স্টোয়িক দর্শন এবং আত্মোউন্নয়ন

স্টোয়িসিজম বা স্টোয়িক দর্শন কী     

আপনার বা আমার যেসব সাধারণ মৌলিক আবেগ-অনুভূতি আছে, হাজার বছর আগেও একই ধরনের আবেগ-অনুভূতি ছিল মানুষের মধ্যে। সেকালেও মানুষকে ভাবিত করেছে তার জীবনের অর্থ কী, কীভাবে আরো ভালোভাবে জীবন যাপন করা যায় ইত্যাদি প্রশ্ন। এই সব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়েই চিন্তাশীল মানুষেরা নানা ধরনের ধারণা দিয়েছেন, উৎপত্তি হয়েছে বিচিত্র সব দার্শনিক মতবাদ। স্টোয়িসিজম বা স্টোয়িকবাদ এরকমই একটি দার্শনিক মতবাদ। প্রাচীন গ্রীসে প্রায় ৩০০ বিসি’র প্রথম দিকে এই মতবাদ প্রচার শুরু করেন সিটিয়ামের দার্শনিক জেনো। স্টোয়া পইকিলে নামক রঙিন বারান্দায় জেনো প্রথম এই মতবাদ প্রচার শুরু করেন বলে এর নাম হয় স্টোয়িসিজম।

ছবিঃ স্টোয়া পইকিলে বা রঙিন বারান্দা। এর দেয়ালে ধ্রুপদি সেরা সব শিল্পীদের আঁকা চিত্রকর্ম শোভা পেত। এর জন্যই নাম হয় রঙিন বারান্দা। এখানেই জেনো তার মত প্রচার শুরু করেছিলেন।

 

স্টোয়িক দার্শনিকেরা মনে করতেন দর্শন হচ্ছে ব্যক্তির জীবনে ব্যবহার করে তার জীবনকে উন্নত করার জন্য। আত্মোউন্নয়ন স্টোয়িক দর্শনের একটি মূল বিষয়। এই দর্শন চর্চার জন্য শুধু অধ্যাপক বা সন্ন্যাসী হবার প্রয়োজন নেই। একজন ব্যবসায়ী, একজন পেশাজীবি, গৃহীনি, রাজনীতিবিদ; যে কেউ এটি ব্যবহার করতে পারেন। বিশেষত যাদের কাজে গুরুত্বপূর্ন সিদ্ধান্ত নিতে হয় প্রায়ই, যেমন যারা শেয়ার বাজারে ইনভেস্ট করেন (স্টক ইনভেস্টর) তাদের জন্য এর গুরুত্ব অনেক। স্টোয়িক দর্শন প্রভাবিত চিন্তা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে যে ইনভেস্টিং তাকে অনেকে বলেন স্টোয়িক ইনভেস্টিং।

 

গুরুত্বপূর্ন স্টোয়িক দার্শনিক

প্রাচীন গ্রীস ও রোমে যেসব গুরুত্বপূর্ন স্টোয়িক দার্শনিক ছিলেন এবং যাদের চিন্তার মাধ্যমেই এই দর্শন পরিপুষ্ঠ হয়েছে তারা হলেনঃ

সিটিয়ামের জেনো

ছবিঃ মস্কোর পুশকিন যাদুঘরে রাখা জেনোর প্রতিকৃতি।

 

স্টোয়িক দর্শনের শুরু মূলত যার কাছ থেকে, তিনি সিটিয়ামের জেনো(৩৩৪ বিসি- ২৬২ বিসি)। ছিলেন একজন সফল ব্যবসায়ী। একবার জাহাজ দূর্ঘটনায় পতিত হবার পরে তিনি এথেন্সের এক বইয়ের দোকানে খুঁজে পান সক্রেটিস বিষয়ে কিছু লেখা। তিনি গ্রন্থাগারিককে জিজ্ঞেস করেন এরকম লোক কোথায় পাওয়া যাবে। গ্রন্থাগারিক তাকে বলেন থিবের ক্র্যাটস এর কথা, যিনি ছিলেন একজন সিনিক দার্শনিক। জেনো ক্র্যাটসের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছিলেন।

 

এপিকটেটাস

ছবিঃ এপিকটেটাসের কাল্পনিক চিত্র।

বিকলাঙ্গ ও আজীবন দারিদ্র পীড়িত এপিকটেটাস (৫০ এডি-১৩৫ এডি) ছিলেন একজন দাস। দর্শনের প্রতি তার আগ্রহ ছিল প্রচন্ড। ফলে মালিকের অনুমতি নিয়ে তিনি রোমান স্টোয়িক দার্শনিক মুসোনিয়াস রাফোস এর কাছ থেকে স্টোয়িক দর্শনের শিক্ষা নেন। এপিকটেটাস মনে করতেন এবং প্রচার করতেন, দর্শন শুধু তাত্ত্বিক আলোচনার বিষয় নয়, বাস্তব জীবনে অনুশীলনের বিষয়।

