দ্য ম্যান উইদাউট এ পাস্ট – অতীতহীন লোকটি

মানুষের অতীত স্মৃতি না থাকলে তার জীবন কেমন হত তা একটি আগ্রহ উদ্দীপক প্রশ্ন। ‘বর্তমানের জন্য বাঁচো’ ইত্যাদি কিছু সুখবাদী দালাই লামা টাইপ প্রচারনা আছে যা খুব জনপ্রিয়। সেই সুখবাদী ধারণার বাইরে গিয়ে দেখলে বর্তমানের জন্য বাঁচা কিংবা অতীত স্মৃতিহীনভাবে বেঁচে থাকার কিছু সমস্যা ধরা পড়ে। মানুষের অস্তিত্ব কিছু সংকটের মুখোমুখি হয় যা নিয়ে চিন্তা করেছিলাম বিস্মরণ নামক গল্পে।

Kaurismaki
ছবি- আকি কাউরিজমাকি

ফিনিশ স্ক্রিনরাইটার এবং পরিচালক আকি কাওরিজমাকি’র দ্য মেন উইদাউট এ পাস্ট ফিল্মে একজন মানুষের অতীতহীনভাবে বেঁচে থাকার একটি চিত্র উপস্থাপন করা হয়েছে। একেবারে সহজ গল্প। গল্পটিতে প্রধান চরিত্র তথা সেই লোকটির অস্তীত্বের সংকট, নিজেকে খোঁজার চেষ্টা ইত্যাদি দেখানো হয় নি। গল্পের ফোকাস এই দিকে ছিল না।

দেখা যায় লোকটি ট্রেন থেকে নেমে একটা পার্কে বসেছিল। সে ছিল দুঃখী এবং হতাশ। হঠাৎ তিনজন ছিনতাইকারী তাকে আক্রমণ করে বসল। তারা তাকে বেদম প্রহার করল। তাদের প্রহারের ভঙ্গি অনেকটা সুইডিশ চলচ্চিত্র পরিচালক রয় এন্ডারসনের দ্য সংগস ফ্রম দি সেকন্ড ফ্লোর ফিল্মে একজন লোককে কয়েকজন পথচারীরর অহেতুক নির্দয়ভাবে পেটানোর মত।

ছিনতাইকারীদের আক্রমণের পর লোকটি অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকে। সে নিজেই হাসপাতালে যায়। চিকিৎসক এক পর্যায়ে মনে করেন সে মারা গেছে। নার্স তাকে কাপড় দিয়ে ঢেকে দেয়।

এরপর লোকটি হঠাৎ করে উঠে বসে। সে ফিরে যায়। জলাশয়ের ধারে পড়ে থাকে। একজন হৃদয়বান সিক্যুরিটি গার্ডের পরিবার তাকে আশ্রয় দেয়।

লোকটি মনে করতে পারে না সে কে ছিল বা কী ছিল। কিন্তু এ নিয়ে তাকে কোন প্রকারে দুশ্চিন্তিত দেখা যায় না। তবে নামহীন-পরিচয়তার জন্য তাকে বেশ ঝামেলায় পড়তে হয়। স্মৃতিহীন লোকটির নতুন জীবন নির্মান গল্পের মূল বিষয়বস্তু।

এমন প্রশ্ন মনে হতে পারে, যেহেতু অতীত নিয়ে সে ভাবিত নয়, তাই চরিত্র হিসেবে সে কী খালি বর্তমানের জন্য বাঁচা টাইপের? এই প্রশ্নের উত্তর ফিল্মে আছে।

এক জায়গায় দেখা যায় লোকটি কয়েকটি আলু রোপন করছে। ফিল্মের দ্বিতীয়ার্ধের শেষদিকে আলু গাছ থেকে ফসল হয়।

তখন তার নতুন জীবনের বন্ধু সেই সিক্যুরিটি গার্ড এসে বলে তাকে আলু দেবার জন্য। কিন্তু লোকটি এতে না সূচক উত্তর দেয়। সে বলে কিছু আলু রেখে দিতে হবে আগামী সিজনের জন্য। সব বুদ্ধিমান কৃষকেরাই এই কাজ করে থাকেন।

