প্রভাব সবার উপরেই পড়বে।
মিডলইস্ট, এই রিজিয়ন খুবই অস্থির, এইখানে টিকে থাকতে আয়েশী ভাবে চলবে না। ইতিহাসেও ফাইটের উপর ছিল আরব যাযাবরেরা, রবি ঠাকুরও তো বাঙালী আরাম আয়েশে বিরক্ত হইয়া বাঙালী স্টাইলেই একবার বলছিলেন, “ইহার চেয়ে হতেম যদি আরব বেদুঈন, চরণ তলে বিশাল মরু দিগন্তে বিলীন।”
ইরানে মডারেট হাসান রৌহানি প্রেসিডেন্ট হইছেন আবার। আমেরিকা এবং অন্যান্যদের সাথে পারমানবিক চুক্তির করার ফলে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া হয় ইরানের উপর থেকে। ফলে ইরানের অর্থনৈতিক উন্নতি হইছে এবং ইরান এই ধারা বজায় রাখতে চায়। কারণ বেকারত্বের হার বাইড়া গেছে তাদের, এখন আর ঐ আদর্শবাদী রক্ষণশীল পন্থায় চলবে না, তা বুঝছে ওরা। ফলে, হার্ডলাইনারদের বিরুদ্ধে রৌহানির এই বিশাল বিজয়। ইরানের তরুণেরা অবশ্য চাইতেছেন ম্যাসিভ সোশ্যাল রিফর্মেশন বা সামাজিক পরিবর্তন। তাদের আশার কিয়দংশ পুরণ হবে, পুরা কখনোই নয়, অর্ধেকও নয় সম্ভবত। কারণ ইরান ডেমোক্রেটিক নয়, ইরানের ডেমোক্রেসির মাথায় বইসা আছেন গার্ডিয়ান কাউন্সিল। তারা অর্থনৈতিক পরিবর্তন করতে দিবেন, কারন এটা সময়ের দাবী। কিন্তু সামাজিক রিফর্মেশন হবে ধীরে।
সৌদিতে তরুণেরাও পরিবর্তন চাইতেছেন। এবং হাউজ অব সৌদের অনেক গুরুত্বপূর্ন সদস্যও পরিবর্তনের পক্ষে। সৌদি কিং তাদের পক্ষে আছেন। তিনিও চান রিফর্মেশন কিন্তু হার্ডলাইনারদের জন্য বাস্তবায়ন করতে পারতেছেন না। এখানে কেউ প্রশ্ন করতে পারেন সৌদি কাউন্সিল তো আইন তৈরী করে না, তারা আইন উত্থাপন করতে পারে, আইন তৈরী করেন কিং। তাহলে কেন তিনি পরিবর্তন করছেন না? ঘটনা এত সহজ নয়, মধ্য ১৯৮০ থেকে সৌদি সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের প্রধান ছিলেন শেখ সালেহ আল লুহাইদান। তিনি অনেক সামাজিক পরিবর্তন প্রস্তাব আটকে দিয়েছিলেন তাই ২০০৯ সালে তাকে কাউন্সিল থেকে সরিয়ে ফেলেন কিং আব্দুল্লাহ বিন আব্দুল আজিজ। তার পরিবর্তে মডারেট একজনরে বসান। এই রক্ষণশীল হার্ডলাইনার মুফতি এখন আছেন উলেমা কাউন্সিলে। উলেমা কাউন্সিলের তিনি প্রধান। বর্তমান কিং সালমান বিন আব্দুল আজিজ এই উলেমা কাউন্সিলকে অসন্তুষ্ট করে বড় কোন পরিবর্তন করতে পারবেন না, কারণ সৌদির মূলনীতি’র একটি ধর্ম; এবং এই উলেমা কাউন্সিলই হাউজ অব সৌদের ধর্মীয় বৈধ্যতা দেয়। নাইন ইলিভেনের পরে সৌদিতে আমেরিকার সাহায্যে অনেক পরিবর্তন হইছে, কারন সৌদি সালাফিজমের জন্মভূমি। আমেরিকার জন্য তাই এই কাজ দরকারি ছিল। ওপরদিকে উলেমা কাউন্সিলও চাইছিল তাদের মতাদর্শ যেন জিহাদীরা ছিনতাই কইরা নিয়া না নেয়, এজন্য সৌদি রয়াল কোর্ট এবং উলেমা কাউন্সিলের মধ্যে সমঝোতা হয়। এই সমঝোতার জন্যই জিহাদিদের বিরুদ্ধে কিং ব্যবস্থা নিতে পারছেন এবং সৌদিতে জিহাদি তৎপরতা নেই।
