মুরাদুল ইসলাম » ব্লগ » ট্রলি প্রবলেম বিষয়ক: মোটা লোকের প্রতিশোধ

ট্রলি প্রবলেম বিষয়ক: মোটা লোকের প্রতিশোধ

ট্রলি প্রবলেম নামে একট নৈতিক সমস্যা আছে, অনেকেই হয়ত জানেন। এটি নিয়ে আগে এই সাইটে লিখেছিলাম। এখন আবার এটা নিয়ে, এবং আরেকটু জটিল করে দেখা যাক।

ট্রলি প্রবলেমের এক ভার্সনে আছে, ট্রলিটি যাচ্ছে, আপনার হাতে আছে লিভার। আপনি দেখলেন যে রাস্তা দিয়ে যাচ্ছে এদিকে গেলে পাঁচজন লোক মারা যাবে। আর আপনি যদি লিভার ঘুরিয়ে দেন তাহলে অন্যদিকে ট্রলি ঘুরে যাবে ও একজন লোক মারা যাবে।

অন্য ভার্সনে আছে, একটি ট্রেইন আসছে। সামনে পাঁচজন লোক। রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে একজন অসম্ভব মোটা লোক। এখন একটি লিভার দিয়ে আপনি এই মোটা লোককে যদি রাস্তায় ফেলে দেন তাহলে ট্রেইন আটকে যাবে। বেঁচে যাবে পাঁচজন লোক।

এই দুই জায়গাতেই একজন লোক মারা যায়। পাঁচজন লোক বাঁচে।

দুই জায়গাতেই সরাসরি ধাক্কা দেয়ার কোন সিস্টেম নাই। লিভারের সহায়তা নেয়া হয়েছে। মানুষ সরাসরি খারাপ কাজ করতে চায় না, একটা দূরত্ব রাখতে চায়। (প্রসঙ্গত, হিটলার কখনো কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প ভ্রমণ করেন নি।)

এই দুই দৃশ্য এক হলেও এর মধ্যে একটা বড় পার্থক্য আছে। প্রথমটিতে আপনি লিভার ঘুরাইছেন, এর ফলে গাড়ি অন্যদিকে গিয়ে একজনের মৃত্যুর কারণ হবে। দ্বিতীয় ক্ষেত্রে আপনি বাইরে দাঁড়িয়ে। পাঁচজনরে বাঁচাতে নিজে থেকে গিয়ে মোটা লোকটিকে হত্যা করলেন।

এইভাবে একজন লোককে হত্যা করা, সাধারণ দৃষ্টিতে ন্যায় মনে হয় না। যেমন একজন ডাক্তার দেখলেন পাঁচজন অসুস্থ লোকের পাঁচটা অঙ্গ দরকার। আরেকজন সুস্থ রোগী এসেছে আঙ্গুলে সামান্য ব্যথা নিয়ে। তিনি তাকে প্যারাসিটামল দেবার নাম করে অজ্ঞান করে কিডনি, ফুসফুস ইত্যাদি খুলে নিয়ে অন্যদের শরীরে লাগালেন, ওই পাঁচজনকে বাঁচালেন। কিন্তু এটা সাধারণ দৃষ্টিতে ন্যায় মনে হয় না। একজন সুস্থ লোককে তিনি এভাবে মারতে পারেন না। পাঁচজনকে বাঁচানোর জন্য হলেও।

এছাড়া, আরেকদিকে আমরা চিন্তা করতে পারি। প্রতিটি মানুষের আছে আত্মরক্ষার অধিকার। আপনি আমাকে মারতে এলে আমি শক্তি প্রয়োগ করে আপনাকে নিরস্ত্র করার অধিকার রাখি। এবং একেবারে যদি দেখা যায় আমি বাঁচতে পারছি না আপনাকে হত্যা না করে, তখন আত্মরক্ষার খাতিরে সেই পথও আমি নিতে পারি। মানে আপনাকে হত্যা করতে পারি নিজেকে বাঁচাতে।

কিন্তু এমন যদি কোন অবস্থা হয় যে, প্রাকৃতিক দূর্যোগ আসবে আর আমি মারা যাব, কিন্তু আপনাকে হত্যা করলে এটা থেকে আমি বেঁচে যাব, সেই অবস্থায় আমি আপনাকে হত্যা করলে তা আত্মরক্ষা হবে না। কারণ আমি তো আমাকে হত্যা করতে যান নি।

উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ধরা যাক কোন ভয়ানক দেবতা বললেন তিনি আমার ঘর গুড়িয়ে দেবেন যখন আমি ঘুমিয়ে থাকব, তিনি এভাবে আমাকে হত্যা করবেন। কিন্তু একজন নিরপরাধ কুমারি মেয়েকে অশীতিপর এক বট গাছের নিচে মাথা কেটে ফেলে রেখে আসলে, উৎসর্গ করলে তিনি আমাকে হত্যা করবেন না। এই অবস্থায় আমি মেয়েটিকে খুন করতে পারি না। করলে এটি আত্মরক্ষা হয় না।

আত্মরক্ষার খাতিরে আমি যখন আপনাকে হত্যা করছি, এটা হচ্ছে আপনি আমাকে হত্যা করতে চেয়েছেন এর ফল হিসেবে, আমি এমনিতে আপনাকে হত্যা করতে চাই নি, সুতরাং এর ন্যায্যতা রয়েছে।

একইরকম ভাবে, আমি এমন কোন কাজ করছি, যার ফল হিসেবে আপনার মৃত্যু হতে পারে কিন্তু আমার উদ্দেশ্য ছিল না আপনাকে হত্যা করা, এমন কাজকে ন্যায্যতা দেয়া যায়।

যেমন কোথাও মারাত্মক আগুন লেগেছে। আমি একজন ফায়ার ফাইটার। কার্বন ডাই অক্সাইড গ্যাস দিচ্ছি আগুণ নেভাতে। আপনি এক চিপায় লুকিয়ে ছিলেন। আগুনের আঁচ গায়ে লাগে নি। কিন্তু আমার কার্বন ডাই অক্সাইডের চাপে আপনি শ্বাসরোধ হয়ে মারা গেলেন।

এটাতে আমি আপনাকে হত্যা করতে চাই নি, আমার কাজের ফল হিসেবে আপনি মারা গেছেন, এটার ন্যায্যতা দেয়া যায়।

আত্মরক্ষার অধিকারের কথাটি আবার ভাবলে, সেই মোটা লোকটি, যাকে লিভার দিয়ে ধাক্কার মাধ্যমে আপনি ট্রেইনের সামনে ফেলে দিবেন, তার আত্মরক্ষার অধিকার আছে কি না? স্বাভাবিক ভাবেই আছে।

আপনি যেমন আপনাকে কেউ হত্যা করতে আসলে সর্বোচ্চ পন্থা অবলম্বণ করে নিজেকে বাঁচাতে পারবেন, সেও তেমনি পারবে। মানুষ হিসেবে এটা তারও অধিকার।

ধরুন, আপনি যখন লিভারে হাত দিচ্ছেন সে তখন দেখলো। তার কাছে লুকানো ছিল একটি শটগান। সে এখন নিজের জীবন বাঁচাতে কি আপনাকে শুট করতে পারবে?

আত্মরক্ষার অধিকারের হিসাবে তো অবশ্যই পারবে। কারণ অন্য যে পাঁচজন ট্রেইনের নিচে পড়ছে তার জন্য এই মোটা ব্যক্তি দায়ী নয়। সে বসে বসে বাদাম খাচ্ছে আর পাভ জি খেলছে। এই অবস্থায় একজন লিভার টেনে তাকে ট্রেইনের সামনে ফেলে দিচ্ছে সে দেখতে পেল। এখন সে তো আত্মরক্ষার চেষ্টা করতেই পারে, নাকি?

এই মোটা লোকটির জায়গায় নিজেকে ভাবুন। শটগান দিয়ে আপনি লিভার টানতে থাকা লোকটি গুলি করলেন। এখানে আপনি একজনকে হত্যা করলেন নিজেকে বাঁচাতে, আর অন্যদিকে আরো পাঁচজন মারা গেল ট্রেইনের চাপায়। অর্থাৎ, ছয়টা মৃত্যুর বিণিময়ে আপনি নিজের জীবন বাঁচালেন, যদিও পাঁচটি এখানে সরাসরি না।

কিন্তু এটা কে কি ন্যায় বলা যায়?

আপনি গাড়ি চালাচ্ছেন। ব্রেইক কাজ করছে না হঠাৎ। ধরা যাক, আপনি নিজেকে বাঁচাতে পারেন ফুটপাত দিয়ে গাড়ি তুলে দিয়ে। সেখানে ছয়জন লোক ঘুমিয়ে আছে। এখন যদি আপনি ফুটপাত দিয়ে গাড়ি তুলে ছয়জনকে মেরে নিজেকে বাঁচান, এই কাজকে কি ন্যায় বলা যায়?