এই বিষয়টা উল্লেখযোগ্য এই কারনে যে সেখানে আলুর গাছ ছিল চার পাঁচটির মত মাত্র। এবং আলু নিয়ে লোকটি এবং তার বন্ধুর কথোপকথন কিছুটা কমেডিক।

এছাড়া এক সমস্যায় পড়ে যখন তার পরিচয় বের হয় তখন সে সেই পরিচয় অস্বীকার করে নি। যদিও ততদিনে সে তার নতুন জীবন গুছিয়ে এনেছে। নতুন জীবনে সে পেয়েছে নতুন গার্লফ্রেন্ড। কিন্তু সে তার পুরনো জীবনের কাছে ফিরে যায়, তার অতীত সম্পর্কে জানতে পারে।

শেষপর্যন্ত সে আবার ফিরে আসে তার নতুন জীবনে। পরিচয় বের হবার পর সে তার নতুন জীবনের সুখকে ছেড়ে বাস্তবের মুখোমুখি হয় এবং যখন দেখতে পায় তার সেই জীবন সে ছেড়ে আসতে পারবে, সেখানে তার কোন দায়িত্ব নেই, তার স্ত্রীর সাথে বিচ্ছেদ হয়ে গেছে, তখনই কেবল সে ফিরে এসেছে তার নতুন জীবনে। এই ব্যাপারটাও গল্পের আরেকটা গুরুত্বপূর্ন দিক।

ফিল্মটি হালকা টোনে নির্মিত দার্শনিক গুরুত্ববহ নির্মান। স্মৃতিহীন লোকটির নতুন জীবন গুছানোর প্রক্রিয়া, তার নতুন ভালোবাসা ইত্যাদি স্বাভাবিকতার সাথে উঠে এসেছে। এটা একটা ভালো রোমান্টিক ফিল্মও। প্রেম এখানে একটা মূল উপজীব্য বিষয়। ইরমা নামের ভদ্রমহিলার সাথে স্মৃতিহীন লোকটির প্রণয়োপাখ্যান সাধারণ প্রেমকাহিনী নির্ভর ফিল্মদের মত অতি রোমান্টিকতার দোষে দুষ্ট নয়। অনেক স্বাভাবিক এবং ভালো লেগেছে। অবশ্য এর প্রধান কৃতিত্ব সেই অভিনেত্রীর। কিছু মানুষ জন্মগত অভিনয় প্রতিভা নিয়ে জন্মায়। যাদের মুখের ভাবভঙ্গি অনেক গভীর কথাও বুঝিয়ে দিতে পারে দর্শকদের। ইরমা চরিত্রে অভিনয় করা এই অভিনেত্রী সে মাপের। তার বাচনভঙ্গি এবং মুভমেন্ট পরিশীলিত, শৈল্পিক এবং অসাধারণ। এই চরিত্রে অভিনয়ের জন্য তিনি ২০০২ কান চলচ্চিত্র উৎসবে সেরা অভিনেত্রীর পুরস্কার পান।

দ্য ম্যান উইদাউট এ পাস্ট

দ্য মেন উইদাউট এ পাস্ট অনেক চলচ্চিত্র পুরস্কার এবং সম্মাননায় ভূষিত হয়েছে। ২০০৩ সালে সেরা ভিন্ন ভাষার চলচ্চিত্র হিসেবে একাডেমী এওয়ার্ডের জন্য মনোনীত হয়েছিল। কিন্তু পরিচালক “যুদ্ধে যুক্ত কোন দেশে গিয়ে উৎসব করতে তিনি চান না” বলে এই অনুষ্ঠানে যোগ দেন নি। তার পরের ফিল্ম ফিনল্যান্ড থেকে অস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছিল। তিনি “জর্জ ডব্লিউ বুশের ফরেন পলিসি ২০০২” এর বিরোধীতায় সেই নমিনেশন প্রত্যাখান করেন। ২০০২ সালে ইরানিয়ান বিখ্যাত পরিচালক আব্বাস কিয়ারোস্তামিকে নিউ ইয়র্ক ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে আসার জন্য ভিসা দেয়া হয় নি, এর জন্য তিনি সেই ফেস্টিভ্যাল বর্জন করেন।