রোমান স্টোয়িক দার্শনিক লুসিয়াস সেনেকা তার ৬৯ বছরের জীবনে অনেক চিঠি লিখেছিলেন তার লুসিলিয়াস জুনিয়রকে। সেইসব চিঠিতে বিভিন্ন বিষয়ে তিনি উপদেশ দিতেন। ৬৫ এডিতে মারা যান সেনেকা, সে বছর তার ১২৪ টি চিঠির সংকলণ প্রকাশ হয়। এর প্রথম চিঠিটি ছিল সময় নিয়ে, সময় অপচয় না করা বিষয়ে লুসিলিয়াসকে সেনেকার উপদেশ।
সেনেকা লুসিলিয়াসকে উপদেশ দিচ্ছেন সময় বাঁচাতে। কারণ সময় এমন জিনিস যা প্রতিনিয়ত চলে যাচ্ছে। কিছু সময় আমাদের কাছ থেকে জোর করে ছিনিয়ে নেয়া হয়। যেমন, কোন দূর্যোগ, দূর্ঘটনা। কিছু সময় হাত ফসকে পড়ে যায় যেন। নানা ভাবে ও প্রক্রিয়ায় সময় আমাদের থেকে চলে যায়। এই সময় চলে যাওয়া বা ব্যয়ের সবচেয়ে খারাপ উপায় হলো উদাসীনভাবে সময় নষ্ঠ করা। সেনেকা বলেন, যদি সতর্কভাবে একজন দেখেন তাহলে দেখতে পাবেন আমাদের বেশীরভাগ সময় ব্যয় হয়ে খারাপ কাজে, বড় অংশ ব্যয় হয়ে কোন কিছু না করে, এবং প্রায় পুরোটাই লক্ষ্যহীন ভাবে।
মানুষ কি আসলে বুঝতে পারে প্রতিদিন এর মূল্য? সে কি বুঝতে পারে যে আসলে প্রতিদিনই সে মারা যাচ্ছে? মৃত্যু হঠাৎ করে ঘটে যাওয়া কোন একদিনের তাৎক্ষণিক ঘটনা না। প্রতিদিনই তা ঘটে যাচ্ছে। যখন আমরা মৃত্যুকে দেখতে সামনে তাকাই, তখন আমরা আসলে ভুল করি। মৃত্যু তো পেছনে, যেসব দিন আমাদের চলে গেছে, যেসব সময়, বছরকাল, সেসব তো এখন মৃত্যুর কব্জায়। মৃত্যু তা গ্রাস করে নিয়েছে। এক দেশের লোক যদি গড়ে ৫০ বছর বাঁচে, তাহলে সে দেশের কোন একজনের বয়স ২৫ হওয়া মানে প্রায় অর্ধেক জীবনই তার মৃত্যু খেয়ে নিয়েছে। এবং প্রতিদিন, প্রতি মুহুর্তে খেতে খেতে সামনে এগুচ্ছে।
প্রকৃতি আমাদের যা দিয়েছে বা প্রাকৃতিক ভাবে আমরা যে মূল্যবান জিনিসটি পেয়েছি তা হলো সময়। এ ভিন্ন আর কিছুই আমাদের নয়। নাথিং লুসিলিয়াস, ইজ আওয়ারস, এক্সেপ্ট টাইম। সময় ছাড়া, কিছুই আমাদের নয়, লুসিলিয়াস। সেনেকা বলেন। তিনি বলেন প্রতিটি ঘন্টাকে শক্ত করে ধরে রাখতে, যেন অবহেলায় উদাসীনতায় তা নষ্ট না হয়।
কিন্তু এভাবে সময়ের ব্যাপারে, খুবই সচেতন থাকা কি সম্ভব? একেবারে এক মুহুর্তও নষ্ট না করে? না, তা সম্ভব নয়। সেনেকা নিজেও জানান তিনিও সময় নষ্ট করে ফেলেন। কিন্তু তিনি এ ব্যাপারে সতর্ক, কীসে তিনি সময় নষ্ট করছেন, কীভাবে করছেন, কী কারণে করছেন, এ সম্পর্কে তিনি ভালোভাবে ওয়াকিবহাল।
সেনেকা আমাদের বলেন, যে জিনিস একান্তই আমাদের, সেই সময়কে নিজের কাছে রাখতে। অবহেলায়, অন্যমনস্কভাবে ব্যয় না করতে। আধুনিক কালে আমাদের প্রচুর সময় ব্যয় হয় সোশ্যাল মিডিয়ায়-ফেইসবুকে। ফেইসবুক বানানোই হয়েছে মানুষের সাইকোলজিক্যাল নানা প্রবণতাকে অন্যায় ভাবে ব্যবহার করে মানুষকে এতে ধরে রাখার জন্য, এটা কেবল বিশেষজ্ঞদের কথা নয়, ফেইসবুকের কো-ফাউন্ডারও তা স্বীকার করেন।*ফেইসবুক ব্যবহার করতে করতে, অন্যমনস্কভাবে আমাদের প্রচুর সময় চলে যায়। সেনেকা এই ধরনের সময় নষ্টের বিরুদ্ধেই সাবধান করে গেছেন। এই ধরনের সময় নষ্ট মানে নিজের অতি মূল্যবান এক সম্পদ অসচেতন ভাবে নষ্ট করে ফেলা।
