দে লিভ, প্লেটো ও অনিয়ন্ত্রিত পুঁজিবাদ

দে লিভ একটি সাই ফাই ফিল্ম যার চিত্রনাট্য লিখেছেন ও পরিচালনা করেছেন জন কার্পেন্তার। ফিল্মের বিষয়বস্ত হচ্ছে শাসক শ্রেনী এবং সমাজের আপার ক্লাস দেখতে মানুষের মত হলেও তারা আর মানুষ নাই। তারা হচ্ছে এলিয়েন।

আমাদের নায়কের নাম জন নাডা। সে ঘটনাক্রমে কিছু সানগ্লাস পায়। এই সানগ্লাস বানিয়েছেন কিছু আন্ডারগ্রাউন্ড রাজনৈতিক কর্মী। তারা জানেন পৃথিবী এলিয়েনের হাতে। পৃথিবীকে এলিয়েনমুক্ত করতে তারা কাজ করে যাচ্ছেন। তারই অংশ হিসেবে তারা তৈরী করেছেন এই সানগ্লাস। এই সানগ্লাস চোখে দিয়ে তাকালে মানুষরূপী এলিয়েনদের আসল রূপ দেখা যায়।

জন নাডা তো সানগ্লাস চোখে দিয়ে অবাক। ম্যানিপুলেটিভ কনজ্যুমারিজমের নানা বিজ্ঞাপনের পেছনে লুকানো সত্য বক্তব্য সে দেখতে পায় কালা চশমার সাহায্যে। মানুষরূপী এলিয়েনদের ভয়ানকরূপ সে দেখতে পায় এবং একসময় এলিয়েনদের সাথে ঘটনাক্রমে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। আর একবার তার বন্ধু ফ্র্যাংক আরমিতাজ সে পরাতে চায় কালা চশমা। কিন্তু আরমিতাজকে তা পরতে চায় না। তীব্র বাঁধা দেয় এবং তাদের দুইজনের মধ্যে এক দীর্ঘ ফাইট শুরু হয়।

এক্ষণে আমাদের প্রাচীন গ্রীসের দার্শনিক প্লেটোর কথা মনে পড়ে। তিনি গুহার রূপকে মানুষের একটি অবস্থা তুলে ধরেছিলেন। কল্পনা করুন একটি গুহা, এর ভেতরে উলটা করে বাঁধা আছে কয়েকজন মানুষ। এরা গুহার মুখ দেখতে পায় না। কিন্তু গুহামুখ দিয়ে আসা বাইরের বস্তুদের ছায়া তাদের সামনের দেয়ালে পড়ে। এই ছায়া দেখেই তারা জীবন ও জগত সম্পর্কে নিজেদের ধারণা তৈরী করে।

এটাই পৃথিবীতে মানুষের অবস্থা।

এখন হঠাৎ করে একজন মানুষ তার বাঁধন খুলে ফেলল। সে বাইরে গেল এবং গিয়ে দেখল বাইরের পৃথিবী আলাদা। প্রথমে তার চোখ ধাঁধিয়ে গেল অতি আলোতে। অতঃপর সে বাস্তব পৃথিবীর গাছ বিরিক্ষি লতা পাতা প্রানী ও সূর্য ইত্যাদি দেখে বুঝতে পারল প্রকৃতির স্বরূপ। এর পরে সে ফিরে গেল আবার তার গুহায়। গিয়ে অন্য বাঁধা ব্যক্তিদের বলতে চেষ্টা করল, বুঝাতে চেষ্টা করল তারা যে ছায়া দেখছে এই ছায়া আসল বাস্তবতা নয়। আসল বাস্তবতা বাইরে ও ভিন্ন।

তখন লোকটার এই প্রচেষ্টা হবে দার্শনিকের কাজ। একজন দার্শনিক এমনই করেন। তিনি সাধারণ মানুষকে সত্য দেখাতে চান।

গুহায় থাকা বাঁধা মানুষেরা মুক্ত লোকটির কথা বিশ্বাস করবে না। তারা তাকে নিয়ে বিদ্রুপ করবে। উন্মাদ মনে করবে। এবং তীব্রভাবে তার বিরোধীতা করবে। সত্য তারা মানতে চাইবে না।

দে লিভ ফিল্মে জন নাডা সানগ্লাস পরিয়ে তার বন্ধু আরমিতাজ সত্য দেখাতে চায়। তার এই প্রচেষ্টা দার্শনিকের প্রচেষ্টা। এবং তার বন্ধু আরমিতাজ যে কালা চশমা পরতে চায় না, এবং জন নাডার সাথে দীর্ঘ ফাইটে লিপ্ত হয় তা সাধারণ মানুষের প্রতিক্রিয়া।

স্লোভানিয়ান দার্শনিক স্ল্যাভো জিজেক দ্য পার্ভাটস গাইড টু ইদিওলজি ফিল্মে দে লিভ ফিল্মের এই ফাইট নিয়ে আলোচনা করেছেন। তার মতে ইদিওলজি হচ্ছে আমাদের সমাজের সাথে স্বতঃস্ফূর্ত সম্পর্ক, এটা এমন নয় যে বাইরে থেকে প্রযুক্ত হচ্ছে। ইদিওলজি হচ্ছে আমাদের চিন্তাধারা, কীভাবে আমরা আমাদের চারপাশকে দেখি ও তার অর্থ বুঝে নেই। আমরা আমাদের এই ইদিওলজিকে একরকম উপভোগ করি, এবং এটাই আমাদের জন্য আরামদায়ক মনে হয়। ফলে আমরা এর থেকে বের হতে চাই না, ও সত্য কী তা দেখতে চাই না। আরমিতাজের ফাইট সেই জিনিসটাই নির্দেশ করে। স্বাধীন হওয়া সহজ জিনিস নয়, এর জন্য কষ্ট পেতে হয়। কারণ সত্য দেখা আরামদায়ক নয়, সত্য আমাদের আরামদায়ক ইল্যুশন বা বিভ্রান্তি ভেঙ্গে দেয়। তাই সহজে স্বাধীন হওয়া যায় না, এর জন্য নিজেকে জোর করে বাধ্য করতে হয়,  জিজেকের ভাষায়, ফ্রীডম হার্টস।

দে লিভ ফিল্মের গল্প রে নীলসনের লেখা এইট অ ক্লক ইন দ্য মর্নিং নামক গল্পের উপর ভিত্তি করে। এর চিত্রনাট্যকার ও পরিচালক জন কার্পেন্তারের মতে, ফিল্মটি একশন সাই ফাই হলে তা হচ্ছে এক ধরনের রাজনৈতিক বক্তব্যের উপস্থাপন। কার্পেন্তার নিজে একজন ক্যাপিটালিস্ট চিন্তাধারার লোক কিন্তু অনিয়ন্ত্রিত ক্যাপিটালিজম সমাজে তীব্র অসাম্য তৈরী করে তার বিরুদ্ধে তিনি বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন ফিল্মটিতে, যা এখনো আরো বেশী প্রাসঙ্গিক।