সৌদি অন্যান্য দেশে জিহাদীদের সাহায্য করে এমন কথা বলবেন কেউ। তা একদিক দিয়া সত্যি। আগেই বলা হইছে এই সালাফিজমের জন্মভূমি সৌদি, ফলে জিহাদিদের মধ্যে তাদের কানেকশন এই দিক দিয়ে তৈরী হয়। আর সৌদি তার পার্শ্ববর্তী দেশে নিজের স্বার্থের জন্য অস্থিরতা বা সন্ত্রাসী সংস্থাগুলিতে মদদ দেয়। এমন তো আমেরিকা, চীন, ভারত, পাকিস্তান ইত্যাদি নানা দেশ করে আসছে। নৈতিক দিক দিয়ে এগুলি খারাপ, প্রচুর মানুষের প্রাণহানি হয়, কিন্তু এভাবেই তো চলে আসছে ভূ-রাজনীতি।
সম্প্রতি ৪ মে, ২০১৭ তে কিং আব্দুল আজিজ একটি ডিক্রি জারি করছেন, নারীদের অল্প কিছু নয়া অধিকার দিয়া। এভাবেই আস্তে আস্তে নারীদের বেসিক অধিকার দানের দিকে যাবেন সৌদি কিং।
এছাড়াও সৌদি কিংরে ভাবতে হচ্ছে উত্তরসুরী নিয়া। আব্দুল্লাহ, ফয়সাল, সোদারি তিন ফ্যামিলি ফ্র্যাকশন আছে এখানে, সিংহাসন নিয়া এক ভেতর যুদ্ধ, যা শীঘ্রই তীব্র রূপ নিতে পারে মিস ম্যানেজমেন্টে। তখন সৌদি রাজতন্ত্রের এক মূল স্তম্ভ ‘নেতাদের মধ্যে একতা’ হইতে পারে বিপর্যস্ত আর বৈদেশী হস্তঃক্ষেপে দেশ হইয়া উঠতে পারে বিশৃঙ্খল। এই রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা আব্দুল আজিজের ছিল বাইশ বউ, সব ক্ল্যানেই বিয়া করছিলেন যাতে ঐ অঞ্চলে শাসনের অধিকার জন্মে। তার ছিল কমপক্ষে ৪৫ জন পুত্র, মাইয়াদের সংখ্যা জানা যায় না। তার ডেথ বেডে তিনি বলে গেছিলেন, ‘আমার সম্পদ আর সন্তানেরাই আমার শত্রু।’ প্রতিষ্ঠাতার এই কথা বর্তমান কিং এর মনে আছে অবশ্যই, এই বাস্তবতা অস্বীকার করার উপায় নাই।
আমেরিকার সাথে সৌদি আরবের বন্ধুত্বের কারণেই সৌদিতে জিহাদিরা রাইজ করতে পারে নাই। এবং তা সৌদি এবং পুরা বিশ্বের জন্য ভালোই হইছে। আর আমেরিকা বা অন্য কোন বুদ্ধিমান দেশের ভূ-রাজনীতিতে কোন বন্ধু নাই, আছে কেবল ইন্টারেস্ট। অর্থাৎ, তোমার সাথে আজ আমার গুড সম্পর্ক কারণ এতে আমার লাভ আছে।
এই হলো সৌদি’র অস্ত্র কেনা এবং আমেরিকার সাথে বন্ধুত্ব ইত্যাদি বিষয়ে কিছু বাস্তব কথাবার্তা। আশা করি পরবর্তীতে যখন সৌদি’র অস্ত্র কেনা বা আমেরিকার সাথে ফ্রেন্ডশীপে খারাপ লাগবে তখন এগুলিও আপনারা অল্প বিবেচনায় নিবেন।