সেনেকা

ছবিঃ সেনেকার ভাস্কর্য। ১৭ শতকে নির্মিত। এর নির্মাতার নাম জানা যায় নি।

 

প্রাচীন রোম সম্রাট নীরো’র শিক্ষক, রাজনৈতিক পরামর্শদাতা ছিলেন দার্শনিক  সেনেকা (৪ বিসি-৬৫ এডি)। রাজনৈতিক একটি ষড়যন্ত্রে জড়িত থাকার অভিযোগে নীরো তাকে বিষপান করতে বাধ্য করেন।

মার্কাস ঔরেলিয়াস


ছবিঃ রোমের মোসেল ক্যাপিতোলিনি’তে মার্কাস ঔরেলিয়াসের ভাস্কর্য।

মার্কাস ওউরেলিয়াস। জন্মেছিলে ২৬ এপ্রিল ১২১ সালে, মারা যান ১৭ মার্চ ১৮০ সালে। ১৬১ থেকে ১৮০ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন রোমান সম্রাট। তিনি তার চিন্তা লিখে যান এবং এগুলি সংকলিত আছে মেডিটেশন নামক গ্রন্থে। এই গ্রন্থে স্টোয়িক দর্শনের আধুনিক একটি সারমর্ম পাওয়া যায়।

এমন আরো অনেকে বিভিন্ন পেশায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিলেন। দার্শনিকদের পেশা উল্লেখ করার কারণটা হলো, এটা বুঝানো যে আধুনিক মানুষেরা যেকোন পেশায় থেকে এই দর্শনের শিক্ষাগুলি নিতে পারবেন।

 

স্টোয়িক দর্শনের মূল কিছু কথা   

        

স্টোয়িক দর্শন যারা দর্শনের তাত্ত্বিক আছেন তাদের কাছে খুব গুরুত্বপূর্ন নাও হতে পারে। কিন্তু যেহেতু এটি মানুষকে বলে “কীভাবে জীবন যাপন করতে হয়” তাই  আপনি এর কাছ থেকে দারুণ উপকৃত হতে পারেন।

স্টোয়িক দর্শনের শিক্ষাগুলিকে তিন মূলনীতিতে ভাগ করা যায়ঃ

১। আমাদের চারপাশের পৃথিবী সম্পর্কে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গী কীরকম হওয়া উচিত।

২। কোন কাজ করা এবং কোন সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় আমরা কীভাবে চিন্তা করব।

৩। আমাদের ইচ্ছাশক্তি উপর নিজেদের কতৃত্ব প্রতিষ্ঠা। কী আমাদের নিয়ন্ত্রণে আর কী নিয়ন্ত্রণে নেই  সম্পর্কে স্পষ্ট বিচারক্ষমতা অর্জন করা।

 

এপিকটেটাসের শিক্ষা

প্রাচীন গ্রীক স্টোয়িক দার্শনিক এপিকটেটাস যেসব শিক্ষা দিয়ে গেছেন তার বক্তব্যে, সেখান থেকে কয়েকটি বিষয় এখানে তুলে ধরা হলোঃ

“জীবনের প্রধান কাজ হচ্ছে কোন জিনিসগুলি আমার নিয়ন্ত্রণে নাই আর কোন জিনিসগুলি আমার সিদ্ধান্তের নিয়ন্ত্রনে তা চিহ্নিত ও আলাদা করতে পারা। তখন আমি ভালো এবং মন্দ কোন জায়গায় দেখব? যেই জিনিসগুলি আমার নিয়ন্ত্রণে নাই সেগুলিতে নয়। যেইসব সিদ্ধান্ত আমার নিয়ন্ত্রনে আছে সেগুলির মধ্যেই।”

– এপিকটেটাস, ডিসকোর্স ২.৫.৪-৫

কোন জিনিসগুলি আমাদের নিয়ন্ত্রণে আছে এবং কোন জিনিসগুলি আমাদের নিয়ন্ত্রণে নাই তা বুঝতে পারাটা স্টোয়িক দর্শনের একটি মূল কথা। একজন মানুষের নিয়ন্ত্রণে থাকে তার চিন্তা। অন্যের চিন্তার উপর তার নিয়ন্ত্রণ নেই। একজন আপনাকে ফেইসবুকে গালি দিল, এতে আপনার কোন নিয়ন্ত্রণ নেই। কিন্তু এই গালি দেখে আপনার অনুভূতি কী হবে তার নিয়ন্ত্রণ আছে আপনার।