একইরকম একেবারে প্রথম দৃশ্যের কথা বলা যায়। ট্রলি এগিয়ে যাচ্ছে। সামনে গেলে পাঁচজন মারা পড়বে। অন্যদিকে গেলে একজন। সেই একজন হলেন আপনি, দাঁড়িয়ে আছেন স্নাইপার হাতে। জন উইকের মত হাতের টিপ আপনার। আপনি জানেন একজন সাধারণ লোক অবশ্যই পাঁচজনকে বাঁচাতে এদিকে ট্রলি নিয়ে আসবে এবং এতে আপনার ভবলীলা সাঙ্গ হবে। এখন আপনি কি আপনার প্রিয় স্নাইপার দিয়ে ট্রলির সুইচে বসে থাকা লোকটির খুলি উড়িয়ে দিতে পারেন? এটা কি ন্যায় হবে? যদিও আত্মরক্ষা, তথাপি এতে ছয়জন লোক মারা যাবে, পাঁচজন সরাসরি না হলেও।

বেশীরভাগ লোক এমন অবস্থায় নিজেকে বিসর্জন দেবার কথা বলে। অন্তত উত্তর দেবার কালে। যেমন ঐ মোটা লোকটির ক্ষেত্রে লোকটিকে অসম্ভব মোটা ধরে নেয়া হয়েছে যে একটি ট্রেইন আটকে দিতে পারে। এটি না হলে মানুষেরা বলত, আমি সামনে পড়ে গিয়ে ট্রেইন আটকে দেব। কারণ অনেক মানুষ নিজেকে বিসর্জন দিয়ে হিরো হতে চায়। অন্যকে অন্যায় খুন করে খারাপ হিসেবে জীবন ধারণের চাইতে হিরো হয়ে মরা, এই গর্ব তার কাছে অনেক বড়।

একজন মানুষ তার সিদ্ধান্ত সে নিজ থেকেই নিবে। আমরা বাস্তব জীবনে এরকম অনেক দেখে থাকি। একজন বীর তার সঙ্গীদের বাঁচাতে সামনে এগিয়ে গিয়েছেন গুলি করতে করতে, যাতে সঙ্গীরা পালিয়ে যেতে পারে। তিনি মারা গেছেন, কিন্তু সঙ্গীরা বেঁচে গেছে। তিনি ইতিহাসে হয়েছেন বীরশ্রেষ্ট।

তিনি তার নৈতিক বিচার থেকে নিজেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। কারণ এটাই তার কাছে নৈতিক ও যুক্তিযুক্ত মনে হয়েছে।

একই নৈতিক বুদ্ধিমত্তা বা বিচার ক্ষমতা প্রথম দৃশ্যের অন্য রাস্তায় থাকা লোকটি এবং দ্বিতীয় দৃশ্যের মোটা লোকটিরও আছে। তাহলে তারা কেন এই অপশন নিবে না যে পাঁচজনকে বাঁচানো দরকার? এবং যদি তারা তা না নেয়, তাহলে তো তারা এদেরকে বিসর্জনই দিল। এই ভুল কাজটির ন্যায্যতা তারা দিতে পারে না, যেমন একজন লোক যখন যুদ্ধক্ষেত্রে দেখতে পারবেন তার মরার ফলে তার সঙ্গীরা বেঁচে যাবে, তখন তিনি সঙ্গীদের না বাঁচানোর মত কাজ করতে পারেন না, করলেও এর ন্যায্যতা দিবেন কি প্রকারে?

স্নাইপার হাতে লোকটি বা শট গান হাতে মোটা লোকটি দাঁড়িয়ে আছে ধরে নিলে, আপনি সুইচ বা লিভার যখন বদলাতে যাবেন, তখন যদি গুলি না আসে তাহলে কি হলো অবস্থাটা?

ঐ লোকটি বা মোটা লোকটি আপনাকে গুলি করে নি, মানে তাদের এতে সায় আছে। তারা পাঁচজনকে বাঁচাতে চায়।

বা ধরা যাক তারা গুলি করল, এবং আপনি যুযুৎসু শিখেছিলেন তাই গুলি কাটিয়ে গিয়ে লিভার বা সুইচ টানতে পারলেন। এক্ষেত্রে লোকটি মারা গেল। পাঁচজন বাঁচলো।

দুই ক্ষেত্রেই, পাঁচজন লোককে সে মরে গিয়ে বাঁচিয়েছে। আপনি নন।

নাকি আপনি বাঁচালেন? ত্যাগ তো সে করেছে, দুই ক্ষেত্রেই ত্যাগ হলো তার।

 


নিওপোলিটান দার্শনিক ব্লগের The Fat Man Retaliates এর উপর ভিত্তি করে।

Leave a Comment

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

×
গুরুত্বপূর্ণ
Scroll to Top
বই মডেলিং