এছাড়াও ফেইসবুকে নানা অগভীর ইস্যুভিত্তিক কথাবার্তা, চ্যাট ইত্যাদি আমাদের চিন্তার জগতে বড়ভাবে অবস্থান করে যা আরো সময়ের দাবী করে, এবং সেসবের উত্তর, প্রতিউত্তর ইত্যাদি ভাবা, পোস্ট ইত্যাদিতে…অন্যদের প্রতি হিংসায়…প্রতিক্রিয়ায় কতো সময় যে চলে যায়, অবহেলে…
মূলত ফেইসবুক একটি সময়খেকো মেশিন। আপনার মনযোগ ও আপনার সময়ের বিনিময়েই ফেইসবুক কোম্পানি আপনাকে সার্ভিস দেয়। টাকা লাগে না তাই ফ্রি ভাবার কোন উপায় নেই। আপনার মূল্যবান সময় ও মনযোগ বিক্রি করেই ফেইসবুক প্রফিট তৈরী করে।
ফ্রি বলতে তো কিছুই নেই। এই লেখাটি দৃশ্যত ফ্রি, কারণ এটি পড়তে আপনার কোন টাকা দিতে হচ্ছে না। কিন্তু আপনার সময় ও মনযোগ দিতে হচ্ছে। অর্থাৎ, একটা মূল্য আপনাকে দিতে হচ্ছেই।
তাই মূল্য যখন দিতে হচ্ছে, তাও সময় এবং মনযোগের মত অতি মূল্যবান জিনিস দিয়ে, তখন মূল্যের যোগ্য জিনিসই নিন সে মূল্যের বিণিময়ে। এবং এই মূল্যদানের ব্যাপারে সচেতন থাকুন…কীভাবে কোথায় কী কারণে সময় ব্যয় করছেন, সে ব্যাপারে সজাগ থাকুন।
সংযুক্তিঃ
*”ফেইসবুক বা এই ধরনের এপ্লিকেশন তৈরীর সময় প্রধান চিন্তাটাও থাকে, কীভাবে আপনার সময় ও মনযোগ সবচেয়ে বেশী সম্ভব আমরা খেতে পারব? এর জন্য আপনাকে আমাদের হালকা ডোপামিন হিট দিতে হবে সময়ে সময়ে, ফেইসবুকের লাইক এবং কমেন্ট সে কাজ করে। এর জন্যই একজন আরো বেশী পোস্ট করবে, ছবি দিবে যাতে আরো বেশী লাইক কমেন্ট পায়।
এটা সামাজিক-স্বীকৃতির এক চক্র, মানুষের মনস্তাত্ত্বিক দূর্বলতার সুযোগ নেয়া, অপব্যবহার করা, এবং তা করেই আমার মতো প্রোগ্রামাররা তা ফেইসবুক তৈরী করেছি।
এটি যারা তৈরী করেছেন, আমি, মার্ক (জুকারবার্গ), ইন্সট্রাগ্রামের এভিল সিস্ট্রম; আমরা সবাই জানতাম। সচেতনভাবেই আমরা এ বস্তু তৈরী করেছি।”
– শন পার্কার, ফেইসবুকের প্রতিষ্ঠাতা প্রেসিডেন্ট। এক্সিওস ইভেন্ট, ৮ নভেম্বর, ২০১৭। ফেইসবুকের পাঁচ মাস বয়সে তিনি এর প্রেসিডেন্ট হন। তিনি পিটার থিয়েলকে ফেইসবুকে ইনভেস্টর হিসেবে আনেন এবং ফেইসবুকের প্রথম ইনভেস্টর পিটার থিয়েলের মতে শন পার্কারই প্রথম ফেইসবুকের বিশাল সম্ভাবনা দেখতে পান। জুকারবার্গের কথায়, শন পার্কারের হাত ধরেই ফেইসবুক কলেজ প্রজেক্ট থেকে সত্যিকারের কোম্পানিতে পরিণত হয়। এক্সিওসের ইভেন্টে এই শন পার্কারই ফেইসবুক কীভাবে মানুষের মনস্তাত্ত্বিক দূর্বলতার সুযোগ নিচ্ছে এবং শিশুদের মস্তিষ্কের ক্ষতি করছে, এ নিয়ে সরাসরি কথা বলেন।