হঠাৎ বৃষ্টি চলে এলো, আপনার কাজে এতে বিঘ্ন সৃষ্টি হচ্ছে ধরা যাক। কিন্তু বৃষ্টি’র উপরে আপনার হাত নেই। সুতরাং, এতে উদ্বিগ্ন না হয়ে, বিচলিত না হয়ে কাজ করাটাই ভালো।

অন্য একজন জঘন্য চিন্তা করে যাচ্ছে, তা আপনি দেখে তাকে বদলাতে পারবেন না। বদলাতে গেলে সে খারাপ প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারে। এর চাইতে আপনি আপনার নিজের চিন্তা বদলাতে পারেন, উন্নত করতে পারেন। কারণ এর উপর আপনার নিয়ন্ত্রণ আছে।

এপিকটেটাসের আরেকটি (ডিসকোর্সঃ৪.১১.৬-৭) বক্তব্য থেকে বলা যায় আমাদের মাইন্ড বা চিন্তার মূল কাজ কী।

প্রথম হচ্ছে, সিদ্ধান্ত নেয়া – ভালো কাজ এবং ভালো চিন্তা করা।

প্রত্যাখান করা – লোভ’কে।

যার প্রতি তীব্র আকাঙ্খা থাকবে – আরো ভালো হওয়ার।

যা থেকে দূরে থাকবে – ঋণাত্মকতা বা নেগেটিভিটি, খারাপ প্রভাব এবং যা সত্য নয় তা থেকে।

প্রস্তুতি নিতে হবে – যা সামনে আছে এবং যা ভবিষ্যতে ঘটতে পারে সে বিষয়ে।

উদ্দেশ্য – যে মূলনীতি আমাদের পরিচালিত করে এবং প্রধান উদ্দেশ্য।

যা গ্রহন করব – ধোঁকা থেকে মুক্তি এবং ভেতরে-বাইরে আমাদের নিয়ন্ত্রণে নেই যা সেইসব।

এপিকটেটাসের এই বক্তব্যে, তিনি আমাদের চিন্তার যেসব কার্যাবলী দেখিয়েছেন তা থেকে স্পষ্ট বুঝা যায় তার দর্শন বাস্তব জীবনে ব্যবহারের জন্য। যেসব বিষয়াবলী এখানে বলা হয়েছে (যেমন, ভালো-মন্দ বা সত্য) এগুলি আসলে কী তা নিয়ে নানা ধরনের দার্শনিক আলোচনা আছে, এবং স্টোয়িকদের পূর্বের ও পরবর্তীকালের দার্শনিকেরা এ নিয়ে আলোচনা করেছেন, বিভিন্ন দৃষ্টিকোন থেকে। স্টোয়িকেরা বিষয়টাকে তাত্ত্বিক আলোচনার বিষয়ের চাইতে, বাস্তবিক জীবনে চর্চার বস্তু হিসেবে দেখেছেন। তাই, যেকোন আধুনিক মানুষ স্টোয়িক চিন্তা আত্মোউন্নয়নের একটি টুল হিসেবে ব্যবহার করতে পারেন।

 

তথ্যসূত্রঃ

ডিসকোর্স – এপিকটেটাস।

লাইভস এন্ড অপিনিওনস অব এমিনেন্ট ফিলোসফারস – ডায়োজিনিস লরেটাস/

ডেইলি স্টোয়িক – রায়ান হলিডে ও স্টিফেন হানস্যালম্যান।

ছবি১- http://agora.ascsa.net/id/agora/image/2008.20.0086

ছবি২- https://en.wikipedia.org/wiki/Stoicism#/media/File:Zeno_of_Citium_pushkin.jpg

ছবি৩ – https://archive.org/details/epictetienchirid00epic

ছবি৪- https://en.wikipedia.org/wiki/File:0_S%C3%A9n%C3%A8que_-_Mus%C3%A9e_du_Prado_-_Cat._144_-_(2).JPG

ছবি৫- https://upload.wikimedia.org/wikipedia/commons/5/59/Marco_Aurelio_bronzo.JPG

ছবি৬ –http://www.rootsimple.com/wp-content/uploads/2013/11/500full.jpg

ছবি৭- http://www.sott.net/image/s18/364131/full/epictetus.jpg

ছবি৮ – http://schoolsucksproject.com/wp-content/uploads/2014/11/misc-quote-waste-time-marcus-aurelius.jpg